(এটা আমার কন্যা প্রিয়মশ্বেতা'র জন্য। সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ইলেকট্রনিক্স'-র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী)
আমরা তখন কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করি। তার গালভরা নাম "নাম নেই"। আসলে "লিটল ম্যাগ" ।
নিজেদের পয়সা খরচ করে ছোট বড় সাহিত্যিকদের লেখা ছেপে বের করি । নিজেদের লেখাও ছাপি।
এমন একটা বাঙ্গালী সন্তান পাওয়া যাবে না যে ঐ বয়সে কবিতা লেখেনি । আমরাও লিখি । কেউ পড়ে কেউ পড়েনা ।
তবু পত্রিকা বের করি।
ঠিক সরস্বতী পূজোর আগে, "সারস্বত সংখ্যা" বের করি। পূজোর দেরী নেই। আমাদের পত্রিকা ছেপে রেডি । কিন্তু যতীনদা, প্রেসের মালিক বলেছে আগাম পয়সা না দিলে পত্রিকা দেবেনা।
অনেক টাকা বাকী। আমরা বললাম, পত্রিকাগুলো দিয়ে দিন, বিজ্ঞাপণের টাকা উঠে গেলে পয়সা পেয়ে যাবেন। যতীনদার "না" তো "না"।
রাজাদা খবর নিতে এলো - তোদের পত্রিকা কদ্দুর ।
সে এবার ফুটবলের ওপর একটা লেখা দিয়েছে ।
রাজাদার নামটাই, আসলে আমিই লিখে দিয়েছি । কারন রাজাদা আমাদের অনেক বিজ্ঞাপণ তুলে দিয়েছে। সে আবার ফুটবল জগতের লোক। নানান মহলে প্রভাব প্রতিপত্তি আছে ।
আমরা বললাম, যতীনদা দিচ্ছেনা, অনেক পয়সা পাবে।
আগাম পয়সা ছাড়া দেবেনা ।
আমরা আশায় বুক বাঁধি, বোধহয় রাজাদার কথায় যতীনদা পত্রিকাগুলো দিয়েও দিতে পারে।
যতীনদার সঙ্গে রাজাদার কি কথা হোল কে জানে, শুধু আমাদের বললো, আজ সন্ধ্যেয় তৈরী হয়ে আসবি, একটু বেরবো ।
আমরা রাজাদার কথামতো সবাই তৈরী হয়েই এলাম। রাজাদা যতীনদার কাছ থেকে একটা চাঁদার বিল বই নিয়ে - আমাদের বললো চল।
আমরা এর ওর মুখ দেখছি, কিন্তু রাজাদার পেছনে পেছনে চললাম ।
প্রথমেই এক বড় ঠিকাদার আশুলাল-এর গদিতে গিয়ে হাজির। আশুলাল রাজাদাকে দেখে কেমন যেন হয়ে গেল - আরে রাজাবাবু যে, আসিয়েন আসিয়েন, কি খোবর রাজাবাবু ?
পাড়ার এই ছেলেগুলো এবার একটু ধুমধাম করে সরস্বতী পূজো করবে । চাঁদা চাইযে। সামান্য দিলেই হয়ে যাবে - এই ধরুন পাঁচশো টাকা ।
আশুলাল সারোগী জাত মাড়োয়ারী, টাকাটা দিয়ে দিল। আমরা কথা না বাড়িয়ে রাজাদার পরের টার্গেটের দিকে চললাম ।
পরের টার্গেট হাজারীলাল । সেও মাড়োয়ারী। এখানেও পাঁচশো।
আমাদের প্রায় ভ্যাবাচ্যাকা খাবার অবস্থা।
তৃতীয় বধ এক সোনার বন্ধকী কারবারী, এও মাড়োয়ারী। এখানে এক হাজার। আমদের শুধু খাবী খেতে বাকী। রাজাদা করে কি।
শেষকালে ফেঁসে যাবোনাতো । সরস্বতী পূজোয় এত চাঁদা কেউ দেয়?
রাজাদা বললো, দূর দূর, ফাঁসবি কিরে, দেখছিস না, মাড়োয়ারীগুলো চাঁদা দিতে পারলে বাঁচে ।
চথুর্থ টার্গেটের সময় আমি একটু বললাম,রাজাদা একটু রয়ে সয়ে চাঁদা চাইলে হয়না? মানে সরস্বতী পূজোতে এত চাঁদা -
রাজাদা আমার কথা কেড়ে নিয়ে বললো - দাড়া, দাড়া, তোদের একটা বড় ফান্ড তৈরী করে দেবো যাতে তোদের পত্রিকার পরের সংখ্যাগুলো বের করতে কোনো অসুবিধা না হয়। কারন পরের সংখ্যাগুলোতেও আমার লেখা থাকবে। ধারাবাহিক লেখা।
আমি বললাম - তুমি কি নিয়ে লিখবে - রাজাদা ?
লিখবো মানে, লিখবিতো তুই - সে তুই যা লিখবি।
মানে তোমার নামে ?
থামতো, তুই বড় কথা বলিস - স্বপন,আমাদের পত্রিকার সম্পাদক আমাকে থামিয়ে দিলো।
চতুর্থ জন - গদ গদ সুরে রাজাদাকে আপ্যায়ণ করে একদম কেথার্থ হয়ে গেল। রাজাদা বললেই তো চাঁদাটা বাড়ীতে পৌছে দিয়ে আসতো । এতো কষ্ট করে আসবার কি দরকার ছিলো? না মানে ছেলেগুলো ধরলো, তাই আসা, না হলে রাজাদা কি আসে? এখানেও হাজার টাকা ।
এও মাড়োয়ারী, ট্রান্সপোর্টের ব্যাবসা ।
রাজাদা কি করে এত টাকা তুলছেরে, রহস্যটা কি? শুভেন্দু খুব আস্তে আস্তে আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
জানিসতো আমার ধারনা – আনোয়ার কিছু বলার আগেই স্বপন তাকে থামিয়ে দিল।
যতীনদা কত পাবে? - খুব গম্ভীর ভাবে রাজাদা শুধোয়।
দু-হাজার হলেই হবে - আমি বললাম - হয়ে গেছে ।
তুই থামবি? - স্বপন বললো।
রাজাদার পঞ্চম বধ খেলার সাজ সরঞ্জামের কারবারী। রাজাদা তার দোকানে নিজে চাঁদা চাইতে এসেছে দেখে সে তো প্রায় কেঁদেই ফেলে। রাজাদা এখানে দু'হাজারেই সন্তুষ্ট।
এবার আমার ভয় হতো শুরু হ'ল, কিজানি এরা থানায় ফোন টোন করে যদি আমাদের ধরিয়ে দেয়? যাকগে, রাজাদাই সঙ্গে আছে, আমাদের ভয় কিসের?
পূজোটা আমরা করিনি, কিন্তু পূজোর প্রসাদ দিয়েছিলাম ।
কাজু, পেস্তা সব দিয়ে সাজিয়ে একটা জম্পেশ প্যাকেট সবাইকে দিয়েছিলাম। সবাই খুব খুশি হয়েছিল।
আমাদের শারদ সংখ্যা পত্রিকা বের করতে বেগ পেতে হয়নি। পত্রিকার প্রচ্ছদটা সত্যজিৎ রায় করে দিয়েছিলেন। উদ্দোগটা অবশ্য রাজাদাই নিয়েছিল।
রাজাদারও একটা লেখা বের হয়েছিলো।
কিন্তু রাজাদার গোপন রহস্যটা আজও আমাদের কাছে রহস্যই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।