আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।
দেখতে দেখতে জিয়া-মঞ্জুর হত্যার ৩২ বছর হয়ে গেলো। আজ ৩০ মে ২০১৩ সাবেক রাষ্ট্রপতি জে. জিয়াউর রহমানের বত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে একদল সেনা সদস্য চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিদ্রোহের দায়ে তড়িঘড়ি করে প্রহসনমূলক গোপন বিচারে ১৩ জন পদস্থ সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসিতে হত্যা করা হলেও জিয়া হত্যার বিচার গত তিন দশকে অনুষ্ঠিত হয়নি।
জে. জিয়াকে হত্যার তিন দিনের মাথায় চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তৎকালীন জিওসি মেজর জে. এম এ মঞ্জুরকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। জিয়া এবং মঞ্জুর এই দুজনেই একাত্তরে যুদ্ধকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকার নিযুক্ত সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, জে. জিয়ার সহধর্মিণী দুটার্মে দশ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও স্বামী হত্যার বিচার করেননি। জিয়ার দল এবং তার স্ত্রী-পুত্র ক্ষমতায় থেকে কেন জিয়া হত্যার বিচার করলেন না, এই প্রশ্নের জবাবও অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। সময় এসেছে জিয়া-মঞ্জুর হত্যার বিচারের এবং একই সঙ্গে কোন স্বার্থের কারণে বেগম জিয়া স্বামী হত্যার বিচার করলেন না, সেই রহস্য উন্মোচনের।
জে. জিয়াকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তিনি দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এক সময় সেনাবাহিনীতে জিয়াউর রহমান খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু দেশ শাসনের ৫/৬ বছরের মাথায় তিনি সেনা সদস্যদের অপছন্দের পাত্রে পরিণত হন। যে জন্য তাকে উৎখাত করতে অন্তত দেড় ডজন ক্যু হয়েছে বলে জানা যায়।
স্বাধীনতা লাভের সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতাবিরোধী আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের এদেশীয় চর মোশতাক চক্রের লেলিয়ে দেয়া রশিদ-ফারুক-ডালিমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার ৯ দিন পর সফিউল্লাহকে সরিয়ে উপপ্রধান জিয়াকে সেনাপ্রধান এবং সে সময় ভারতে প্রশিক্ষণরত পাকিস্তান প্রত্যাগত ব্রিগেডিয়ার এরশাদকে পদোন্নতি দিয়ে উপ-সেনাপ্রধান বানায় খুনিচক্র। জাতির জনককে হত্যার ৮০ দিন পর ৩ নভেম্বর ভোর রাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। ৭ নভেম্বর উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের দ-মু-ের একক কর্তা হয়ে গেলেন জে. জিয়া। এরপর ’৭৬-এর ২৯ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছ থেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ কেড়ে নেন তিনি। এর ৬ মাসের মধ্যে সায়েমকে পদচ্যুত করে রাষ্ট্রপতির পদও দখল করেন জে. জিয়া।
বাহাত্তর থেকে সাতাত্তরÑ মাত্র ৫ বছরের ব্যবধান। এই সময়ে মেজর থেকে মেজর জেনারেল, দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্রবাহিনী প্রধান ও সেনাবাহিনী প্রধানÑ সবগুলো পদই জিয়ার দখলে চলে এলো। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে বিভিন্ন দলের নীতি-আদর্শহীন সুবিধাবাদীদের নিয়ে তিনি রাজনৈতিক দল (বিএনপি) করেন। এভাবে তিনি সকল ক্ষমতার মালিক মোক্তার হয়ে গেলেন। একজন ব্যক্তি যখন একটি রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক ও উৎস হয়ে যান, তখনই তাকে হত্যা করে ক্ষমতার হাতবদল যুগে যুগে হয়েছে।
জে. জিয়ার বেলায়ও তাই হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জিয়া হত্যার তিনদিনের মধ্যে জে. মঞ্জুরকে কেন হত্যা করা হলো?
রাষ্ট্রপতি জিয়াকে যখন হত্যা করা হয়, জে. এরশাদ তখন সেনাবাহিনী প্রধান আর জে. মঞ্জুর ছিলেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি। জিয়া হত্যার পর সেনাপ্রধান হিসেবে শক্তিমান মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হন জে. এরশাদ। যেহেতু জে. জিয়াকে চট্টগ্রামে হত্যা করা হয়, সে জন্য ওই হত্যা-ষড়যন্ত্রে কে বা কারা জড়িত, জে. মঞ্জুরের তা কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে। জিয়া হত্যাকারীদের আড়াল করার জন্যই যে জে. মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমাদের দেশের দুই আলোচিত জেনারেলের হত্যাকা- নিয়ে এ পর্যন্ত বহু লেখালেখি হয়েছে। তবে সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এ এস এম সামসুল আরেফিন ‘জিয়া-মঞ্জুর হত্যাকা- এবং তারপর’ শিরোনামে ১৯৯৮ সালে একটি তথ্যবহুল বই প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থের বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়Ñ জে. জিয়া হত্যার জন্য যে জে. মঞ্জুরকে দায়ী করা হয়, যদ্দুর জানা যায়, এই হত্যাকা-ের সাথে জে. মঞ্জুরের কোনো সম্পর্কই ছিল না। ঐ গ্রন্থে সানাউল্লাহ লিখেছেন, “৩০ মে ভোর সাড়ে চারটার কিছু পরে টেলিফোন বেজে উঠলে ঘুম ভেঙে ফোন ধরেন জে. মঞ্জুর। অন্য প্রান্ত থেকে মেজর মোজাফফর জানান, ‘ঞযব চবৎংরফবহঃ যধং নববহ শরষষবফ’. মঞ্জুর তার দফতরে গিয়ে দেখলেন, তার জন্য সেখানে ৪০ জন সামরিক অফিসার অপেক্ষা করছেন।
উপস্থিত অফিসারদের জেনারেল বললেন, ‘কিছু সেনা অফিসার প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করেছে। এ হত্যাকা- ঘটার পেছনে অবশ্যই অফিসারদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ কাজ করেছে। সেনাবাহিনীর ভেতরে মুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধাদের একটা দ্বন্দ্ব অনেকদিন থেকে বিরাজ করছে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মাঝে জমে থাকা দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই এ হত্যাকা-ের অন্যতম কারণ। ঘটনা যখন ঘটে গেছে তখন আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
আপনারা আপনাদের মতামত নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। উপস্থিত ৪০ জন অফিসারই সমর্থন জানালেন হাত তুলে। ’ উপস্থিত একজন অমুক্তিযোদ্ধা অফিসার দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমাদের শুধু হাত তুলে এ ঘটনার প্রতি সমর্থন জানালে চলবে না, শপথ নিতে হবে। নিজ উদ্যোগে দপ্তরে রাখা একটা কুরআন শরিফ নিয়ে এলেন তিনি। মেজর জেনারেল মঞ্জুরের সামনে পবিত্র কুরআন ছুঁয়ে একে একে শপথ নিলেন সবাই।
” (পৃ. ১৯২)। অর্থাৎ হত্যার সাথে জড়িত না থাকা সত্ত্বেও জিওসি হিসেবে এর দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন মঞ্জুর।
জিয়া হত্যার পর সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিলেন সেনাপ্রধান জে. এরশাদ। অসুস্থ উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে সিএমএইচ থেকে এনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ করানো হয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের বার বার বলা হয় আত্মসমর্পণ করতে।
সেনপ্রধান এরশাদ প্রতিশ্রুতি দেন, ‘আত্মসমর্পণের পর ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের পরিবারসহ বিশেষ বিমানযোগে বিদেশে প্রেরণ করা হবে এবং ৬ মাসের মধ্যেই ওদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার নিশ্চয়তা দেন তিনি। জে. মঞ্জুর একজন ব্রিগেডিয়ারকে ঢাকার সাথে আলোচানার দায়িত্ব দেন। ’ এরশাদের দেয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাব কর্নেল মতিউর ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে জানানÑ ‘আমাদের সারেন্ডার করার প্রশ্নই ওঠে না। প্রয়োজনে আপনারা সারেন্ডার করবেন। ’ এ পর্যন্ত জানা তথ্য অনুযায়ী কর্নেল মতিউরই জিয়াকে হত্যা করেন।
শেষ পর্যন্ত যা হবার তাই হলো। চট্টগ্রাম বিদ্রোহ ব্যর্থ হলো। যে তরুণ সেনা কর্মকর্তারা জে. জিয়াকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল, তাদের জানা উচিত ছিল, চট্টগ্রামে বিদ্রোহ করে ঢাকায় গিয়ে ক্ষমতা দখল করা যাবে না। বিদ্রোহের দ্বিতীয় দিনে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সদরে বসে সেনা কর্মকর্তারা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন। সভায় বিদ্রোহীদের শীর্ষ পর্যায়ের একজন লে. কর্নেল মতিউর এক পর্যায়ে বলেন, ‘এবহঃষবসবহ বি যধাব ষড়ংঃ ঃযব নধঃঃষব. আমাদের সামনে এখন ২টি পথই খোলা আছে, হয় আত্মহত্যা না হয় এসকেপ (পলায়ন) করতে হবে।
’ সন্ধ্যা ৬টায় জে. মঞ্জুর অফিসারদের বৈঠক ডাকেন। সভায় ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ (বর্তমানে বিএনপি নেতা)কে আবারও ঢাকার সাথে সমঝোতা করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ৩১ মে সন্ধ্যা থেকেই বিদ্রোহীরা যে যেমনে পারে, সেনানিবাস ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। জে. মঞ্জুরকেও সেনানিবাস ছেড়ে যেতে অনুরোধ করা হয়। প্রথমে পালাতে কোনোভাবেই তিনি চাচ্ছিলেন না।
অবশেষে মঞ্জুর রাজি হলেন। রাত ১টার পর বাসায় ঢুকেন তিনি; সঙ্গে ছিলেন মেজর মোজাফফর। মেজর রেজা রয়ে গেলেন গাড়িতে। মেজর মোজাফফর বলেন, ‘স্যার, যাওয়ার আগে আপনি কি কিছু বলে যেতে চান। ’ মাথা নেড়ে সম্মাতি দেন জেনারেল।
ক্যাসেটে ১৫ মিনিটের বক্তব্য রেকর্ড করে প্রচারের জন্য চট্টগ্রাম বেতারে পাঠানো হয়েছিল। সেটা অবশ্য প্রচারিত হয়নি। বক্তব্যে বিদ্রোহের ঘটনাবলী মঞ্জুর খোলাখুলি বলেন। এতে আরো ছিল জে. এরশাদের ষড়যন্ত্রের কথা। ঐ ক্যাসেটটি কোথায় আছে জানি না।
ক্যাসেটটি পাওয়া গেলে অনেক অজানা সত্য জানা যেতো। জানা যেত, কিভাবে জিয়া-মঞ্জুরকে হত্যার মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মেরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত করা হয়েছিল।
জে. মঞ্জুর ও বিদ্রোহীদের কয়েকজন ৩১ মে দিবাগত রাত ২টার পর সেনানিবাস ছেড়ে রওয়ানা হন অজানার পথে। একজন অমুক্তিযোদ্ধা বেইমান অফিসার বিদ্রোহীদের এসকেপ রুটের কথা সরকার পক্ষকে জানিয়ে দেয়। তিনটি সেনাভর্তি ট্রাক নিয়ে মেজর মান্নান বিদ্রোহীদের পিছু রওয়ানা হন।
পথিমধ্যে অনেক ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে বিদ্রোহীদের এক দলের সঙ্গে পিছু ধাওয়া করা সৈনিকদের গুলিবিনিময় হয়। এ সময় বিদ্রোহীদের দুই শীর্ষ নেতার একজন কর্নেল মতিউর চেচিয়ে বলেন, ‘শুট মি মাহবুব শুট মি। ’ এক সঙ্গে দুজনের দুটি স্টেনগান থেকে গুলি বেরুলো। দুজনেই চিরতরে শেষ হয়ে গেলেন।
১ জুন দুপুর ১২টার পর জে. মঞ্জুরকে আটক করে প্রথমে ফটিকছড়ি ও পরে হাটহাজারী থানায় নিয়ে আসা হয়। মুহূর্তে খবরটি প্রচার হয়ে যায়। পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তারা এবং ট্রাকভর্তি সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) এমদাদ সেখানে আসেন। চোখ, হাত, পা বেঁধে জেনারেলকে এক গাড়িতে এবং স্ত্রী-সন্তানসহ অন্যদের আরেকটি গাড়িতে উঠানো হয়। তৎকালীন ডিআইজি (পরে আইজি) এএসএম শাহজাহানসহ পুলিশ সদস্যরা রাত সাড়ে ৯টার দিকে এসকট করে বন্দি মঞ্জুরকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেন।
জিয়া হত্যার পর বিচারপতি সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেও তখন থেকেই সেনাপ্রধান এরশাদ সর্বময় ক্ষমতার মালিক বনে যান। গ্রেফতারের পর সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, সেনানিবাসে আনার পর উত্তেজিত সৈনিকরা জেনারেল মঞ্জুুরকে হত্যা করে। আসল ঘটনা তা নয়। ঢাকার নির্দেশেই যে মঞ্জুরকে ঐ রাতে ঠা-া মাথায় হত্যা করা হয় তার বিবরণ রয়েছে ঐ গ্রন্থে। যে ক্যাপ্টেন এমদাদ জে. মঞ্জুরকে গ্রেপ্তার করেন, তাকে চট্টগ্রামের সিও ব্রিগেডিয়ার আজিজুল ইসলাম (মারা যান ’৯২ সালে) ব্রিগেডিয়ার (পরে জেনারেল) লতিফের উপস্থিতিতে জানিয়ে দেন, হাটহাজারী থানা থেকে নিয়ে আসার পথে অথবা সেনানিবাসে এনে মঞ্জুরকে হত্যা করতে হবে।
এ সময় ব্রিগেডিয়ার আজিজ, ব্রিগেডিয়ার লতিফকে বলেন, ‘বিষয়টি আরো একবার ভেবে দেখবেন স্যার?’ লতিফ জানান, সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে, এটা এখন কার্যকর করতে হবে। ’ (পৃ. ২০৯)। আর ওই নির্দেশদাতা যে তৎকালীন সেনাপ্রধান, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। জে. মঞ্জুর বুঝতে পেরেছিলেন, কী হতে যাচ্ছে। সেনানিবাসের ফায়ারিং রেঞ্জে ঢুকে জিপ থেকে নামানো হলো জেনারেলকে।
শেষ কথাগুলো ক্যাপ্টেন এমদাদ ও জওয়ানদের মঞ্জুর বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে বলবেন আমাকে মাফ করে দিতে। তার জন্য, সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারলাম না। মেজর এমদাদ ও জওয়ানরা ক্ষমা চাইলেন জেনারেলের কাছে। দোয়া-দরুদ পড়লেন সবাই। হাবিলদার আবদুল মালেক অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে পয়েন্ট ব্লাংক রেঞ্জে মঞ্জুরের মাথায় একটা মাত্র গুলি করে।
১ জুন দিবাগত রাত ১২টা বাজতে তখনো কয়েক মিনিট বাকি। (পৃ. ২১২)।
এর পরের কাহিনী সবারই জানা। তড়িঘড়ি করে অতিশয় দ্রুততার সাথে গোপন বিচারে ১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ফাঁসিতে হত্যা করা হয়। যাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তারা এবং তাদের স্বজনরা প্রায় সবাই বলেছেন, তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ।
চেইন অব কমান্ড ভাঙা এবং বিদ্রোহের দায়ে ১৩ জন অফিসারকে ফাঁসি দেয়া হলেও গত ৩২ বছরে জিয়া-মঞ্জুর হত্যার বিচার হয়নি। জিয়া হত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কারা জড়িত আজো দেশের মানুষ জানতে পারেনি। জিয়া হত্যার বিচার না হওয়াটা এক হিসেবে ইতিহাসের প্রতিশোধ। কারণ এই জে. জিয়া, জাতির পিতা হত্যা-ষড়যন্ত্রে শুধু জড়িত ছিলেন না, তিনি ঐ বিচার বন্ধ রেখেছেন এবং আত্মস্বীকৃত খুনিদের রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। কাজেই জিয়া হত্যার বিচার বন্ধ থাকাটা ইতিহাসের প্রতিশোধ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আর জে. জিয়ার সহধর্মিণী বেগম জিয়া দুবার দশ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও স্বামী হত্যার বিচার করেননি। কিসের ভয়ে বা কোন গোপন রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বেগম জিয়া স্বামী হত্যার বিচার করেননি, তা জানার এবং বলার সময় এসেছে।
রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার লক্ষ্যেই যে, জিয়া-মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জিয়া হত্যার রহস্য উন্মোচনের জন্যই মঞ্জুরকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন ছিল। কাজেই যারা জিয়াকে হত্যা করেছে, তারাই মঞ্জুরকে হত্যা করেছে বলে পর্যবেক্ষক মহলের নিশ্চিত অভিমত।
জিয়া হত্যায় যে মঞ্জুর জড়িত ছিলেন নাÑ এটাও অভিজ্ঞ মহলের বিশ্বাস। আর ইদানীং জে. এরশাদের খুব তরক্কি দেখা যাচ্ছে। জিয়া-মঞ্জুর হত্যার বিচার শুরু হলে জে. এরশাদ আবার গর্তে প্রবেশ করবেন। যদ্দূর জানা যায়, কর্নেল মতিউর ও কর্নেল মাহবুবের নেতৃত্বে একটি দল জিয়াকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যায় সবচেয়ে লাভবান ব্যক্তি জিয়াউর রহমান আর জিয়া-মঞ্জুর হত্যায় একইভাবে লাভবান হয়েছেন জে. এরশাদ।
জিয়া মঞ্জুর হত্যার সাথে এরশাদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিয়ষটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফাঁসিতে নিহত ব্রিগেডিয়ার মোহসীন ও কর্নেল মাহফুজ দু’জনই জিয়া হত্যার জন্য এরশাদকে দায়ী করেছেন। (জিয়া-মঞ্জুর হত্যাকা- এবং তার পর, পৃ. ১৫৪)। এই অবস্থায় যতোদিন জিয়া-মঞ্জুর হত্যার বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে উদঘাটিত না হবে ততোদিন এ দুটি হত্যা এবং ফাঁসিতে ১৩ অফিসার হত্যার শতভাগ দায়-দায়িত্ব অবৈধভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী জে. এরশাদের ওপরই বর্তাবে।
সুত্র
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।