সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com
কলকাতা থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক বইয়ের দেশ পত্রিকার জুলাই-সেপ্টেম্বর সংখ্যায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন হর্ষ দত্ত।
প্রথম প্রশ্ন ছিল : নিজের দেশ, নিজের মাটি থেকে ছিন্নমূল হওয়ার ব্যথার ছোয়া রয়ে গেছে আপনার সৃষ্টিতে। কেন এ বিষয়টা ঘুরেফিরে এসেছে? সুনীল উত্তর দিয়েছেন, দেশভাগ নিয়ে আমার বাবার একটি উক্তি আমার সব সময় মনে পড়ে।
’৪৭-এর ১৫ আগস্ট সকালে বাবা ভাঙা ভাঙা গলায় বলেছিলেন, ভারত স্বাধীন হলো, আর আমরা আমাদের দেশ হারালাম! সেই হারানোর বেদনা এতো বছর পরও বুকের মধ্যে টনটন করে। অথচ তার ঠিক যুক্তি নেই।
আমার ঠাকুরদা ছিলেন টোলের পণ্ডিত, অতি দরিদ্র পরিবার, ফরিদপুরের এক অখ্যাত গ্রামে আমাদের ছিল মাটির বাড়ি, জমিজমাও যৎসামান্য। ফরিদপুরের বদলে আমাদের বাড়ি যদি হতো বীরভূমের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামে, তাহলে কলকাতায় এসে পড়াশোনা ও চাকরি-বাকরি করে শহরবাসী হয়ে যেতাম। গ্রামের সেই বাড়িতে যেতাম কালেভদ্রে, শেষের দিকে হয়তো আর যেতামই না।
মাটির বাড়িটা ধসে পড়লে কিংবা অন্য কেউ জবরদখল করলেও মাথা ঘামাতাম না। এ রকম তো হয়ই। কিন্তু ফরিদপুরের সেই গ্রাম থেকে আমাদের আত্মীয়-স্বজন সবাই যখন চলে এলেন, তখন বোঝা গেল, ইচ্ছা থাকলেও আমাদের আর সেখানে কখনো ফেরা হবে না। এটাই বেদনার উৎস। দিল্লিতে বসে কয়েকজন নেতা কিছু ঠিক করলেন আর আমাদের জন্মস্থান হারাতে হলো।
এ এক দারুণ অপমানবোধ। আমার অনেক লেখাতেই তাই দেশভাগ ঘুরেফিরে এসেছে।
১৯৪৭ থেকে ২০০৭ মোট ৬০ বছর। মধ্যরাতের স্বাধীনতার সন্তানরা এখনো সেই সময়ের বিভীষিকা, বেদনা ও হিংসাকে ভুলে যেতে পারেননি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে গেছে কিন্তু স্মৃতি জেগে আছে।
চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা বলেন, ভুলে যাওয়ার বিপক্ষে দাড়িয়ে মনে রাখা এক প্রকার প্রতিবাদ। আবার শামসুর রাহমান বলেন, মূলত স্মৃতি এক প্রকার জীবনযাপন। ৪৭-এর সেই উত্তাল দিনগুলোর স্মৃতি ইনডিয়ান বাঙালি ও বাংলাদেশের বাঙালিদের মনে জীবনযাপনের অংশ হিসেবে স্মৃতি নাকি এক প্রকার প্রতিবাদ হিসেবে রয়ে গেছে তা স্পষ্ট নয়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক। তার অনুভূতি মোটামোটি স্পষ্ট।
কিন্তু সাহিত্য-শিল্পের বৃহত্তর অঙ্গনে দেশভাগ, ’৪৭-এর স্বাধীনতার অভিঘাত কিভাবে পড়েছিল? কেউ হয়তো যুক্তি তুলতে পারেন, অভিঘাত খুজে দেখার প্রয়োজন কোথায়? সাধারণ কথায়, সাহিত্য-শিল্প জনমানসের যৌথ অবচেতনার ফল। সেখানে এ অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বড় ঘটনাগুলো কিভাবে প্রভাব ফেলেছে তা খুজে দেখা বেশ জরুরি কাজ। কথায় কথায় অনেকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের দেশে কোনো মনে রাখার মতো উল্লেখযোগ্য কাজ হলো না। ভালো উপন্যাস লেখা হলো না। এ আক্ষেপ সঙ্গত।
কিন্তু পেছনের কারণগুলো কি তা স্পষ্ট করে জানা হলো না। অথবা জানা গেলেও তার মুখোমুখি হওয়ার সাধ্য সবার নেই। হতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের মহত্ত্ব ও আত্মত্যাগকে আমাদের লেখক-ঔপন্যাসিকরা আত্মস্থ করতে পারেননি। অথবা মুক্তিযুদ্ধ লেখকদের মধ্যে তেমন কোনো গভীর অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি। কিংবা অভিঘাত তৈরি করলেও যে রকম প্রস্তুতি ও দক্ষতা নিয়ে লিখতে হয় তা আমাদের লেখকরা অর্জন করতে পারেননি।
এ যুক্তির কোনোটাকেই হয়তো আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত নই। ফলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস নেই। একই ঘটনা দেশভাগ ও ’৪৭-এর স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও সত্য। শুধু ’৪৭ কেন বাংলা অঞ্চলে ঘটে যাওয়া বৃহত্তর যে কোনো সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনা সম্পর্কে বড় ও কার্যকর সাহিত্যকর্ম বাংলাভাষায় খুজে পাওয়া কঠিন।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে বড় অভিঘাত পড়েছিল ’৪৭-এর দেশভাগের ফলে।
সে সময় এখানকার সমাজ যে আকার নিয়েছিল তার ধারাবাহিকতা কোনো না কোনোভাবে আজো আমরা বহন করে চলেছি। কিন্তু তার যথেষ্ট ছাপ আমাদের সাহিত্যে নেই। সে জন্যই হয়তো বলা হয় এক ঋত্বিক ঘটক ছাড়া দেশভাগ আর কোনো শিল্পী বা সাহিত্যিককে এতো প্রবলভাবে নাড়া দিতে পারেনি। এ বিষয়ে সুবর্ণরেখা, কোমলগান্ধার, মেঘে ঢাকা তারার মতো মুভির সঙ্গে তুলনীয় আর কোনো শিল্পকর্ম বাঙালি সাহিত্যিক, ডিরেক্টর বা শিল্পী উপহার দিতে পারেননি। তাহলে দেশভাগের যে বেদনার কথা বলা হয়, বিশেষ করে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সমাজ যে দেশভাগের বেদনার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে কাতর হয়ে পড়েন তা কি লোক দেখানো কোনো ব্যাপার?
এ কথা কি মিথ্যা যে, সাময়িক অসুবিধা উতরে গিয়ে দেশভাগের ফসল যে মধ্য ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী ঘরে তুলেছেন তাদের মধ্যে লেখকরাও অন্তর্ভুক্ত? যাদের লাভবান হওয়ার ইতিবৃত্তের ভেতর হারিয়ে গেছে লাখ লাখ ঘরহারা মানুষের আর্তনাদ, হিংসার শিকার হওয়া হাজারো অসহায় মানুষের ইতিহাস।
এ কথার বিপক্ষেও যুক্তি আছে, আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমাজ যে শ্রেণীর অংশ সে একই শ্রেণীর অংশ ছিলেন হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত সাহিত্যিকরা। বাস্তবে এদের অনেকের দেশও ভাগ হয়নি। দিল্লি, বম্বে, হায়দরাবাদে তারা স্থায়ী আবাস গড়েছিলেন দেশভাগের আগে। তবু দেশভাগ নিয়ে তারা লিখেছেন স্মরণীয় উপন্যাস, অসংখ্য গল্প, গান ও কবিতা। পাঞ্জাবের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বিরহের গানগুলোর অধিকাংশই লেখা হয়েছে দেশভাগের বেদনাকে আশ্রয় করে।
এর ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে।
সাদত হোসেন মান্টো, কৃষণ চন্দর, ইসমত চুগতাই, খাজা আহমদ আব্বাস, কর্তার সিং দুগগাল, সৈয়দ আবদুল মালিক, মুলক রাজ আনন্দ, কালিন্দিচরণ পাণিগ্রাহী, গুলজার সিং সন্দু, মুন্সী প্রেম চন্দ, অমৃতা প্রিতম, কুররাতুল আইন হায়দার, খুশবন্ত সিং সহ অসংখ্য সাহিত্যিকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে যারা দেশভাগ নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস, গল্প ও কবিতা। তৈরি হয়েছে দেশভাগের সাহিত্য নিয়ে আলাদা একটি সাহিত্যের অধ্যায়। এ সাহিত্য থেকে সহজেই বুঝে নেয়া সম্ভব, পাঞ্জাবের সাহিত্যিক কিংবা হিন্দি ও উর্দু সাহিত্যের প্রখ্যাত ব্যক্তিদের মনে দেশভাগ কি গভীর ক্ষত তৈরি করছিল। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে এমন কোনো বেদনাদীর্ণ, স্মরণীয় সাহিত্যের উল্লেখ করা সত্যিই কঠিন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেভাবে বলেছেন তার সাহিত্যে সেভাবেই ঘুরেফিরে দেশভাগ প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রসঙ্গ হিসেবে দেশভাগ আসেনি। সুনীলের প্রথম আলো ও পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাসে দেশভাগ এসেছে তুলনামূলকভাবে একটু বড় প্রসঙ্গ হয়ে। পূর্ব বাংলা থেকে উন্মুল পরিবার ও যুব সমাজের কথা এসেছে অর্জুন উপন্যাসে।
সমরেশ বসু লিখেছেন সুচাঁদের স্বদেশ যাত্রা।
জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক শংকর লিখেছেন এপার বাংলা ওপার বাংলা। সমরেশ বসু লিখেছেন যুগ যুগ জিয়ে। অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে ও অলৌকিক জলযান। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন আলো নেই। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে এ বিষয়ে উপন্যাস লিখেছেন কায়েস আহমদ (নির্বাসিত একজন), ইমদাদুল হক মিলন (পর), প্রশান্ত মৃধা (মৃত্যুর আগে মাটি)।
যাদের উপন্যাস ও গল্পে দেশভাগ প্রসঙ্গটি এসেছে তাদের মধ্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, সমরেশ বসু, রশীদ করীম, শওকত ওসমান, সৈয়দ শামসুল হক, গৌরকিশোর ঘোষ, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, হাসান আজিজুল হক মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, অমর মিত্র, প্রফুল্ল রায়, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়সহ আরো কেউ কেউ। কবিতা ও গানে পাওয়া গেছে কিছু পরোক্ষ ছাপ।
তুলনায় গদ্য ও প্রবন্ধ সাহিত্য বেশি সরব। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গবেষণা হয়েছে। সাহিত্যিকদের মধ্যে ঋত্বিকের পর যিনি দেশভাগের কারণে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন তিনি নীরোদ চন্দ্র চৌধুরী।
এ বেঙ্গল বাউল ও ইংলিশ জেন্টলম্যানের জন্ম হয়েছিল কিশোরগঞ্জে। তিনি সুদূর লন্ডনে বসে বাংলার যে স্মৃতিচারণ করেছেন তার বাঙালি জীবনে রমণী গ্রন্থে তার সিংহভাগ জুড়ে আছে বাংলাদেশের প্রকৃতির বর্ণনা ও তা নিয়ে হাহাকার। তার মতে, দেশভাগের ফলে এ রূপ দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে।
বাংলার প্রকৃতি মানে তার কাছে বাংলাদেশের প্রকৃতি। আমার দেবোত্তর সম্পত্তি আত্মজীবনীমূলক বইয়েও তিনি দেশভাগ নিয়ে লিখেছেন।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনও দেশভাগ নিয়ে তার বেদনার কথা জানিয়েছেন নানা লেখা ও বক্তৃতায়। শৈশবে ঢাকায় একজন মুসলিমের হত্যাদৃশ্য তার মনে কি গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল নানা প্রসঙ্গে তিনি বারবার তা স্মরণ করেছেন। অন্নদাশংকর রায় তখনকার বাংলাদেশে ছিলেন কাজের সূত্রে। তার আত্মজীবনীতেও আছে দেশভাগ প্রসঙ্গ। এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক দুটি আত্মজীবনীর কথা না বললেই নয়।
একটি মিহির সেনগুপ্তের বিষাদবৃক্ষ। এটি কলকাতার আনন্দ পুরস্কার পেয়েছে। অন্যটি তপন রায়চৌধুরীর বাঙালনামা। বাংলাদেশের লেখক মীজানুর রহমান এ প্রসঙ্গে লিখেছেন তার আত্মস্মৃতি কলিকাতা কমলালয় বইয়ে।
খুব অবাক করার বিষয় হলো, দেশভাগ নিয়ে বাংলাভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মগুলোতে জনগোষ্ঠীর হাহাকার, ক্ষুধা ও অস্তিত্বের টানাপড়েনের জোরালো চিত্রন চোখে পড়ে না।
অথচ দেশভাগ ও ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার পুরো প্রেক্ষাপটকে যদি বিবেচনা করা হয় তবে এটাকে মোক্ষম একটি ফিকশনাল প্রেক্ষাপট বলা যায় অনায়াসে। কলকাতার স্থায়ী লেখকদের জীবনে দেশভাগ হয়তো তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি। দাঙ্গা আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে ছিন্নমূল মানুষের আহাজারির দৃশ্য তারা দেখেছিলেন। তার প্রতিক্রিয়া যা হওয়ার ততোটুকু হয়েছে। কিন্তু যারা তখনকার বাংলাদেশ থেকে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের নানা শহরে ভিড় জমিয়েছেন সাধারণ মানুষ হিসেবে, তাদের জীবন সংগ্রাম ও পরিচয় সঙ্কট নিয়ে যুদ্ধ সত্যিকার অর্থে একটি উপন্যাসেরই বিষয়।
আবার কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের শহর-গ্রাম থেকে যারা ঢাকা বা অন্য শহরগুলোতে এসেছেন তাদের পরিচয় প্রতিষ্ঠার কাহিনীও উপন্যাসের বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উভয় এলাকার সাহিত্যিকরা বিষয়টিকে এড়িয়ে গেছেন অথবা খেয়ালই করেননি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।