আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সার্ভে আলোচনা: জ্ঞান কি ঝামেলা করে?

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

(আমার ব্লগের আগের দুটো সার্ভে পোস্ট পড়ে নিলে বোঝা সহজ হবে) ******************************************* শুরুতেই উপসংহার টানা যায়, অবশ্যই ঝামেলা করে। তবে প্রশ্ন থেকে যায় কোন স্কেলে? তারচেয়েও বড় প্রশ্ন থেকে যায় জ্ঞানথেকে সৃষ্ট ঝামেলা কি এড়ানো সম্ভব? অথবা জ্ঞান থেকে সৃষ্ট ভুল কি শোধরানো সম্ভব? এখানে কিছুটা ভারিক্কি আনারজন্য 'জ্ঞান' শব্দটি ব্যবহার করছি এটা মেনে নিচ্ছি, তবে অভিধানগত 'জ্ঞান' শব্দের চেয়ে এখানে ব্যবহৃত 'জ্ঞান' কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির হতে পারে, অথবা এভাবে বলা যায়, এখানে ব্যবহৃত 'জ্ঞান', অভিধানের 'জ্ঞানে'রই একটি বিশেষ প্রয়োগ। জ্ঞানকে এখানে অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। একটা উদাহরন দেয়া যাক। ধরুন কোনএক ভবনে একদিন আগুল লাগল, উদ্ধারকাজ চলল পুরোদমে, এবং তারপরদিন একটি ছেলে ক্লাসে তার বন্ধুকে বলল, 'জানিস? গতকাল যে পুলিশ অফিসারটি প্যারাসুট পরে উড়ে এসে ঐ বাচ্চাটাকে বাঁচিয়েছে, আমি হলাম সেই পুলিশ অফিসারের ভাই।

' 'তাই??' বন্ধু আকাশ থেকে পড়ে, 'ঐ সুপারকূল পুলিশ অফিসার তোর ভাই? বলিস কি?' তখন পুলিশ অফিসারের ভাই বলল, 'নাহ্, উনি আমার ভাই হতে যাবে কেন? আমি উনার ভাই, আপন ভাই, কিন্তু উনি তো আমার ভাই না। ' অনেকেই প্যাঁচে পড়ে যাবেন এই কথোপকথনকে ব্যাখ্যা করতে। অধিকাংশ মানুষই পালিত ভাই, বেয়াই বা এধরনের কিছু ব্যাখ্যার দিকে চলে যান। অথচ খুবই সহজ কথা, আমি তার আপন ভাই, কিন্তু সে আমার আপন ভাই না, মানে সে আমার বোন। কিন্তু 'পুলিশ অফিসার হলো পুরুষ'এরকম একটা 'নলেজ' আমাদের মাথায় কোন না কোনভাবে ঢুকে আছে, তার উপর প্যারাসুট পড়ে উড়ে এসে একটা বাচ্চাকে বাঁচাচ্ছে বললে আমাদের জ্ঞান একজন পুরুষের ছবিই এঁকে ফেলে।

এরকম ভুরি ভুরি উদাহরন আছে, সবচেয়ে প্রচলিতটা মনে হয় এরকম। দুইব্যাক্তি রাত বারোটার দিকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, প্রথমজন দ্বিতীয়জনের ছেলে, কিন্তু দ্বিতীয়জন প্রথমজনের বাবা না। কিভাবে? এই প্রশ্নের জবাবে অধিকাংশ মানুষই পাল্টা প্রশ্ন করে, 'আপন ছেলে?' 'দুই ব্যাক্তি রাস্তায় হাঁটছে' বললেই আমরা খুব স্বাভাবিকভাবে দুজন পুরুষ হাঁটছে কল্পনা করি, আর সময়টাকে যদি গভীর রাত করে দিই তাহলে তো আর কথাই নেই। বাবা না হলে মা হবে, খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান আমাদেরকে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে বাঁধা দেয়।

এখন কথা হলো, উপরের যে উদাহরণদুটো দেয়া হলো, এগুলো আসলে তেমন ক্ষতিকর বিষয়না। এগুলো দিয়ে এটাই বোঝানো যায় যে একটু তেমন সাধারন না এমন কোন ঘটনাকে (মহিলা পুলিশের প্যারাসুটে চড়া বা রাত বারোটায় একজন মহিলা বাহিরে হাঁটছেন) ব্যাখ্যা করতে দিলে মানুষ খানিকটা কনফিউজড হয়ে যায়। তবে এতে ক্ষতি কি? সত্যি বলতে এই লেভেলের ঝামেলা করলে আসলে তেমন ক্ষতি নেই, আবার কখনও কখনও ক্ষতি হয়, যখন আমরা এরকম ইল্যুশনে ভুগি যে, 'যা দেখেছি যেভাবে দেখেছি সেটাই সেভাবে ঠিক, এর বাইরে কিছু নাই। ' অথবা আগের বাক্যতে 'দেখা' ক্রিয়াপদের স্থানে 'শেখা' শব্দটাও ব্যবহার করা যায়। তবে যাই হোক, পুর্বলব্ধ জ্ঞান যে আমাদের চিন্তাকরার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে সেটা সত্য।

তবে শিশুদের ক্ষেত্রে বিষয়টা মারাত্নক। পুর্বলব্ধ জ্ঞান তাদের চিন্তাকরার শক্তিকেই প্রভাবিত করেনা, সিদ্ধান্ত নেবার শক্তি বা জাজমেন্টাল পাওয়ারকেও প্রভাবিত করে। আগের দুটো পোস্টে যে এক্সপেরিমেন্ট দিয়েছি সেটা শিশুদের জন্য একটু কঠিন, তবে আরেকটু সহজ একটা এক্সপেরিমেন্টের কথা এখানে তুলে ধরা যায়। আগের দুই পোস্টের মতই ব্যাপার, তবে জটিলতাটা কম (ব্লগার ধারাভাষ্য অবশ্য এই এক্সপেরিমেন্টের কথা কমেন্টে তুলে ধরেছেন, তাঁকে ধন্যবাদ)। এই এক্সপেরিমেন্টে শুধু বাস্কেট আর বক্স থাকবে, শিশুটি বক্সে বল রেখে পানি খেতে যাবে, আরেকটি ছেলে এসে বক্স থেকে বলকে বাস্কেটে তুলে রাখবে, বাক্স আর বাস্কের জায়গার অদলবদল ঘটাবনো একটুও, একটুও না।

এরপরেই পানি খেয়ে বাচ্চাটা ফিরে আসবে। এখন সে বলটা প্রথমে কোথায় খুঁজবে ? যে কেউই এক্ষেত্রে বলবেন যে বক্সে খুঁজবে, তাইনা। সত্যি বলতে ব্যাপারটার সাথে 'বলটিকে তুলে অন্যখানে রেখেছে' এব্যাপারটির সামান্যও সম্পর্ক নেই। তবে দেখা গেছে, তিন বছরের কম শিশুরা সেটা বুঝতে পারেনা, তারা বলে বাস্কেটে খুঁঝবে। কারন তাদের মাথার মধ্যে 'বাইয়াস' হিসেবে ঢুকে গেছে যে বলটি এখন বাস্কেটে আছে।

সুমন যে ব্যাপারটা জানেনা, এই ব্যাপারটা তারা খেয়াল করতে পারেনা। 'বলের বক্স থেকে বাস্কেটে যাওয়ার' জ্ঞান তাদের জাজমেন্টাল পাওয়ারকে প্রভাবিত করে। এখন দেখা যাক এডাল্টদের ক্ষেত্রে কি ঘটে? তাদের জাজমেন্টাল পাওয়ার কি আসলেই প্রভাবিত হয় কিনা? এজন্যই আগের দুটো পোস্টের সার্ভে। আগের দুই পোস্টের দুটো সার্ভের মধ্যে ছোট্ট যে ডিফারেন্স তা হলো, প্রথমটিতে বলে দেয়া হয়েছে যে, সুমন পানি খতে যাবার পর রুমন ঘরে ঢুকে বলটিকে বক্স থেকে তুলে বাস্কেটে রেখে দিয়েছে; আর দ্বিতীয়টিত বলা হয়েছে যে সুমন পানি খতে যাবার পর রুমন ঘরে ঢুকে বলটিকে বক্স থেকে তুলে অন্য যেকোন পাত্রে রেখে দিয়েছে, সেটা বাস্কেটও হতে পারে, পটও হতে পারে, আবার বাকেটও হতে পারে। এখন দুই ক্ষেত্রে সুমন পানি খেয়ে এসে প্রথম কোথায় খুঁজবে? একটু চিন্তা করলেই দেখা যায় যে এখানেও বলটিকে তুলে অন্যপাত্রে রাখা হয়েছে এব্যাপারটির সাথে সুমনের ফিরে এসে বল খুঁজে দেখার কোনই সম্পর্ক নেই।

সত্যি বলতে কি, এই 'বল তুলে আবার রাখা' বিষয়টাকেই ট্রিকি বাইয়াস হিসেবে ঢোকানো হয়েছে এক্সপেরিমেন্টে। মূল ফ্যাক্টর হলো দুটো: ১. পাত্রের আকৃতি ২. পাত্রের অবস্থান গৌণ আরেকটি ফ্যাক্টর হলো, ১. সুমনের স্মৃতিশক্তি ও দরজার অবস্থান তবে গৌন ফ্যাক্টরটি সম্মন্ধে যেহেতু কিছু উল্লেখ করা হয়নি, তাই মূলতঃ মূল দুটি ফ্যাক্টরে নজর রেখেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে সুমন কোথায় খুঁজবে। এই ফ্যাক্টর দুটোর সাপেক্ষে মতামত বিভক্ত হয়ে যেতে পারে, আকৃতি না অবস্থান, কোনটার প্রতি মানুষ বেশী সেনসিটিভ এনিয়ে গবেষনাও হতে পারে। তবে যত যাই হোক, আগের দুই পোস্টের দুটো সার্ভের রেজাল্ট একই রকম হওয়া উচিত, কারণ দুটো সার্ভে আসলে পুরোপুরি এক। অথচ, সুজান রিচ আর পল ব্লুম, যারা এই দুটো সার্ভে ডিজাইনার, দেখিয়েছেন যে এডাল্টদের ক্ষেত্রে, প্রথম সার্ভের 'বাস্কেটে বল রাখা' আর দ্বিতীয় সার্ভের 'যেকোন পাত্রে বল রাখা' এই দুটো ভিন্ন জ্ঞান তাদের জাজমেন্ট করার পাওয়ারকে প্রভাবিত করে; প্রথম ক্ষেত্রে বাস্কেটের সম্ভাবনা দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বাস্কেটের সম্ভাবনার চেয়ে অনেক বেশী হয়।

তাদের রিসার্চে তারা অনেক সাবজেক্ট নিয়ে নিরীক্ষন করেছেন, তাদের প্রাপ্ত রেজাল্ট মোটামুটি এরকম ছিল, ১. প্রথম সার্ভের ক্ষেত্রে বক্স: ৬০% বাস্কেট: ৩৫% বাকেট বা পট: ৫% ২. দ্বিতীয় সার্ভের ক্ষেত্রে বক্স: ৭০% বাস্কেট: ২৫% বাকেট বা পট: ৫% এখানে দেখুন, প্রথম সার্ভেতে 'বাস্কেটে বল রেখেছিল' এই অপ্রয়োজনীয় জ্ঞানটা বাস্কেটের সম্ভাবনাকে শতকরা ১০ ভাগ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাইয়াস নলেজ এত শক্তিশালী? সামহোয়ারের সার্ভেতে কি হয়েছে দেখা যাক ... ১. প্রথম সার্ভের ক্ষেত্রে (১২ জন অংশ নিয়েছেন) বক্স: ৩৮% বাস্কেট: ৫২% বাকেট বা পট: ১০% ২. দ্বিতীয় সার্ভের ক্ষেত্রে (৮ জন অংশ নিয়েছেন) বক্স: ৫৬% বাস্কেট: ৩৩% বাকেট বা পট: ১১% অবশ্য এক্ষেত্রে সাবজেক্টের সংখ্যা খুব কম ... তবে ট্রেন্ডটা কি একই নয়? তবে এনিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, এটাই স্বাভাবিক। পল আর সুজান এই ব্যাপারটিকে আখ্যা দিয়েছেন 'কার্স অভ নলেজ' বলে, এটা কতটা ভয়াবহ ভুমিকা রাখতে পারে সেনিয়ে গবেষণার অবকাশ এখনও আছে, তবে যারা ভেবেছি সার্ভে দুটো ভিন্ন, তারা ট্রিকড হয়েছি । তবে এরসাথে জ্ঞানপাপী ধরনের কোন সম্পর্ক না খোঁজাই ভাল, জ্ঙাপাপীরা সম্ভবতঃ জেনেশুনে পাপ করে। তবে অনেক সেমি-জ্ঞানপাপী আছেন যারা গায়ের জোরে জ্ঞানকে নাড়াচাড়া করতে চান, এবং তারা কিন্তু না জেনেশুনেই বিরাট াপ করে বসেন।

যেমন এ্যারিস্ৎল; 'প্রতিটি মানবভ্রুনই শুরুতে ছেলে থাকে, পরে মায়ের পেটের বিশেষ কোন জীবানুর প্রভাবে মেয়ে হয়ে যায়' তাঁর এই ভয়ানক থিওরী দুইহাজার বছরের বেশী সময় ধরে পৃথিবীর তাবৎ নারীজাতিকে সামাজিক অত্যাচারের শিকার করেছে; এ্যারিস্ৎল মিয়ার ভাগ্য ভাল যে পৃথিবীর অধিকাংশ নারীই ব্যাপারটা জানেননা, তা নাহলে 'মোস্ট হেইটেড ম্যান বাই উইমেন' র‌্যাংকিংয়ে প্রথম পদ থেকে তাঁকে নড়ানোর সাধ্য কার?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.