সময়... অনাদি... হতে... অনন্তের... পথে...
বিগত বিএনপি-জামায়াত-জোট সরকারের সময় রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তô হয়। সাম্রাজ্যবাদ ও বিদেশী বহুজাতিক কর্পোরেশনের স্বার্থ রক্ষা করার প্রয়োজনে জাতীয় স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্তô করে মুক্তবাজার অর্থনীতির অনুসরণ; বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে চূড়ান্তô আত্সমর্পন এবং তাদের নির্দেশনা, শত, খবরদারী ও পরামর্শ মানতে গিয়ে কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচীর অধীনে রূপালী ব্যাংককে ইতিমধ্যেই বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আইএমএফের শর্ত ছিল রূপালী ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে না দিলে পিআরজিএফের আওতায় পঞ্চম কিস্তির অর্থ তারা ছাড় দেবে না। অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক যেমন সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংককেও বেসরকারিকরণের জন্য প্রকল্প গৃহীত হয় বিগত বিএনপি-জামায়াত-জোট সরকারের আমলে। জনগণের প্রবল প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্তô বিগত বিএনপি-জামায়াত-জোট সরকার ব্যাংক বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়া স্থগিত রাখে।
বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেসরকারিকরণের পক্ষে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়, তা আসলে কুযুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা শিটা, স্বাস্থ্য, রেলওয়ে, কলকারখানা, ব্যাংক, বিমানবন্দর ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে একই যুক্তি। বলা হচ্ছে, এসব প্রতিষ্ঠান বা খাত অদ, দুর্নীতিগ্রস্তô, লোকসানি প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি। ফলে বেসরকারিকরণই যেন একমাত্র সমাধান। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে সীমাহীন দুর্নীতি ও গাফিলতি যে রয়েছে এ কথা সত্যি; যা দিন দিন সেবার মানকে নষ্ট করেছে।
কিন্তু তাই বলে ঢালাওভাবে ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি কর্পোরেট সেক্টরে ছেড়ে দিতে হবে এমন তো নয়। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতেও দুর্নীতি ও অদতার নজির রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি ব্যাংকগুলোতে দক্ষ জনবল নিয়োগ, উপযুক্ত পারিশ্রমিক, দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া, প্রশিক্ষণ, নজরদারি ও মূল্যায়নের ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে বেসরকারি খাতে এগুলো ছেড়ে দিতে হতো না। এছাড়া এটা কি সরকারের ব্যর্থতা যে, সরকার এসবের বিরুদ্ধে বিধিব্যবস্থা নিতে পারে না। ব্যাংকগুলোর অদক্ষতা মানেই তো সরকারের অদক্ষতা।
একে একে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি ও অন্যান্য জনসেবা খাত যেভাবে দাতাদের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, গরিব জনগণের পক্ষে সেসব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ বা নাগরিক হিসেবে যেসব সেবা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনগণের পাওয়ার কথা সেসব সেবা পাওয়া কোনোদিনই সম্ভব হবে না। কেবল ধনী ও বিত্তবানরা ভোগ-দখল করবে এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর এ দেশের অধিকাংশ মানুষ যারা গরিব, দিনমজুর, চাষাভূষা, শ্রমিক, কৃষক-তেমজুর-দিন আনে দিন খায় তাদের সামর্থø থাকবে না কোনো। তারা ক্রমাগত বঞ্চিত হবে শিক্ষা থেকে, স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে, হয়তো তাদেরও এক বোতল পানি খেতে হবে ভাতের পরিবর্তে। আর না হয় খালবিল, পুকুরের দুর্গন্ধযুক্ত পানি খেয়ে বাঁচা-মরার লড়াই করতে হবে; কিন্তু এসব মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব আছে, রাষ্ট্রের উদাসীনতা দেশ ও জনগণকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে, এ কথা তো আমাদের ভূলে গেলে চলবে না।
সরকার ব্যাংকিং খাত সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের চাপে। তথাকথিত অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়নের নামে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন প্রকল্প। ব্যাংকিং খাতে সংস্কার প্রকল্পটির নাম হচ্ছে ‘শিল্প উন্নয়ন ও ব্যাংক আধুনিকীকরণ প্রকল্প’। তাছাড়া সরকারের হাতে আরেকটি প্রকল্প রয়েছে ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীকরণ প্রকল্প’ নামে। প্রথম প্রকল্পে ঋণের পরিমাণ ৩৮ কোটি ৮৩ লাখ ৯০ হাজার ডলার এবং পরেরটির জন্য রয়েছে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
এ ক্ষেত্রে দাতাদের শর্ত হলো, ব্যাংকগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। সংস্কারের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের অধিকাংশই চলে যাচ্ছে পরামর্শকদের পকেটে নানাভাবে। যেমন- রূপালী ব্যাংক বেসরকারিকরণের জন্য ইংল্যান্ডের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পারিশ্রমিক হিসেবে নিচ্ছে ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ডলার, অগ্রণী ব্যাংকের জন্য পরামর্শ বাবদ ৬৫ লাখ ৭৬ হাজার ২৬৯ ডলার নিচ্ছে হংকংয়ের প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটার হাউসকুপারস, যুক্তরাষ্ট্রের আইবিটিসি ইনকর্পোরেট সোনালী ব্যাংকের পরামর্শ বাবদ পারিশ্রমিক হিসেবে নিচ্ছে ৪৮ লাখ ৫৯ হাজার ৯৯৬ ডলার এবং আয়ারল্যান্ডের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-আয়ারল্যান্ড নামে একটি প্রতিষ্ঠান জনতা ব্যাংক বেসরকারিকরণের ক্ষেত্রে পরামর্শ বাবদ নিচ্ছে ৫০ লাখ ৭০ হাজার ডলার। অর্থাৎ এ চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া বাবদ পারিশ্রমিক হিসেবে মোট ১ কোটি ৮৪ লাখ ৩ হাজার ২৬৫ ডলার যাচ্ছে পরামর্শকদের পকেটে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য যেসব প্রকল্প মেনে নিয়েছে আমরা তার সুফল কতটুকু হবে তা ভেবে দেখা খুবই জরুরি।
দেখা গেছে, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের অধিকাংশ প্রকল্প বাস্তôবায়ন করার ফলে আদৌ কোনো উন্নতি হয়েছে এমন নজির নাই; বরং কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচির ফলে অনেক দেশ আরো গরিব হয়েছে। এখন পিআরএসপির আওতায় যেসব প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে তার ফলাফল যে শুভ হচ্ছে না তারও ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে আগেভাগে।
ঋণ সাহায্যের কারণে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি তথাকথিত দাতাগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া শর্ত যা আমাদের জনগণের স্বার্থের বিপক্ষে যায়, সেগুলো প্রতিটি সরকার বারবার মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। দুর্বল, মতালিপ্সু, দুর্নীতিপরায়ণ আমলা ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনস্বার্থবিরোধী প্রকল্প বা ঋণ সাহায্য গ্রহণ না করে স্বাধীন জাতীয় উন্নতির নীতি তৈরি করার কাজ করতে পারত, যা দেশ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব অুন্ন রেখে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করে জনগণের আশা-আকাঙ্খা বাস্তôবায়ন করতে পারত।
আমাদের দেশের জনগণের দুর্ভাগ্য যে,
দুর্বল ও গরিব রাষ্ট্রের কাঁধে ভর দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মর্জিমাফিক তাদের স্বার্থে বিভিন্ন শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে দেশের ওপর। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি সেই ঋণশর্তের অধীন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও বহুজাতিক কোম্পানির পরামর্শে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেসরকারিকরণের ফলে সারাদেশে এসব ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ ও কৃষক সমাজ এখন পর্যন্তô যতটুকু ব্যাংকিং সেবা পাচ্ছে তা থেকেও বঞ্চিত হবে। বেসরকারি খাতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হয়তো হবে; কিন্তু রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ তথা জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব তা ভেঙে পড়বে ক্রমাগত।
একটি অনির্বাচিত অন্তôর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী ইচ্ছা করলেই জননির্বাচিত সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্তô অগ্রাহ্য করতে পারে, বিশেষ করে সেসব সিদ্ধান্তô যেগুলো জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।