আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডাক্তারদের করুণ গল্প

জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।

সিডনীতে এসে প্রথম উঠেছিলাম ওয়েস্টমিডে, তারপরে হোমবুশে। দুই জায়গাতেই বাঙালী ডাক্তাররা গিজ গিজ করছেন। দু:খজনক হলো, এদের কারোই তখন চাকরী ছিল না। ঢাকা মেডিকেল থেকে বের হওয়া খুব মেধাবী এক একজন ইরান, মধ্যপ্রাচ্যে কয়েক বছর চাকরি করে অস্ট্রেলিয়ায় এসে আবিষ্কার করলেন, ডাক্তারদের ক্ষেত্রে বিদেশী যোগ্যতা অস্ট্রেলিয়ার সরকার মানে না।

ডাক্তারদের মাথায় হাত! বিদেশের মোহ কেটে যেতে সময় লাগে নি বেশি, কাগজ বিলি করে বা ট্যাক্সি চালিয়ে সংসার চালাতে গিয়ে। এসব সবাই করে তাই ওরকম খারাপ লাগা না থাকলেও স্বপ্নভঙ্গের খুব বড় ধাক্কা তো ছিলই। এত গুলো বছর এত কষ্ট করে মেডিকেলে পড়ে কেউ বাকি সারাটা জীবন কাগজ বিলির স্বপ্ন দেখতে পারে? মাত্র বছর পাঁচেক আগে বিদেশে ডাক্তারী পাশ করা ডাক্তারদের জন্য বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় 'ডাক্তার' হিসেবে প্র্যাকটিস করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বছর পাঁচেক আগের কথা, তাই আমি যখন এসেছি, তখনও ডাক্তাররা সেই কাগজ বিলি অবস্থাতেই। এক একজন ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেমেয়ের সাথে গলা মিলিয়ে ধুমসে পড়ছেন, পরীক্ষায় পাশ করার জন্য।

আবার ডাক্তার হয়ে ওঠার জন্য। তখন বেশ মর্মান্তিক কিছু গল্প শুনেছি। যেটা আমাকে খুব কাঁদিয়েছে তা এক ডাক্তার আংকেলকে ঘিরে। ইরান থেকে আসার পরে সুদীর্ঘ সাত বছর ডাক্তারের সম্মান পান নি। তখন এখানে সেখানে কাজের সীমিত আয়ে সংসার চলতো।

একটা ভাল খাট পর্যন্ত কিনেন নি, গ্যারেজ সেইলে কেনা তোষকে ঘুমাতেন। বুড়ো বয়সে খুব কষ্ট করে পড়ে পাশ করলেন পরীক্ষায়। সুখের মুখ দেখবেন বলে স্বপ্ন দেখছেন, তখন হঠাৎই ধরা পড়ল ক্যান্সার। একদিনও চাকরি করার সুযোগ পান নি। তার আগেই মারা গেলেন।

ডাক্তার তাই জানতেন সময় বেশি নেই। শেষ দিনগুলোতে নাকি কোন কথা বলতেন না, খালি কাঁদতেন আর মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে থাকতেন। একটা লম্বা সময়ে মেয়েকে কোলে নেয়ার সময় পান নি একদম, তাই। চাকরী আর উপার্জনের ধান্দা, স্বপ্নভংগের তীব্র মন খারাপ নিয়ে, 'আরেকটু ভালো' থাকার ইচ্ছার পিছনে ছুটে বেড়িয়েছেন মেয়ের চেহারা ভুলে গিয়ে... এখন ডাক্তার আংকেল, আন্টিরা বেশ ভাল আছেন। সবাই রেজিস্টারড ডাক্তার।

পাঁচ বছর আগের সেই সময়টা, যখন গ্যারাজ সেইল থেকে দুই ডলারে টোস্টার কিনতেন, সেই মানুষগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না বাড়ির মালিক মালিকিনীদের মাঝে। ভালো লাগে খুব, আমরা কষ্টের অতীত খুব দ্রুত ভুলে যেতে পারে--এ অনেক বড় দয়া স্রষ্টার! ডাক্তারদের কথা নতুন করে মনে পড়ছে আমার ছাত্রীর মাকে দেখে। চাইনীজ মহিলা। ডাক্তার ছিলেন তো ছিলেন, বিশেষজ্ঞ ছিলেন 'নিউরলজি'র। তারমানে অন্তত: দশ বছরের হাড় ভাঙা খাটুনীযুক্ত পড়াশোনা।

চাকরীও করেছেন অনেক দিন। এদেশে এসে সেসব ছেড়ে নিউরোসাইন্সের উপর পিএইচডি করছেন আবার। ওটা খারাপ কিছু না, তবে নিউরোলজিস্টদের মাসিক উপার্জন আকাশ ছোঁয়া, সেই তুলনায় পিএইচডি ফকিরা। এর উপর,আমাকে গত দু'সপ্তায় আমাকে দু' দু'টো কাঠ খোট্টা বিশাল বিশাল শব্দে ভরা জার্নাল আর্টিকেল দিলেন সহজ ইংরেজিতে সারসংক্ষেপ করে দেয়ার জন্য! আমি বলি, দেখ আমি মোটে সেকেন্ড ইয়ারে। এগুলা তো কিছুই বুঝি না।

তিনি খুব পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ঘন্টায় বিশ ডলার করে দিবে, আমার যত সময় লাগে লাগুক। শুধু ইংরেজিটাতেই সমস্যা। খুব সমস্যায় পড়েছেন, বুঝতে পারছেন না কিছুতেই। অগত্যা, নিয়ে আসলাম। মাত্র ইমেইল করে দিলাম সারসংক্ষেপ।

দুই ঘন্টা মানে চল্লিশ ডলার--আমার কাছে টাকাটা বেশ ভালো। অথচ হিসাবটা করে ভালো লাগার মধ্যেও কি যেন খচ খচ করছে। কত প্রচ্ছন্ন অবিচার হয় এই পৃথিবীতে!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.