কিছু স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নগুলো অনেক সুন্দর।
ট্রেনে উঠেছি কমলাপুর রেইলওয়ে স্টেশন থেকে। গন্তব্য পাবনার চাটমহর। সাথে আছে আমার রুমমেট সুমন।
প্রতিবার ট্রেনে যাবার সময় আমার মনে হয়, ইস! পাশে যদি কোন সুন্দরী মেয়ে বসত!!!তাহলে ভ্রমনটা জটিল হত। বেশ একটা ফিলিংস পাওয়া যেত।
কিন্তু এবার ট্রেনে সিট-ই পাই নি। ফিলিংস দূরে থাক,এখন সারাটা পথ দাঁড়িয়ে যেতে হবে। ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
কেন যে আগে থেকে টিকিট কনফার্ম করলাম না???নিজেদের কে চরম ……… মনে হল।
তবে একটু পরেই যা দেখলাম তাতে মেজাজ আর খারাপ রাখতে পারলাম না। একটুখানি সুশীতল হাওয়ায় মনটা দুলে উঠল। আমাদের বগি তে একটা ফ্যামিলি উঠল। সাথে তাদের ষোড়শী মেয়ে।
সিট না পাওয়ায় তাদের কেও দাঁড়িয়ে যেতে হবে।
এখন পাঠক বন্ধুরা নিশ্চয় ভাবছেন মেয়েটা দেখতে কেমন ছিল?না, আমি কোন হুরপরীর বর্ননা দিয়ে রবি ঠাকুর হতে চাই না। তবে যা দেখলাম, তা আমাকে মুগ্ধ করল।
মনে মনে জীবনানন্দ দাশের কবিতা আওরাতে লাগলাম………
“এত দিন কোথায় ছিলে নাটরের বনলতা সেন”
সুমনের এক কথা, বুয়েট-এ ০৩’ব্যাচ-এ কিছু আপু এই মেয়ের সমতুল্য হইতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বুয়েট-এ এই রকম বনলতা সেন নাই।
আমার আর সুমনের তর্ক লেগে গেল।
আমি বললাম, একদম নাই এইটা বলা ঠিক না। থাকতেও পারে। ক্যাম্পাসে হয়তো আড্ডা দেয় না। বোরখার আড়ালে বোঝা যায় না।
আমার মাথায় হঠাৎ কিছু মেয়ের নাম চলে আসলো। কিন্তু তাদের নাম এইখানে বলে মাইর খাইতে চাই না। সুমন চরমপন্থি টাইপের লোক। তাই বেশী কিছু বলতেও গেলাম না। কিছুক্ষন দুজোনই চুপ।
ট্রেন জয়দেবপুর স্টেশনে এসে দাড়াল। আর কিছু যাত্রী আমাদের বগীতে উঠল। চরম চাপাচাপি করে সবাই দাঁড়িয়ে আছি। ষোড়শী সেই মেয়েটার কস্ট দেখে বেশ খারাপ লাগতে লাগল। বোঝা গেল দাঁড়িয়ে যাবার অভ্যাস নাই।
অনেক্ষন ধরে মেয়েটার সাথে তাকানো তাকানো খেলা খেলার চেস্টা করছি। কিন্তু হচ্ছে না। আসলে মেয়েটা খুব বেশী নিষ্পাপ। মনে হল সে কিছু একটা নিয়ে খুব বেশী চিন্তিত। এখন পর্যন্ত একবারও তাকে হাসতে দেখলাম না।
খুব ইচ্ছা হচ্ছিল একবার মেয়েটার হাসি দেখি। মেক-আপ বাদেই যে এত সুন্দর তার হাসি আরো অনেক সুন্দর হবার কথা। আচ্ছা মেয়েটার একটা নাম দিলে কেমন হয়?ধরা যাক ষোড়শী।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ট্রেন যমুনা সেতু পাড়ি দিচ্ছে।
খুব ধীর গতিতে।
ট্রেনের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ভর সন্ধ্যাতে যমুনা নদী দেখছি। লালচে একটা আলোয় চারদিক কেমন মায়াময় হয়ে গিয়েছে। একেই বুঝি বলে আগুন রাঙ্গা সন্ধা।
কিছুক্ষন পর পর একটুখানি মিঠে বাতাস মনকে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। ভাল লাগছে। অনেক ভাল।
এক কাপ চা নিলাম। দেখা যাক, চা খেতে খেতে নদী দেখতে কেমন লাগে।
সরবতের মত ঠান্ডা চা আমি এমন ভাবে খেতে লাগলাম যেন স্টার রেঁস্তোরার চা, মুখে দিলেই জিহবা পুড়ে যাবে। মনে মনে ঠিক করলাম, আজকের মিশন ষোড়শীর মুখে হাসি ফোটান। কিন্তু কোন বুদ্ধি পাচ্ছি না।
ভাবতে ভাবতে বগীর ভেতরে ফিরে আসলাম। এসেই দেখি এক পাবলিক সিগারেট ধরিয়েছে।
কারো যাতে কোন অসুবিধা না হয়, সেজন্য তার সতর্কতার শেষ নেই। হাতের সিগারেট সে সবসময় জানালার বাইরে ধরে আছে। তারপর, মাথাটা জানালার বাইরে দিয়ে, জটিল এক স্টাইলে সিগারেট টানছে। ভেতরে সিগারেটের কোনও গন্ধ আসছে না। দেখলেই বোঝা যায়, বেশ গোবেচারা টাইপের মানুষ।
কিন্তু তার ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। সমস্যা না হয়ায় কেউ কোন আপত্তি করছে না। আমিও করতাম না। কিন্তু আজকের মিশনের কথা মনে পড়ে গেল। আরও খেয়াল করলাম, মানুষটা একা।
সুমনকে বললাম, দোস্ত! পাবলিক-প্লেসে এ লোকটা বিড়ি টানতেছে। বিড়ির ধোঁয়াতে বগীর লোকজনের সমস্যা হচ্ছে। আমাদের কিছু একটা করা দরকার।
সুমন বলল, ওর বিড়ি টানা আমি বাইর করতেছি। আমি কি করি খালি দেখ।
কিছুক্ষন পর ভয়ানক একটা চিৎকারে পুরো বগী মনে হয় কেপে উঠল। স্কুলের কোন রাগী স্যার এর ঝারিতে পুরো ক্লাস যেমন চুপ মেরে যায়, তেমনি সুমনের এক ঝারিতে পুরো বগীর লোকজন যেন নড়াচরা বন্ধ করে দিয়েছে। হঠাৎ প্রচন্ড অতীমানবীয় শব্দে বেসামাল হয়ে বিড়ি-টানা পাবলিকটা আর একটু হলেই জানালা দিয়ে পড়ে যেত। তবে তার পাশের লোকটা ধরে ফেলায় শেষ রক্ষা হয়েছে। কিন্তু, তাড়াহুরা করে মাথাটা ভেতরে আনতে গিয়ে জানালায় প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেল লোকটা।
বেচারার জন্য দুঃখই হল!
সুমন তার কাজ শুরু করে দিয়েছে।
ফুল ভলুমে সুমনের ডাইলোগ, ওই ট্রেনের ভেতর সিগারেট কে খায়? দেশে কোন আইন নাই? ট্রেনে এত মানুষ আপনারা, কিচ্ছু বলতেছেন না।
এইবার আম-জনতা যেন দেশপ্রেমে জেগে উঠল। বাকি কাজ তারাই করল। বিড়ি-টানা মানুষটা আম-জনতার কাছে মাফ চাইল।
তার শাস্তি হল, সবার সামনে কান-ধরে দশবার উঠবস করতে হবে। চলন্ত ট্রেনে একজন কান ধরে উঠবস করতেছে, আর সবাই নামতা পড়ার মত হিসাব রাখছে। বড়ই চমৎকার।
আড়চোখে তাকিয়ে দেখি ষোড়শী মুচকি মুচকি হাসছে। আমার মিশন সাকসেসফুল।
ষোড়শীর বাবার সাথে ভাব জমানোর চেস্টা করতেছি। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তার হতাশার কথা বিস্তারিত ভাবে তিনি বর্ননা করতে লাগলেন। আমি খুব মনযোগ দিয়ে তার প্যাচাল শুনতে লাগলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম, ষোড়শী আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সম্ভবত আমি অনেক্ষন যাবত এই আজাইরা প্যাচাল এর সাথে তাল মারতেছি।
কথায় কথায় জানতে পারলাম ওনাদের গন্তব্যও চাটমহর।
মনে মনে ভাবলাম, আবার জিগায়!!!
আমি তাকে বললাম, আঙ্কেল আমিও তো চাটমহর যাব। তারপর সেখান থেকে বাসে করে পাবনা যাব।
আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলেন, চাটমহর কেমন চিনো? আত্নীয় স্বজন আছে?
আমি বললাম, আগে কখনো আসি নি। তবে আমার সমস্যা হবে না।
চিনে নেব কাউকে জিজ্ঞেস করে।
আঙ্কেল বললেন, আজকে বাস নাও পাইতে পার। তোমার আজকে ভালই কস্ট হবে।
আচ্ছা তুমি ঢাকায় কি কর?থাক কথায়?
আমি বললাম, জী বুয়েটে পড়ি, থাকি হলে। ছুটিতে বাসায় যাচ্ছি।
আঙ্কেল একটু নড়েচরে বসলেন।
বললেন, সমস্যা হলে আমি তোমাকে নছিমন ঠিক করে দিব। চিন্তা কর না।
বড়াল ব্রিজ স্টেশনে এসে সুমন নেমে গেল। ওকে বিদায় দিয়ে আসলাম।
কেমন যেন একা একা লাগতে লাগল।
একটু টেনশনে পরে গেলাম। এই অন্ধকার রাত্রে কোন ঝামেলায় পড়ব নাতো? কোন কিছু চিনলে একটা কথা ছিল।
সুমন বলেছিল, এর পরের স্টেশনই চাটমহর। তাই সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে রেডি হতে লাগলাম।
ষোড়শীরাও রেডি হতে লাগল। তিনটা ইয়া মোটা ব্যাগ নিয়ে আঙ্কেল বেশ হিমসিম খাচ্ছিলেন। আমি তাকে সাহায্য করতে লাগলাম।
এদিকে ষোড়শীর মা বললেন, তোমরা এখানেই একটু অপেক্ষা কর, আমি এখনই আসতেছি। মনে হল সে কিছু একটা কিনতে গেল।
বেশ দৌড়ানোর ভঙ্গিতেই গেলেন।
দশ মিনিট হয়ে গেল, তার ফিরে আসার কোন লক্ষন নেই।
ষোড়শীর বাবা বললেন,মাত্র কয়েক মিনিট আছে হাতে। তোমরা দাড়াও আমি তাকে ডেকে নিয়ে আসি।
আমি আর ষোড়শী উদ্ভ্রান্ত চোখে দাঁড়িয়ে আছি।
ষোড়শীর বাবা-মায়ের ফিরে আসার কোন নাম নেই।
আমার কেমন যেন ভাল লাগতে লাগল। এই সময় আমি ওর দিকে তাকাতে পারি নি। আমার মনে হচ্ছিল ও আমার বউ আর আমি ওর সাথে ঘুরতে বের হয়েছি। ভালও লাগে আবার লজ্জাও লাগে।
ট্রেন এসে চাটমহর স্টেশনে থেমেছে। দুই মিনিট দাঁড়াবে মাত্র। ষোড়শীর বাবা-মা যেন উধাও হয়ে গেছে। ষোড়শী কাঁদতে শুরু করেছে। অতি সুন্দরী একটা মেয়ে আর তিনটা ইয়া মোটা ব্যাগ নিয়ে মহা গ্যাঞ্জামে পরলাম।
খুব দ্রুত চিন্তা করা শুরু করলাম। আগেই জেনেছি ওদের বাড়ী স্টেশনের পাশেই। নেমে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ষোড়শীকে বললাম, তুমি নেমে যাও, আমি তোমাদের ব্যাগ গুলো নামাচ্ছি।
বহু কসরত করে ব্যাগ তিনটা দরজার কাছে আনলাম।
দেখি ষোড়শী তখনো নামেনি। নামতে ভয় পাচ্ছে। আমি প্রচন্ড একটা ধমক দিলাম। যা আমি করতে চাই নি তাই করতে হল। আমার হাতে হাত রেখেই ওকে নামতে হল।
এভাবে কোন মেয়ের হাত আগে ধরিনি। প্রচন্ড একটা বিদুৎ ঝলক খেলে গেল মনে। অদ্ভুত তো, মেয়েদের হাত এত নরম হয়? কিছুক্ষনের জন্য আমি আর আমি ছিলাম না। ষোড়শীও খুব লজ্জা পেল।
লজ্জা যে আসলেই নারীর ভুষণ, আমি সেটা অনুভব করলাম।
লজ্জাবতী কে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল।
রবি ঠাকুরের ভাষায়,
"বাধিল যেন বুকের মাঝে সুখের মত ব্যথা"
নিজেকে দ্রুত সামলে নিলাম। মুখে একটা সিরিয়াস ভাব আনার চেষ্টা করলাম।
ব্যাগ গুলো নিয়ে আমিও ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। একটু পর দেখলাম ষোড়শীর বাবা-মা নেমে আসল।
ওদের পরিচিত লোকজন চলে এলো। চলে যাবার কালে ষোড়শী আমার দিকে এক
অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল অনেক্ষন। কেমন যেন একটা বেদনা অনুভব করলাম। যে বেদনার আদৌ কোন অর্থ ছিল কিনা জানি না।
ষোড়শীর বাবা আমাকে বাস পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
চাপা একটা কষ্ট নিয়ে বাসে উঠলাম।
আকাশে মেঘ করেছে। দুরন্ত বেগে লোকাল বাস ছুটে চলেছে।
আচ্ছা ষোড়শীর নামটাই তো জানা হল না। মন বলছে, তোমার সাথে আমার আবার দেখা হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।