সাভারে রানা প্লাজা ধসে মৃতের সংখ্যা কত দাঁড়াল বা দাঁড়াবে? কংক্রিটের স্তূপের নিচে আর কেউ বেঁচে আছেন—এমন আর আশা নেই। যদি কেউ থেকে থাকেন, তা আমাদের বিস্ময়কেই বাড়াবে। ‘দ্বিতীয় পর্যায়ের’ উদ্ধার অভিযান হিসেবে যা চলছে, তাতে হয়তো আরও কিছু লাশের সংখ্যাই বাড়বে। শেষ পর্যন্ত যতগুলো লাশ উদ্ধার হবে, সেই সংখ্যাই কি এই ভবনধসে মৃতের সংখ্যা?
রানা প্লাজায় যে পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল, বিজিএমইএর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সেখানে শ্রমিকের সংখ্যা ছিল তিন হাজার ১২২ জন। গত সোমবার বিকেলে আইএসপিআর সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানিয়েছে, এ পর্যন্ত দুই হাজার ৪৩৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে আর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে ৩৮৫ জনের।
মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত তা দাঁড়ায় ৩৮৭ জনে। এই দুটি সংখ্যা যোগ করলে দাঁড়ায় দুই হাজার ৮২৪ জনে। ফলে সাধারণ হিসাবটি হচ্ছে, আরও ২৯৮ জনের কোনো খোঁজ নেই। বিজিএমইএ শ্রমিকদের যে সংখ্যাটি দিয়েছে, তার ভিত্তি বা বিশ্বাসযোগ্যতা কতটুকু? খোঁজ নিয়ে জানলাম, গত ফেব্রুয়ারি মাসে শ্রমিকদের বিমা করার জন্য কারখানাগুলো শ্রমিকদের যে সংখ্যা বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়েছে, সেটাই হচ্ছে এর ভিত্তি। শ্রমিকের আসল সংখ্যা দিয়ে কারখানাগুলো বিমার প্রিমিয়াম দিয়েছে, এটা বিশ্বাস করা কঠিন।
আর যদি এটাই কারখানাগুলোর প্রকৃত শ্রমিকের সংখ্যা হয়ে থাকে, তবে ভবনধসের দিন যে সব শ্রমিকই উপস্থিত ছিলেন, তা না-ও হতে পারে। মূল কথা হচ্ছে, কারখানাটিতে ভবনধসের সময় তিন হাজার ১২২ জন শ্রমিক উপস্থিত থাকার বিষয়টি কোনোভাবেই আসল সংখ্যা নয়। আর এই শ্রমিকদের বাইরে ভবনধসের সময় কি নানা কারণে কেউ ছিলেন না এত বড় ভবনে?
নিখোঁজ লোকের সংখ্যাই বা কত? ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, সোমবার দুপুর পর্যন্ত ১০০ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তথ্য তাঁরা পেয়েছেন। অন্যদিকে স্বজনদের যাঁরা খোঁজাখুঁজি করছেন, অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে যাঁরা নাম ও ছবি নিয়ে মাতম করছেন, তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাভার থানার এসআই মো. মোস্তফা বলেছেন, নিখোঁজ লোকের সংখ্যা এক হাজার ২০০ জন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাব নিখোঁজ ব্যক্তিদের যে তালিকা করেছে, তাতে এ সংখ্যা এক হাজার ৩৫০ জন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের দেওয়া সংখ্যাটিকে যদি সরকারি তথ্য ধরে নিই, তবে বাকি দুটি তথ্যের সঙ্গে হিসাবের গরমিলটি হচ্ছে হাজারের ওপর।
উদ্ধার করা ৩৮৭টি লাশের মধ্যে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ৪৭টির পরিচয় পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ লোকের সংখ্যা থেকে এই ৪৭ জনকে বাদ দিলেও নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা হাজারের ওপরেই থাকে। রানা প্লাজা ধসে মৃতের সংখ্যা তবে কত দাঁড়ায়? শেষ পর্যন্ত এই ভবনধস ঠিক কত জনের প্রাণ নিয়েছে, সেই সংখ্যাটি কি আমরা কোনো দিন জানতে পারব? সংখ্যার হিসাবে আমরা যে বড়ই কাঁচা। আর শ্রমিকদের মৃতের সংখ্যা হলে তো কথাই নেই! গত বছরের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লাগার ঘটনায় মৃতের একটি ‘অফিশিয়াল’ সংখ্যা নির্ধারিত হয়ে গেছে, সংখ্যাটি ১১১।
‘অ্যাকটিভিস্ট নৃবিজ্ঞানী’ নামের একটি সংগঠনের তিন গবেষক (সায়দিয়া গুলরুখ, পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা; মাহমুদুল সুমন, শিক্ষক নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও নাজনীন শিফা, গবেষক) তাজরীন ফ্যাশনসের ঘটনার পর তথ্য সংগ্রহ করে নিশ্চিত হয়েছেন যে এ দুর্ঘটনার পর অন্তত ২৫ জন শ্রমিকের পরিবার তাদের স্বজনের সন্ধান পায়নি। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে গবেষক দলটি এ তথ্য সংগ্রহ করে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও কারখানার পরিচয়পত্রও তারা সংগ্রহ করেছে। লাশ গুম, এক প্যাকেটে একাধিক লাশ—এমন কত অভিযোগ। রানা প্লাজার ঘটনায় এ রকম কত জন শেষ পর্যন্ত নিখোঁজ হিসেবেই থেকে যাবেন, কে জানে!
বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে শোচনীয় ১০ ভবনধসের একটি তালিকা অনলাইনে গেলে যে কেউই পাবেন।
সেখানে তালিকার শীর্ষে রয়েছে টুইন টাওয়ার ধসের ঘটনা। টুইন টাওয়ার এমনি ধসে পড়েনি, এটিকে ধসানো হয়েছে। প্রাণহানি ও ভয়াবহতার দিক দিয়ে টুইন টাওয়ার ধসের ঘটনাটি ইতিহাসে অনন্য। টুইন টাওয়ারের বিষয়টি বাদ দিলে যে ভবনধস সবচেয়ে শোচনীয় হিসেবে বিবেচিত, তা হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে স্যামপং ডিপার্টমেন্ট স্টোর ধসের ঘটনা। ১৯৯৫ সালের ২৯ জুন এই ধসের ঘটনায় প্রাণ হারান ৫০২ জন।
আর আহত হন ৯৩৭ জন। তালিকায় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে আরও আটটি ভয়াবহ ভবনধসের ঘটনা রয়েছে। রয়েছে ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ঘটে যাওয়া ভবনধসের ঘটনাও, যে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬৭ জন। গত বছরের ২৬ জানুয়ারি ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে ভবনধস এবং ১৭ জনের প্রাণহানির ঘটনাটিও রয়েছে সেই তালিকায়। তবে সেই তালিকায় নেই ২০০৫ সালে এই সাভারেই ঘটে যাওয়া স্পেকট্রাম গার্মেন্টসের ভবনধসের ঘটনা, যেখানে প্রাণ হারিয়েছেন ‘সরকারি’ হিসাবেই ৬৮ জন অথবা ২০০৬ সালে তেজগাঁওয়ে ফিনিক্স গার্মেন্টস ধস ও ২১ জনের মারা যাওয়ার ঘটনাটি।
বাংলাদেশের ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষায় মরিয়া বিজিএমইএর সভাপতিকে বলছি, গণমাধ্যম বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারল কই? স্পেকট্রাম ও ফিনিক্সের ঘটনা তো তালিকায় জায়গা পায়নি! তবে বিজিএমইএর সভাপতি যতই চেষ্টা করুন, এবার মনে হয় দেশের ভাবমূর্তি আর বাঁচানো যাবে না। এখন পর্যন্ত ৩৮৭টি লাশ আর হাজার খানেকের ওপর নিখোঁজ নিয়ে টুইন টাওয়ারের পর এ ঘটনাটিই সম্ভবত সবচেয়ে শোচনীয় ভবনধসের ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পেতে যাচ্ছে।
আজ থেকে ঠিক ১০০ বছরের বেশি সময় আগে, ১৯১১ সালে নিউইয়র্কে একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগেছিল। ২৫ মার্চের ওই দুর্ঘটনা ইতিহাসে ট্রায়াঙ্গেল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরি অগ্নিকাণ্ড হিসেবে পরিচিতি। আজ বাংলাদেশে পোশাক কারখানাগুলোর যে দশা, তখন সেই একই দশা ছিল সেখানে।
শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী। আগুন লেগেছিল কারখানাটির ৮, ৯ ও ১০ তলায়। চুরি বা মালামাল সরানো ঠেকাতে তখনো মালিক ফ্লোরগুলো তালা দিয়ে রেখেছিলেন। আগুনে পুড়ে এবং ওপর থেকে লাফ দিয়ে ওই দুর্ঘটনায় মারা পড়েছিলেন ১৪৬ জন। সবাইকে শনাক্ত করা গেলেও ছয়জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
বেওয়ারিশ ওই ছয়জনকে কবর দেওয়া হয়েছিল একই সমাধিতে, সেখানে বানানো হয়েছিল সৌধ। দীর্ঘদিন তাঁরা অজ্ঞাতপরিচয়ের শ্রমিক হিসেবেই থেকে গেছেন। ঠিক ১০০ বছর পর ২০১১ সালে এই অজ্ঞাতনামা শ্রমিকদের পরিচয়ের বিষয়টি নিষ্পত্তি করেন এক গবেষক। ছয়জনেরই নাম-পরিচয় প্রকাশ পায় ১০০ বছর পর। সেই ভবনটি এখনো আছে।
নিউইয়র্ক ল্যান্ডমার্ক প্রিজারভেশন ফাউন্ডেশন এই ভবনটিকে ঘোষণা করেছে শহরটির ‘হেরিটেজ’ হিসেবে। শ্রমিকদের আত্মত্যাগের কথা লেখা আছে ভবনের সামনের ফলকে।
ছয় শ্রমিকের আত্মত্যাগের দায় মেটাতে যেখানে শত বছর পরও তাঁদের পরিচয় খুঁজে বের করা হয়, তখন আমরা আসলে কোথায়? শত বছরেরও বেশি সময় পিছিয়ে। এই ডিএনএ, কম্পিউটারের যুগেও আমরা সংখ্যাই মেলাতে পারছি না। ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় আমরা তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি বা ফেলছি।
আমরা খুব সাধারণভাবে সংখ্যাটি এক শ, না এক হাজার বা এক শ, না এক হাজার ৩০০ এমন আলোচনা করে যাচ্ছি। আমাদের বিবেচনায় হয়তো কাজ করছে না যে পার্থক্যগুলোই হচ্ছে ৯০০ বা এক হাজার ২০০ এবং তা মানুষের সংখ্যা, মৃত অথবা নিখোঁজ মানুষের সংখ্যা!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।