আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দরজা : চলন্ত স্থাপত্য



অনিবার্য বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য রেখে বিজ্ঞজনেরা দরজার বাহারি নাম দিয়েছেন চলন্ত স্থাপত্য। প্রবেশ এবং বাহির Ñ এ দুই ধরনের জাগতিক প্রয়োজনের সমীকরণই নাকি দরজা। আর এ দরজার সঙ্গে সৌন্দর্য ও রুচিবোধের চেতনাটি সক্রিয় রয়েছে। তবে মানুষ দরজা ইস্যুতে মূলত নিরাপত্তার বিষয়টিই বিশেষভাবে বিবেচনায় আনে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ যখন পাহাড়ের গুহা অথবা গাছের কোটরে বসবাস করতো তখনো তারা নিরাপত্তার জন্য এগুলোর প্রবেশ পথে এক টুকরো বড় পাথর অথবা গাছের গুঁড়ি চেপে রাখতো।

এরপর সময়ের ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমায় মানুষ সমতল ভূমিতে বসবাস করতে শেখে। এ সময় তার সজ্ঞাজাত চেতনা থেকেই ঘর তৈরির প্রয়োজনীতা অনুভব করে, বানাতে শেখে দরজাও। অবশ্য কারিগরি উৎকর্ষের কারণে যুগে যুগে দরজার বিবর্তন হয়েছে। ধরন আর ব্যবহার কৌশলে বেশ খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এটার উপযোগিতা যেমন কমেনি, তেমনি উদ্দেশ্যেও পরিবর্তন আসেনি।

কারণ দরজার প্রয়োজনীয়তা কমাটা জরুরিও নয়, বাস্তবও নয়। এটা যে একটা অনিঃশেষ প্রয়োজন। সব ধরনের দরজা খোলা বা বন্ধ করার প্রক্রিয়া এক নয়। আবার সব দরজা একই উপাদান দিয়ে তৈরিও হয় না। কাঠ, চামড়া, কাগজ, বেত, খড়, টিন, পাটখড়ি, বাঁশ, প্লাস্টিক ও ধাতব দরজা থেকে শুরু করে বর্তমানে স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক দরজাও রয়েছে।

দরজার সঙ্গে বিশ্ব সংস্কৃতির সম্পর্কটা বেশ পুরনো। কারণ ঘরের হোক আর উপাসনালয়েরই হোক বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে দরজা ধর্মীয় বা সামাজিক মূল্যবোধের একটা অনিবার্য অঙ্গ হিসেবে কাজ করছে। শুভ হোক আর অশুভই হোক দরজার একটা নিজস্ব গুপ্ত চরিত্র রয়েছে। পার্থিব ও অপার্থিব বিশ্বের প্রবেশদ্বারÑ এ চেতনাটির সঙ্গে দরজা শব্দটি গভীরভাবে জড়িত। অপার্থিব জগতের সঙ্গে পার্থিব জগতের সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ অথবা শত্রুতাপূর্ণ হতে পারে।

কিন্তু এ দুটো জগতের যোগসূত্র হিসেবে মানুষ তার অবচেতন মন থেকেই একটা দরজা অনিবার্য ধরে নেয়। যারা সত্যের পূজারি, তাদের ওপর শয়তানি কুপ্রভাবের প্রতিবন্ধক হিসেবে দরজাকে কল্পনা করা হয়। তাই যারা ধর্মীয় চেতনাসম্পন্ন এবং সুপথে থাকতে আগ্রহী তাদের বাধ্য হয়ে নিজস্ব পরিম-লের পবিত্রতা বিভিন্ন ধর্মীয় কর্মকা-ের মাধ্যমে বজায় রাখতে হয়। নতুবা তাদের পরিম-লে অপশক্তির কুপ্রভাব প্রবেশ করার দরজাটা খুলে যায়। কিছু কিছু উপজাতীয় ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, শুভ ও অশুভ শক্তির প্রবেশ পথেই অপশক্তিগুলো গিজ গিজ করে।

কিন্তু অশুভ শক্তির সম্পর্কটা মনের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে জড়িত থাকলেও কেন অপশক্তির সঙ্গে দরজার সম্পর্ক দেখানো হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তবে এর দ্বিবিধ কারণ থাকতে পারে। হয়তো দরজা শয়তানি সীমানার বাহ্যিক প্রান্ত। তাই বিশ্বের বহু উপজাতি এখনো ঘরের সামনে আগুন অথবা জ্বলন্ত কয়লা রেখে দেয়, অথবা মানুষ দরজাকে পবিত্র ভেবে নিয়েছে প্রবেশ পথ হিসেবে। রোমান পুরাণের গুরুত্বপূর্ণ দেবতা জ্যানাস হচ্ছেন দরজা ও ফটকের অধিপতি।

ফটক ও দরজা দিয়ে যেহেতু প্রবেশ ও প্রস্থান ঘটে, সে জন্য দ্বার রক্ষী এ দেবতাকে বিপরীত দিক থেকে ফেরানো দু’মুখের অধিকারী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। একই কারণে তাকে বর্ষ শুরু ও বর্ষ শেষের দেবতা ভাবা হয়, তার নামানুসারেই বছরেরই প্রথম মাস জানুয়ারির নামকরণ হয়। যুদ্ধকালে রোমানরা জ্যানাসের মন্দিরের দরজা দুটিই খোলা রাখতো। তাদের বিশ্বাস ছিল দুমাথা হওয়ার কারণে দু’দিকে দৃষ্টি রেখে তিনি রোমকে পাহারা দেবেন। গ্রিক পুরাণে বলা হয়েছে, নিদ্রা দেবতা হিপানোস ও নিশাদেবী নিক্সের পুত্র মরফিউজ হচ্ছেন স্বপ্ন দেবতা।

তার রয়েছে দুটো রূপÑ দুঃস্বপ্ন ও সুস্বপ্ন। পৃথিবীতে আসার জন্য মরফিউজ যখন স্বর্গ থেকে গজনির্মিত সিংহদরজা দিয়ে বের হন, তখন মানুষ মিথ্যা স্বপ্ন দেখে। আর যখন তিনি কাটার তৈরি দরজা দিয়ে বের হন তখন মানুষ দেখে সত্য স্বপ্ন। বেদ গ্রন্থে নির্দেশ পাওয়া যায়, নববধূকে স্বামীর গৃহের দরজা দিয়ে ডান পায়ে চৌকাঠ স্পর্শ না করেই প্রবেশ করতে হবে। আধুনিক যুগেও এ রীতির সাক্ষ্য মেলে।

সোমালিয়া, সিরিয়া, আর্মেনিয়া ও ইজিপ্টের কিছু উপজাতি ঘরের দরজায় উৎসর্গকৃত পশুর রক্ত ছিটিয়ে রাখে। নববধূ এসব রক্ত ডিঙিয়ে ঘরে প্রবেশ করে অথবা পশুর রক্ত দিয়ে দরজার প্রবেশ পথ লেপন করে দেয়। আর এ কর্মটিকে পবিত্রতার জন্য জরুরি ভাবা হয়। পাঞ্জাবের সামাজিক রীতিতে দেখা যায়, নববধূ ঘরের দরজা ধরে দাড়াবে। শাশুড়ি পুত্রবধূকে এক গ্লাস পানি দিয়ে স্বাগত জানাবে।

এ সময় বরের আত্মীয়-স্বজনরা তাকে উপহার প্রদান করবে। তার প্রবেশ পথ তুলো দিয়ে বিছিয়ে দেয়া হবে এবং মেয়েটি বরের পরিবারের সদস্য হিসেবে পরিগণিত হবে। এখনো জার্মানির পার্বত্য এলাকা, ট্রান্সসেলভিয়া, মালয়শিয়া ও সিরিয়ার লোকজন ভ্রমণ ও ব্যবসায়িক কাজে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় দরজার চৌকাঠ মাড়িয়ে যাওয়াকে অশুভ জ্ঞান করে। গ্রিক বিজ্ঞানী পিথাগোরাসেরও বিশ্বাস ছিল অনুরূপ। তিনি বলতেন, যারা পা দিয়ে ঘরের চৌকাঠ মাড়ায়, তাদের উচিত আবার ঘরে প্রবেশ করা।

হিন্দু ধর্মমতে, দরজার চৌকাঠে বসা, দাড়িয়ে থাকা অথবা শিশুকে দুধ পান করানো অশুভ। ইসলাম ধর্ম মতে, বিসমিল্লাহ বলে ডান পায়ে ঘরে প্রবেশ করা উচিত এবং বিসমিল্লাহ বলে ভোরে ঘরের দরজা খোলা উচিত। জন হ্যাস্টিংস সম্পাদিত দি এনসাইকোপিডিয়া অফ রিলিজিয়ন অ্যান্ড ইথিকস মতে, অপশক্তির কুপ্রভাব ও জাদুটোনার প্রভাব নষ্ট করার জন্য এখনো বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ ঘরের দরজায় যেসব জিনিস ঝুলিয়ে রাখে, সেগুলোর মধ্যে লবণ, লোহা, ঘোড়ার নাল, তাবিজ, হাতের ছবি বা ছাপ, ক্রুশ চিহ্ন, স্বস্তিকা চিহ্ন, ধর্মীয় বাক্য, প্রতিমূর্তি ইত্যাদি প্রধান। এছাড়া পশ্চিম ও দক্ষিণ আফৃকা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ইনডিয়ার কয়েকটি অঙ্গরাজ্য, চায়নার পার্বত্যাঞ্চল ও তিব্বতে আত্মহত্যাকারী ও অপরাধী ব্যক্তির মৃতদেহ দরজা দিয়ে বের করার বিধান নেই। এ ক্ষেত্রে তারা জানালা অথবা দেয়াল কেটে মৃত দেহটি বের করে আনে।

স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও সৌন্দর্য চেতনার দিক থেকে দরজার আবেদনটি চিরন্তন ও বাস্তব। যুগের প্রেক্ষাপটে দরজা সম্পর্কিত কুসংস্কারের বৃত্ত সংকুচিত হবে ঠিকই কিন্তু দরজা ছাড়া ঘর কল্পনার সুযোগ অতীতে যেমন ছিল না বর্তমানেও নেই, ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।