জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।
আমার বয়স তখন সাড়ে চার। ভাইয়ার ছয়। কয়েক দিন ধরেই মা বাবা জিজ্ঞাসা করছিল, তোমরা কি একটা ভাইয়া চাও নাকি আপু চাও? আমি এক কথায় 'আপু'! ভাইয়া বলে 'ভাইয়া'। যার যার খেলার সাথীর ধান্দা।
তারপরে, এক রাতে মা বাসায় ছিল না। খুব অসুস্থ তাই হাসপাতালে। বাসায় বেড়াতে এসেছে কামরান ভাইয়া। আমি, ভাইয়্যুন আর কামরান ভাইয়া ডিম লাইটের আলোয় অনেক রাত পর্যন্ত গুট গুট গল্প করলাম, মনে আছে। পরের দিন বাবা মশারি খুলতে খুলতে ডাক, আমরা তো কিছুতেই চোখ খুলব না! বাবার এক কথা, 'খুব মজার একটা খবর আছে, তাড়াতাড়ি উঠে টুথ ব্রাশ করো, বলছি।
' আমরা উঠবই না। 'আগে বলতে হবে'। শেষ মেষ বাবাই আর চেপে রাখতে পারল না, 'তোমাদের একটা আপু হয়েছে। '
আমরা উঠে দাঁড়িয়ে বিছানায় সে কি লাফ!
অত আগের কথা, কিন্তু দিব্যি মনে আছে, আমরা 'মিস্তিরী মিস্তিরী' খেলছিলাম, যখন মিশুকে করে লাল ওড়না পড়া মা ইঁদুরের মত লাল মুখের এক পোটলা সহ বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। পোটলাটাকে নিয়ে আমাদের কি উৎসাহ উত্তেজনা! হাত মুখ ধুয়ে গোল হয়ে বসলাম পোটলার চার পাশে।
তার চোখ, নাক, ঠোঁট, হাতের মুঠি সব বিশ্লেষন করা শুরু করলাম।
এর কয়েক দিন পরের কথা। মা দাবী করছে, বাসায় যেই মেয়েটা থাকতো, ও নাকি মীরাকে আমাদের চেয়েও বেশি ভালবাসে। কারণ, ও মীরার ময়লা কাঁথা, ন্যাপি ধোয় অম্লান বদনে। সেটা শুনে ভাইয়ার সে কি রাগ! ছয় বছরের ছেলেটা বোনের প্রতি ভালবাসা প্রমান করতে পিচ্চি মীরার কাঁথা ধুতে বসল।
সাথে ভালবাসার তীব্রতা প্রমানে ক্লাসিক সেই উক্তি--'কোন গন্ধ নাই, একদম ডালের মত!'
যেদিন মীরা বাসায় আসল, আমাদের ঝিকাতলার ওই ছোট্ট বাসাটায়, বাবা সেদিন মাকে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা আর একটা কার্ড দিয়েছিল, আমার মনে আছে। কার্ডে ডোরা কাটা শাড়ি পড়া দু'টো মেয়ে, সরিষা ক্ষেতের মাঝে বসে একজন আরেকজনের চুল বেঁধে দিচ্ছে। বাবা দেখিয়ে দিল, 'এটা হচ্ছো তুমি, আর ওটা মীরা'।
সেই তখন থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, মীরা কবে বড় হবে? আমার চুল বেঁধে দিবে? গুট গুট করে গল্প করবে আমার সাথে?
এখন ওর দিকে তাকাই আর মহা বিষ্ময় নিয়ে ভাবি, কোন ফাঁকে আমার কিউটিশ পিচ্চি গুটুশ আপুটা এত বড় হয়ে গেল? এখন ওকে দেখলে লোকে প্রায়েই আমার বড় বোন বলে ভুল করে। কোথায় গেল মীরাকে কোলে নেয়ার দিনগুলো, এখন ও অনায়েসে আমাকে উপরে তুলে ধরে।
ওই যে, প্রথম যখন কথা শিখছে... তখনের ওর কিছু ছড়া কবিতা রেকর্ড করা আছে। ও তখন টোনাটুনির গল্প পারত। গল্প একবার এভাবে শুরু করেছে... 'এক দেশে এক টোনা ছিল। '
'তারপর?'
'একদিন টোনা বলল...'
'বল?'
'টোনা বলল...'
'কি বলল?'
'আমি বুজি না। '
মানে ওর মনে নাই।
ওই তখন, ও খুব সুন্দর করে বলতে পারত, 'আমি বাবার মাইয়া'। বাবার মত দেখতে, সবাই বলতো, তাই বাবা শিখিয়েছে। 'পাগলা ঘোড়া ক্ষেপেছে, অনেক অনেক ক্ষেপেছে'... আরেকটা ক্লাসিক লাইন ছিল। কবিতা ভুলে গিয়েছিল, ওই তিন বছর বয়সেই কবির মুখে কথা যুগিয়ে দেয় এভাবে। ক্লাস ফোরে থাকতে এই পিচ্চি ক্লাসে দেয়ালিকা বের করে।
দশ টাকা চাঁদা তুলে! আমাদের বাসার ফুচকা ফান্ডের ম্যানেজার ছিল। এখন কি সুন্দর বিতর্ক করে স্কুলে, বাসায় ঝগড়া করে আমার সাথে। তারপর, চোখে ওই বড় মানুষীয় ক্লান্তি এনে বলে, 'তুমি আমাকে বুঝতে পার না'!
পিচ্চিটা, কোন ফাঁকে ওই লাল টুকটুকে পোটলা থেকে বড় হয়ে একদম জীবন্ত, হাঁটিয়ে, কথা বলিয়ে, অভিমান করিয়ে মানুষ হয়ে গেল, শুধু আমার বোন থেকে আস্তে আস্তে আরও অনেকেরই 'কেউ' হয়ে গেল, একদম টের পাই নি! কাল রাতেই, বাসার সবাইকে জন্মদিন উপলক্ষে 'ফুল কোর্স ডিনার' খাইয়েছে। রীতিমত স্টারটার, আসল কোর্স এবং ডেজার্ট সহ। আসলেই রান্নায় কেউ সাহায্য করে নাই।
আমারই চক্ষু চড়কগাছ!
যেই ব্যাপারটা আমাকে আসলেই মুগ্ধ করে... মীরা দেশ থেকে এসেছে দশ বছর বয়সে। হাতে লেখা ত্যাড়া বাঁকা। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা জন্মানোর সময় তখনও আসে নি। অথচ, সেই মেয়েটাই একে একে হুমায়ুন দখল করে, শরৎ পড়ে শেষ করল, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ পড়লো। সাতকাহন পড়লো।
শীর্ষেন্দু পড়লো। আমি যখন প্রথম বইগুলো পড়ি, তখনের কথা মনে আছে। নিজেকে কত্ত বড় বড় লাগছিল! মীরা কি সত্যিই অতো বড় হয়ে গিয়েছে?
ছোট্ট মীরাকে মিস করি। কিন্তু বড় মীরাকে দেখে যখন মনে হয়, নাহ, আমাদের সবাইকে ছাঁড়িয়ে আসলেই একটা উজ্জ্বল উপহার হয়ে থাকবে সারা পৃথিবীর জন্য, তখন একটা ভালো লাগায় মন ভরে থাকে।
আমি জানি, আমার নি:শর্ত ভক্ত মীরা।
মানুষ হিসেবে আমি অনেক ভুল করি। ভুল সিদ্ধান্ত নেই, ভুল কাজ করি, ভুল অনুভূতিকে প্রশ্রয় দেই। মীরা, আপুর ভয়াবহ 'মানুষ' ভুলগুলোকে কখখনো সামনে রাখবি না, ষোল বছরের চোখ আরও পরিপক্ক হোক, নিজের পথ নিজেই বেছে নেয়ার মত। লাভ য়ু সিস!
----------------------------------
ছবি: এক বছরের মীরাকে নিয়ে পাঁচ বছরের আমি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।