আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আশরাফুলের গল্প



সময়কাল ৬ জুলাই, ২০১২। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে যাওয়ার সাথে সাথে বদলে গেছে অনেক কিছুই। বদলে গেছে ক্রিকেটার আশরাফুলের জীবনও। ভাবতে না পারা অনেক কিছুই ঘটে গেছে আশরাফুলের জীবনে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশ আইডল (ক্লোজআপ ওয়ান ২০০৬) সালমা আক্তারকে নিজের বউ হিসেবে পাওয়াটাকে নিজের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে হয় আশরাফুলের কাছে।

শেরাটন হোটেলের রুম-বারান্দায় বসে তারা-জলা আকাশের দিকে চেয়ে এ কথাই ভাবছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক আশরাফুল। বিয়ের পর প্রথম সিরিজ খেলার জন্যে তাকে দলের সাথে হোটেলে থাকতে হচ্ছে। অধিনায়কের বউ হিসেবে সালমাফুলও (বিয়ের পর সালমার নতুন নাম) তার সাথে থাকতে পারতেন, কিন্তু অন্যেরা কী ভাববে তা মনে করে আশরাফুল নিজেই রাজি হন নি। কাল সকালে খেলা বলে সবাই যার যার রুমে চলে গেছে। ঘুমাতে যাবার আগে আশরাফুল বউকে ফোন করলেন।

ফোন ধরলেন তার মা। - বাবা কেমন আছিস। ভাত খাইছিস? - হ মা, খাইছি। সমস্যা নাই। তোমরা খাইছো? - আমি তো খাইছিরে বাবা।

কিন্তু বউমা সারাদিন রোজা রাখছিল, ঠিকমত খাইতে পারে নাই। - রোজা রাখছিল! ক্যান? আশরাফুলের কণ্ঠে বিস্ময়। - ক্যান রোজা রাখছে তা বউমারে জিজ্ঞেস কর। কালকের খেলায় ভাল খেলার চেষ্টা করিস বাবা। নে বউমার সাথে কথা বল।

রোজা রাখার কারণ বার বার জানতে চাওয়ার পরও আশরাফুল কারণ জানতে ব্যর্থ হয়। সালমাফুলের একই কথা, রাখতে ইচ্ছে করল রাখলাম। কাল কিন্তু আমি খেলা দেখতে আসব। - তোমার আকাশি নীল শাড়িটা পরে এসো। আশরাফুল আবদার করে।

এক পর্যায়ে আশরাফুল জানতে চায়, রোজা রেখে আল্লাহর কাছে কি চাইছ? - কাল যেন আপনি ভাল খেলেন এ জন্যে রোজা রাখছি। আর একটা কথা। আমি ক্রিকেট ভাল বুঝিনে। তবে প্রথম চার ওভারে কোন ঝুঁকি নেবেন না। আর অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে খোঁচা মারলে মনে করবেন ব্যাট দিয়ে খোঁচাটা আমার মাথায় মারছেন।

আশরাফুল হতভম্ব। পাগলী এইটা কী কয়! তবে সে মনে মনে খুশিও হয়। বউটা তার ক্রিকেট ভালই বোঝে। সে বলে, ইচ্ছে করলেই কি কেউ ভাল খেলতে পারে? আপনি পারেন। বউটা তার ভাল খেলা দেখতে এত ইচ্ছুক - একথা ভেবে আশরাফুলের আর ঘুম আসে না।

এপাশ ওপাশ করতে থাকে। পরদিন। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ৪ ওভার শেষে বাংলাদেশ দলের রান ২ ঊইকেটে ১১। দলের এমন বিপর্যয়কর সময়ে আশরাফুল ব্যাটিংয়ে নামলেন। প্রথম বল অফ স্ট্যাম্পের এক ইঞ্চি বাইরে দিয়ে চলে গেল।

সাথে সাথে বোলারসহ শ্রীলংকার অন্য ফিল্ডাররা চেঁচিয়ে ওঠলেন। পরের তিন বলেও তিনি একইভাবে পরাস্ত হলেন। সবাই বুঝে গেছে আজ আশরাফুলের দিন নয়। শেষ বলে এক রান নিয়ে অন্য প্রান্তে এলেন তিনি। বোলার বল শুরু করার আগে ভিআইপি গ্যলারিতে নীল শাড়ির ওপর চোখ আটকে গেল আশরাফুলের।

নীল শাড়ীতে সালমাফুলকে একটা নীল পরীর মত দেখাচ্ছে। তার মনে পড়ল সালমার গতরাতের কথা। আশরাফুলকে নার্ভাস মনে করে বোলার প্রচণ্ড গতিতে বল ঠুকে দিলেন। আশরাফুল সজোরে মেরে বলটাকে সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। ইনিংসের প্রথম চার।

গ্যালারি জুড়ে তুমুল হাততালি। পরের বলে বোলারের পেছন দিয়ে বিশাল ছয়। গ্যালারির হইচই এর মধ্যে আশরাফুল দেখল তার নীল পরী উঠে দাঁড়িয়েছে। পরের বলে স্কুপ প্যাডেলে আবার চার। পরের দুই বল ঠেকিয়ে শেষ বলে সিংগেল নিলেন আশরাফুল।

পরের ওভারে অফ স্ট্যাম্পের বাইরের পাঁচটি বল ছেড়ে দিলেন তিনি। শেষ বলে নিশ্চিত দুই রানের জায়গায় এক রান নিয়ে জুটির অন্য ব্যাটসম্যানকে থামিয়ে দিলেন আশরাফুল। অন্য ব্যাটসম্যানতো আবাক। ওভারের মাঝখানে সে সাথের ব্যাটসম্যানকে ভিআইপি গ্যলারিতে বসা সালমাকে দেখাল। তখন এক রান নেয়ার কারণটা সাথের ব্যাটসম্যানের কাছেও পরিস্কার হল (আসলে যে প্রান্তে থাকলে সালমাকে দেখা যায়, সে প্রান্তে থাকা আশরাফুল বেশি পছন্দ করছিলেন)।

কোন ব্যাটসম্যান যখন ক্রিকেটের বলকে ফুটবলের আকারে দেখেন, তখন বিপক্ষ বোলারদের কিছুই করার থাকে না। আশরাফুল সেদিন হয়ে উঠলেন ব্যাট হাতে এক মারমূখী শিল্পি। পরিচিত সব শটের সাথে ক্রিকেট দুনিয়া পরিচিত হল আশরাফুলের এক নতুন শটের সাথে। নতুন সেই শটে একের পর এক চার মারলেন আশরাফুল। বাংলাদেশ দলের রান যখন ৩ উইকেটে ২০১, আশরাফুল তখন ১৭০ রানে অপরাজিত।

ঘরের মাঠে দরশকরা তখন উত্তেজনায় কাঁপছেন। সবার মনে একই প্রশ্ন, আশরাফুল কি পারবেন সাঈদ আনোয়ারের রেকর্ড ভাঙতে! ভাগ্য সব সময় সাহসীদের পাশে থাকে। ব্যক্তিগত ১৮৯ রানের সময়ে আশরাফুল ডাউন দ্য উইকেটে এসে তুলে মারলেন। অনেকে উত্তেজনা সামলাতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। তাদের বন্ধ চোখের সামনে দিয়ে বল গ্যালারিতে ঠাই নিল।

আশরাফুলের রান ১৯৫। ওয়ান ডে ক্রিকেটে নতুন রেকর্ড! সারা গ্যলারি জুড়ে অবিরাম পায়রার ডানার শব্দ। আশরাফুলের গর্বিত ব্যাট মাথার উপড়ে উঠল। সবার মনে তখন একটাই আশা, ২০০ রান কি হবে! আশরাফুলের মনে হল গ্যালারির সবার পড়নে নীল পোষাক। অথচ তা হওয়ার কোন কারণ নেই।

হঠাৎ আশরাফুলের মনে হল, আচ্ছা তার নীল পরী এখন কী ভাবছে? ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন তিনি। খেলা শুরুর প্রথম বলেই তিনি এলবিডব্লিউ হয়ে গেলেন। ব্যাট উঁচিয়ে গ্যালারিতে ফেরার সময় আফসোসে বুক ফেটে যাচ্ছিল আশরাফুলের । মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করলেন তিনি - হল না, নীল পরী। তোমার জন্যে দুই শ করতে চেয়েছিলাম, পারলাম না, ক্ষমা করে দিও।

বাংলাদেশের ৭ উইকেটে ৩৭৯ রানের জবাবে শ্রীলংকা ২৬৩ রানে গুটিয়ে গেলে বাংলাদেশ ১১৬ রানের জয় পায়। খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আতাহার আলী সাক্ষাতকার নিলেন আশরাফুলের। আতাহার আলী: কেমন লাগছে আশরাফুল? আশরাফুল: আল্লাহকে ধন্যবাদ। খুব ভাল লাগছে। দুইশ করতে চেয়েছিলাম।

যদিও পারি নি, তবুও আমি অনেক খুশি। অ--নে--ক ভাল লাগছে। আতাহার আলী: আচ্ছা, আপনি বারবার উইকেটের বিশেষ এক পাশে থাকতে চাচ্ছিলেন বলে মনে হচ্ছিল। কেন? আশরাফুল উত্তর না দিয়ে হাসলেন। আতাহার আলী: বিয়ের পর এটা আপনার প্রথম ইনিংস।

কিছু বলবেন? আশরাফুল: হ্যাঁ। এই ইনিংসটা আমি আমার বউ সালমাকে উপহার দিলাম। আসলে ও আমাকে বলেছিল ভাল খেলার জন্য। আতাহার আলী: আজ নতুন একটা শট খেললেন - আশরাফুল: হ্যাঁ। আসলে এই শটটা খেলার সময় একটা ব্যাপার ঘটেছে।

আমার বউয়ের একটা গান আছে, ও মোর বানিয়া বন্ধুরে...... এটা আমার খু--উ--ব প্রিয় গান। ব্যাট করার সময় যখনি বানিয়া শব্দটা মনে এসেছে তখনি এই শটটা খেলেছি। এই শটটাকে তাই বানিয়া শটও বলা যেতে পারে। আতাহার আলী: অন্যরা এই শট কীভাবে খেলবে? বিশেষ করে যাদের গায়িকা বউ নেই? আশরাফুল: কেন! সবাই বিয়ে করে ফেললেই তো বউ পাবে। কথাটা বলে ফেলেই আশরাফুল বুঝলেন যে কথাটা বলা ঠিক হয় নি।

তাই আবার বললেন, না মানে আমি বলছি যে আমার বউ আমাকে অনেক উৎসাহ দেয়। কথাটা হাসির হলেও কেউ তেমন হাসলেন না। কারণ, এইমাত্র যে কীর্তি তিনি করে এসেছেন তাতে তার মুখে সব কথাই মানিয়ে যায়। সন্ধ্যায় বিশেষ বিবেচনায় আশরাফুল বাসায় যাওয়ার অনুমতি পেলেন। বাসায় ঢুকতেই সালমাফুল বলে ওঠেন, শুভ জন্মদিন।

চমকে ওঠেন আশরাফুল। আজ যে তার জন্মদিন সে কথা মনেই ছিল না। হাজব্যান্ডকে একান্তে পেয়ে সালমা বলেন, আপনি সবার সামনে আমার গানের কথা বলতে গেলেন কেন? নীল পরী, তুমি বুঝবা না। এইটা হইল প্রেমের ব্যাপার। তোমার একটা গান আছে না, যে জন প্রেমের ভাব জানে না, তার সাথে নাই লেনা দেনা...... - ঠিক আছে, এতই যদি প্রেম বোঝেন তবে পরের ম্যাচে আর একটা নতুন শট খেলবেন, সেইটার নাম দেবেন লেনাদেনা শট।

আশরাফুল তার নীল পরীর কথায় হেসে ওঠে। হেসে ওঠে নীল পরীও।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.