দুঃখটাকে দিলাম ছুটি, আসবে না ফিরে
খুব সকালে হলিসিটিতে চড়ে প্রায় ৩০/৩৫ জনের একটি গ্রুপ দুইদিনের সিলেট সফরে বের হল। আমাকে যাওয়ার জন্য ধরল। কিন্তু কি করব, ইচ্ছা থাকলেও যে যেতে পারলাম না। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ঐদিনই থিসিসের প্রেজেনটশনের দিন ছিল।
হঠাতই দুপুরের দিকে লোকমান ভাই বললেন চলেন সিলেট থেকে ঘুরে আসি।
উনিও আমার মত কোন এক কারণে যেতে পারেন নি। রাজী হয়ে গেলাম। উনাকে সাথে নিয়ে আরামবাগে শ্যামলীর বিসনেস ক্লাসে দুটি টিকেট কেটে নিলাম। পরে সঙ্গী আরেকজন জুটল, জাহিদ ভাই। ঠিক রাত ১২টায় গাড়ী ছেড়ে দিল সিলেটের উদ্দেশ্যে।
ভোরের দিকে সিলেটে পৌঁছলাম। সেখান থেকে চলে গেলাম সোজা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওখানে আগেই যাওয়া গ্রুপটির সাথে মিলিত হলাম। ফজরের নামাজটা পড়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশটা ঘুরলাম। খুব ভাল লাগল।
কি সুন্দর প্রকৃতি। আশপাশে উঁচু নিচু টিলা, দুরে বড় বড় পাহাড় দেখা যায়। শহীদ মিনারটাও বেশ উঁচুতে। চমৎকার প্রকৃতি আর সুন্দর সব কথামালায় আমরা চারজন বেশ ভাল সময় কাটালাম। গ্রুপের বাকীরা তখনও ঘুমিয়ে।
প্লান মোতাবেক সকালের নাস্তা সেরে রওনা দিলাম মাধবকুন্ডুর উদ্দেশ্যে। একই গাড়িতে নিজেদের এতগুলো লোক, সে এক অন্য রকম মজা। মাঝে একবার যাত্রা বিরতি। স্থানীয়দের সাথে কথা বললাম, বেশিরভাগ কথাই বুঝলাম না। অবশেষে পৌঁছলাম মাধবকুন্ড জলপ্রপাত।
বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়। রাস্তার শেষ মাথায় আবিস্কার করলাম সদা প্রবাহিত ঝর্ণাধারাটি। বেশ পরিচিতই লাগল। কারণ এর থেকেও অনেক বড় বড় ঝরনার দৃশ্য দেখেছি ফটোতে বা টিভির পর্দায়।
আমাদের সাথে সিলেটের দুজন গাইড ছিলেন।
বারবার তারা সতর্ক করে দিচ্ছিলেন পাহাড়ে না উঠতে, বিশেষ করে ঝরনার উৎস খোঁজার দিকে মনোযোগ না দিতে কারণ পাহাড় বেশ খাড়া সাথে সাথে বিপজ্জনকও, উঠতে গিয়ে পড়ে মারা যাওয়ারও রেকর্ড আছে।
তাদের বারণই আগ্রহ বাড়িয়ে দিল। অনেকেই পাহাড়ে উঠতে চাই, অন্তত যেখান থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে সেই মাথায় যেতে চাই। সিদ্ধান্ত নিলাম উপরে উঠব, তবে অবশ্যই সতর্কতার সাথে। জুতা খুলে হাতে নিলাম, পাহাড় পিছলা তাই।
অনেকে দেখলাম জুতা রেখে এসেছে হাতে নিয়েছে শক্ত লাঠি। আমার সেরকম কিছু ছিল না। এক হাত খালি অন্য হাতে এক জোড়া জুতা। উপরে উঠে বেশ কয়েকটা ডেঞ্জারাস জোন পেলাম। কিছুটা ভয়ও লাগছিল, সাহস করে উঠে গেলাম।
জুতা এক জায়গায় রেখে দিলাম, জুতা হাতে রিস্ক বেশি।
একদম মাথায় উঠে, সে অন্য রকম আনন্দ। নিচের মানুষগুলোকে কত ছোট দেখায়। ছবি তুললাম একদম কিনারে গিয়ে। অযু করলাম, কিনারে বসে নামাজ পড়ব বলে মনস্থির করেছি এমন সময় জুবায়ের ভাই বললেন, প্যান্টে কাদা থাকলে নামাজ হবে না।
তিনি পড়তে দিলেন না। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। যাই হোক ফেরার পালা। খানিকদুর এসে দেখি আমার চশমা নেই। অযু করতে গিয়ে ওখানে রেখেছি আর উঠাতে মনে নেই।
কি আর করা, ওখানে যারা ছিল তাদের বললাম খুঁজে দেখতে, কিন্তু পাওয়া গেল না।
উঠার চেয়ে নামা আরও রিস্কি। ফিরতি পথে দেখলাম, জুতা জায়গা মতই আছে। আবারও এক হাতে জুতা নিয়ে নামা শুরু করলাম। এক জায়গায় এসে, যেটা উঠার সময় ভয়ঙ্কর মনে হয়েছিল, নামার সময় আরও ভয়ঙ্কর মনে হল।
জুতা জোড়া আগে থ্রো করলাম। তারপর আমি ধীরে ধীরে পার হলাম, আর স্বতস্ফুর্তভাবে আল্লাহু আকবার ধ্বনি বেরিয়ে আসল। একটি জুতা পেলাম। খুঁজাখুঁজির পর আবিস্কার করলাম অপর জুতাটি পাহাড় গড়িয়ে বেশ কিছুটা নিচে নেমে গেছে। হাত দিয়ে উঠানো যাচ্ছে না।
সবাই আমাকে বকাঝকা শুরু করল। আপনার কোন বুদ্ধি জ্ঞান আছে? এভাবে জুতা সামনে থ্রো করার কি দরকার! আমার অসহায় জবাব, জুতাসহ আমি পড়ে গেলে সেটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হত?
শেষে ঠিক করলাম এই জুতা নিয়েই তবে ফিরব। একজনকে বললাম, আমি নিচে নামছি শুধু আপনি আমার হাতটা শক্ত করে ধরবেন। বাকী দুই তিনজন উনার মাজা ধরল। আমি ঝুলে থাকা অবস্থায় বাম পা দিয়ে জুতা উঠানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সেটা আরেকটু নিচে নেমে গেল।
এখন আর পা দিয়ে হাতে পাওয়া যাচ্ছে না। সাহস করে আরেকটু নিচে নেমে গিয়ে বাম হাত দিয়ে জুতা উঠিয়ে নিয়ে আসলাম। আল্লাহু আকবার! মিশন সাকসেসফুল!
এক বুক ভাল লাগা অনুভূতি নিয়ে নিচে নামলাম। ঝরণার পানিতে গোসল করলাম। যেই নেমেছি, আর চতুর্দিক থেকে অন্যরা মুহুর্মহু পানির ছিটা দিতে লাগল।
থামার কোন লক্ষণ নেই। সাথে সাথে একটু দুরে গিয়ে ডুব দিলাম। পরে জানলাম এভাবেই তারা পানিতে নামা লোকদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে। নানান রকম খেলায় মেতে উঠলাম। হেলালের দেহ ভারী, কিন্তু সাঁতার জানে না।
আমরা যখন সবাই উঠে এসেছি, সে আর দুয়েকজনকে নিয়ে নিচেই ছিল। হঠাৎ শুনলাম হেলাল ডুবে যাচ্ছে। কেবল হাত নাড়ছে, এক্ষুনি ডুবে যাবে। জুবায়ের ভাই লাফ দিলেন, পাশে সুইমের সহায়তায় হেলাল রক্ষা পেল। উঠে তার সশ্রুষা করা হল।
আল্লাহ পাক হেলালকে রক্ষা করেছেন। তা না হলে ঘটনা অন্য রকম হতে পারত।
যাই হোক, এক বুক প্রশান্তি নিয়ে ফিরে এলাম সিলেট। অতপর ঢাকা। পাহাড়ে উঠার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, সত্যিই দারুণ মজা পেয়েছি।
শুধু ঝরনা দেখার মধ্যে এত মজা নেই। গতকালের পেপারে দেখলাম মাধবকুন্ডে ডুবে এক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যু। মনটা খারাপ হয়ে গেল। যারা যাবেন তাদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, অবশ্যই জুতা পায়ে পাহাড়ে উঠবেন না। আর গোসলের সময় ঝরনার কাছাকাছি জোনটাতে যাবেন না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।