একমাত্র ব্যানমুক্ত ব্লগ!
প্রথম পর্ব: নায়াগ্রা ঘুরে এসে (পর্ব-০১)
বাসে উঠেই বাঁশ খেলাম! আমাদের গাইড ফ্র্যাঙ্ক একজন বহুভাষাবিদ! চীনা, জাপানী, কোরিয়ান ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে কিন্তু ইংরেজিটা ঠিকমতো বলতে পারে না!
আমাদের একটা নূহের আমলে কেনা ভিডিও ক্যামেরা আছে। ট্যুরে গেলে সেটা বহন করা নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রায়শই কলহ বাধে! আমার সেটা কাঁধে নিতে ঘোর আপত্তি, কারন এটা কাঁধে নিলেই আমার কেন জানি মনে হয়-রকেট লঞ্চার নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছি! অগত্যা গিন্নী পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন- গিন্নী রকেট লঞ্চার বহন করবেন, আমি তার হাতব্যাগ বহন করবো! “মৃত্যু অপেক্ষা অপমান শ্রেয়”- খোদ আমেরিকার বুকে রকেট লঞ্চার নিয়ে বেঘোরে প্রাণ হারানোর চাইতে, বউয়ের হাতব্যাগ বহন করে মান হারানোই শ্রেয়।
ফ্র্যাঙ্ক আমাদের জানায়, নষ্ট হয়ে যাওয়া সময়টুকু পুষিয়ে নেবার জন্য কষ্ট করতে হবে না। ট্যুরটা উল্টা দিক থেকে শুরু হবে-প্রথমে নায়াগ্রা দেখা হবে, অতঃপর ওয়াশিংটন ডিসিতে যাওয়া হবে। নায়াগ্রা যাওয়ার পথে “কর্নিং মিউজিয়াম অফ গ্লাস” এ একটা ঢু মারা হবে।
ঢু মারা ব্যাপারটিতেই আমার বেজায় আপত্তি। কোথাও ঢু মারতে হলেই সেখানে ঢুকতে হবে। আর ঢুকতে হলেই ঠান্ডার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে, তার জন্য শরীর গরম কাপড়ে ঢাকতে হবে। আর শরীর গরম কাপড়ে ঢাকলেই পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে দেরী হবে। এতে গিন্নী মনক্ষুন্ন হবেন, সংসারে অশান্তি বাড়বে।
কি দরকার অশান্তি বাড়িয়ে? তারচেয়ে বরং কোথাও না যাওয়াটাই মঙ্গল! কথাগুলো মিনমিনিয়ে বলতে যাই গিন্নীকে।
গিন্নী অবাক হয়! বলে, “কি মিন করতে চাইছো?”
আমি ভয় খাই! “না মানে, তোমার ঠান্ডা লাগবে, গরম কাপড় পরে নাও। ”- মিনমিনিয়েই বলি!
আগে বিটিভির নাটকে দেখতাম: নায়ক নায়িকা স্বামী-স্ত্রীর পার্ট করছে। তারা বাসে করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে। বাস চলছে, রাস্তার দু-পাশে পাহাড়, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নদী বয়ে চলেছে।
নায়ক-নায়িকা পরষ্পরের সাথে খুনসুটি করছে, কুটকুট করে কথা বলছে, কিন্তু বাস্তব পৃথিবী পুরোপুরি ভিন্ন! নানারকম ঝক্কি-ঝামেলা সামলে বাসে উঠার পর যত সুন্দর পরিবেশই হোক না কেন, প্রাকৃতিক নিয়মেই ক্লান্ত শরীর ঘুমে ঢলে পড়তে চায়। সুতারাং আমিও প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যাতায় না ঘটিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার উদ্যোগ গ্রহন করলাম। গিন্নী গজগজ করতে করতে হাল ছেড়ে দিলেন। খানিকবাদে গিন্নীও ঘুমে ঢলে পড়লেন।
যখন ঘুম ভেঙ্গেছে ততোক্ষনে বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে।
সবাই দুপুরের আহার সারার জন্য নেমে গেল। আমি ও গিন্নী পোটলা-পুটলী নিয়ে নামলাম। গিন্নী বাসা থেকে নাস্তা হিসাবে পাস্তা রেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা দিয়েই আহার সারা হল। আহারান্তে আহা, উহু করতে করতে রেষ্টরুমে গিয়ে রেষ্ট নিতে নিতে ছাড়াও হলো।
আমাদের বাম পাশে যে চীনা জুটিটি বসেছে, দুজনেরই বেজায় বোঝাপড়া! একবার মেয়েটি ছেলেটির কোলে বোঝা হয়ে পড়ছে তো আরেকবার ছেলেটি মেয়েটিকে কোলে নিয়ে চুমাচ্ছে! চরম শীতে ঘেমে যাওয়ার দশা!
বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতির রুপ-সুধা উপভোগ করতে করতে যেতে থাকি।
প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী অতি মনোরম, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নদী বয়ে যাচ্ছে। আমি আর গিন্নী পালা করে ঘুমাতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর আমরা গিয়ে পৌছালাম, “কর্নিং মিউজিয়াম অফ গ্লাস” প্রাঙ্গনে।
মিউজিয়ামে ঢুকতে ১১ ডলারের মতো লাগার কথা। কিন্তু আমরা আমাদের গাইড ফ্র্যাঙ্কের কল্যাণে বিনা পয়সাতেই ঢুকতে পারলাম।
গিয়ে দেখি ফেলে দেয়া কাঁচের তৈরি কিছু জিনিষকে সাজিয়ে রেখেছে। সবার দেখাদেখি আমি ও মুগ্ধ হবার ভান করতে লাগলাম! মনে মনে ভাবলাম ফেলে দেয়া কাঁচের তৈরি জিনিষপত্র দেখার জন্য এত কষ্ট!
কিভাবে কাঁচের জিনিষপত্র তৈরি হয় তার ধারণা দেবার জন্য দর্শকদের সামনে কিছু একটা বানিয়ে দেখানো হয়। আমরা সেই শো দেখতে গেলাম।
শুরুতেই একটি পাইপের আগায় সামান্য একটা কাঁচের দলা দেখে গিন্নী আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, “বাল্ব বানাবে?”
-আমি বললাম, “বদনা। ” ইতিমধ্যেই বলটার ভেতর বাতাস ঢুকে সেটা বিশালাকৃতির গোলকে পরিনত হয়েছে।
গিন্নী নতুন সিদ্ধান্তে পৌছালো, “প্লেট বানাচ্ছে!”
“হেলিকপ্টার!” -বলে দাঁত বের করে তাকালাম। গিন্নী আমার রসিকতায় মুগ্ধ হবার কোনরকম লক্ষন প্রকাশ করলোনা দেখে রসিকতায় ইস্তফা দিলাম।
কিছুক্ষন মনযোগ দিয়ে দেখার পর আমাকে অবাক হতে হলো! লোকটি সুনিপুন হাতে একটি সুন্দর ফুলদানী তৈরি করলো। তারপর শ’খানেক দর্শকের হায় হায় রবের ভেতর দিয়ে সেই ফুলদানীটি ভেঙে ফেললো!
“আমাকে দিয়ে দিলেই পারতো। অন্তত স্যুভেনীর নামক অপচয়ের হাত থেকে রক্ষা পেতাম!” -স্বগতোক্তির সুরেই গিন্নীর কানের কাছে খেদোক্তি করলাম! ভাবলাম গিন্নী সদয় হয়ে আমার পকেট কে অত্যাচারের হাত থেকে ছাড় দেবেন।
সষ্ট্রা আছেন কিনা এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ থাকলেও গিন্নীর এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নাই। আমি সষ্ট্রার অস্তিত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। এবারেও সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হলো যে সষ্ট্রা আছেন এবং তিনি আমার বিপক্ষেই আছেন। যথারীতি গিন্নী কাঁচের তৈরি ফুল কিনে আমার হাতে দিয়ে বললো, “ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সংরক্ষন করতে হবে এবং ভাঙলে খবরই আছে!” --ঝাড়ির ঠেলায় পকেটের শোক ভুলে, নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শোকে পড়ে যাই!
বাস যেতে থাকে নায়াগ্রার দিকে, এদিকে কাঁচের ফুল সামলাতে গিয়ে আমার বাঁশ যেতে থাকে!
-----------------
ছবি: আমার ক্যামেরা ও ইন্টারনেট থেকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।