নতুন আলোয় মা
উদভ্রান্তভাবে হাঁটতে হাঁটতে কখন একটা গলির মধ্যে ঢুকে গেছি তা বুঝতেও পারিনি। আসলে মন মেজাজ পরিবেশ ভালো না থাকলে এই অবস্থা হয় । পথ হারানোই তখন অভ্যাসে পরিনত হয় । গলিটা অন্ধকার, বিদু্যৎ নেই। নেই তেমন যানবাহনের ভিড়।
মাঝে মধ্যে দু'একটা রিকশা বেল বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। ভাবছি কি করবো । আবার পেছনে ফিরবো, নাকি রাস্তার শেষ দেখে ছাড়বো। জীবনের অনেক কিছুরই শেষ দেখি আমরা কিন্তু রাস্তার কি শেষ আছে? সামনে একটা বাকঁ । রাস্তা ডাইনে ঘুরে গেছে।
ডাইনে ঘুরতেই একটা আলোর দেখা পেলাম। কোথা থেকে আলো আসছে তা বোঝা না গেলেও সেখানে যে একজন লোক দাড়িয়ে আছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। ভাবলাম ওনাকে পথের শেষ সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞাসা করি । কিন্তু কিছু কিছু লোককে ভাই বলবো না চাচা বলবো তা নিয়ে একটা দ্বিধাদ্বন্দ কাজ করে মাঝে মধ্যেই । ভদ্রলোকের বয়স এমনই যে তাকে কি ডাকবো তা ঠিক করতে পারছিলাম না ।
ভাবতে ভাবতে কাছে যেতেই উনি হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলেন। আমি কি বলবো তা নিয়ে একটু দ্বিধাদন্দে থাকতে থাকতেই উনি বলে উঠলেন- আমি আলো, মানে আমাকে আলো বললেই হবে । আপনি?
- জ্বী , আমি মাছুম । আসলে আমি জানতে চাচ্ছিলাম এই রাস্তার শেষ কোথায়, খুব বেশী দূর কি?
- চলুন আমরা সামনে হাঁটি, আসলে আমিও ঠিক জানিনা , দুজনে একত্রে হাটলে নিশ্চয় পেয়ে যাবো।
একটু ইতস্তত ভাব নিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম।
অন্ধকারটা ততটা অসহনীয় নয় এখন ।
- আপনি কি খুব বেশী কিছু সমস্যায় আছেন? নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
- না, হ্যা , কিছুটা। বলবো কি বলবো না ভাবতে ভাবতে উত্তর দিতে শুরু করলাম। হঠাৎ করেই যেনো মনে হলো ভদ্রলোক খুব আপন , খুব কাছের কেউ ।
- আসলে মা এসেছেন দেশে থেকে , খুব অসুস্থ , হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু..
- কিন্তু, কেউ দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না , তাই তো? আপনারা মানে তোমরা কয় ভাই বোন?
হচকচিয়ে গেলাম তার প্রশ্ন শুনে । একবার মনে হলো প্রশ্ন করি আপনি কি করে এতসব জানেন? কিন্তু কেন যেন প্রশ্ন করা হচ্ছে না । তার চেয়ে কথা বলা বা উত্তর দেবার ইচ্ছাই বেশী হচ্ছে। একটা অদ্ভুৎ আচ্ছন্নতার মাঝে কথা বলে যেতে থাকলাম আমি ।
- আমরা তিন ভাই দুই বোন । বোনেরা একজন দেশের বাইরে থাকে। একজন গতবছর বিয়ে হয়েছে , স্বামীর সাথে ময়মনসিংহে থাকে। ভাইয়েরা দুজনই চাকুরী করেন , স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে থাকেন, আমি সবার ছোট , ভার্সিটিতে পড়ছি। বড় ভাইয়ের কাছে থাকি।
মা বড় ভাইয়ার ওখানে এসেছেন অসুস্থতা নিয়ে । ভাইয়ার টাকা পয়সার একটু টানাটানি যাচ্ছে। মেঝ ভাইয়া সরকারী অফিসে একটা ছোটখাট পদে আছেন। তার নাকি এখন বেশ ঝামেলার মধ্যে যাচ্ছে। অফিসে উপরির কোন উপায় নেই ।
তবুও তার টাকায়ই গতকাল ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে বলেছে। বড় ভাইয়া বলেছে বিদেশে বোনকে জানাবে কিছু টাকা পয়সা পাঠানোর জন্য । তারপর চিকিৎসা। আমি আজ ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করে এসেছি।
বলেছি, তোমাদের সব টাকা আমি চাকরি করে পরিশোধ করে দেবো তবু মাকে চিকিৎসা করাও। ভাইয়া বললো , বড় বড় কথা না বলে চাকরি বাকরির চেষ্টা কর। মাকে কি আমরা কম ভালোবাসি নাকি?
- ফেল , পরীা ফেল। হঠাৎ করে বলে উঠলেন আলো ।
- মানে?
- মানে তোমরা সবাই পরীায় ফেল করেছ।
মা-বাবার চিকিৎসা বা সেবা করার জন্য টাকার আগে যেটা দরকার তা হচ্ছে মমতা। সেই মমতা যা দিয়ে তিনি তোমাদেরকে মানুষ করেছেন , বড় করেছেন। আসলে বয়স হলে মা-বাবা অনেকের কাছেই বোঝা হয়ে যায়। একজন মানুষ কিন্তু দেখতে শুনতে মানুষের মত হলেই সে মানুষ হয় না। তার অনেক অনেক গুনাবলীর সমন্বয়ে সে মানুষ।
তার মানুষ হয়ে ওঠার আগে অনেক ধরনের পরীা দিতে হয়। সেসব পরীায় পাশ করার প্রয়োজন হয়। কিন্তু তুমি তো পাশ করতেই পারবে না যদি তুমি না জান কোনটা পরীা, কোনটা নয় । মা-বাবা যখন বৃদ্ধ হন , তখন একজন সন্তান জীবনের বড় পরীাটির সম্মুখীন হয়। অসুস্থ মা-বাবার সাথে আচরন যদি সঠিক না হয় তাহলে পরীায় ফেল ।
একটা সত্য ঘটনা শোন- জার্মানীতে এক সন্তান প্রতি বছর একবার তার মা-কে দেখতে যেতো একটা ওল্ড হোমে। এই কাজে সে এতই বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল যে, একবার মায়ের জন্য নিয়ে যাওয়া খাদ্যে সে বিষ মিশিয়ে দিল । ফলে মা চিরতরের মত তাকে যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিল । তো এরকম আচরন করে কি সে নিজেকে মানুষ রাখতে পেরেছিল না পশুতে পরিনত হয়েছিল , কি মনে হয় তোমার ?
- পশু , পশুরও অধম, ধীরে ফিসফিসিয়ে বললাম আমি ।
- তাহলে আমার পরিচিত আরেকজনের কথা শোনো ।
লোকটা মায়ের সাথে শুধু রাগারাগিই করেনি, মায়ের গায়ে হাত তুলেছে পর্যন্ত। বাবার গায়েও সে হাত তুলেছে। তার এখন কি অবস্থা জানো ? সে জেলখানায় পচে মরছে। তাকে যখন ধরা হয় , তখন র্যাব তাকে এমন মার দেয় যে সে বহুদিন সোজা হয়ে আর হাটতে পারবে না। আমি কিন্তু জানি তার এই দুরবস্থা তার মা-বাবার সাথে দুবর্্যবহারের কারনেই হয়েছে।
কত রাত তোমার অসুস্থতায় তোমার মা জেগে কাটিয়েছে বলতে পারো? এই পর্যন্ত বড় হয়ে আসতে কত যন্ত্রনা তোমার মাকে তুমি দিয়েছ বলতে পার ? সুতারং মা-বাবার সাথে ভালো আচরন, সভ্য ব্যবহার তাদের সেবা করা এটা মনুষ্যত্বের দাবী। নিজেকে তোমার কি মনে হয় , মানুষ?
- জ্বী ।
- আমি বলি যে অর্থকড়ির সবচেয়ে বড় ব্যবহার হলো যখন সেটা তুমি মা-বাবার পেছনে ব্যয় করছো। তাদের অসুস্থতার পেছনে অর্থ ব্যয় করলে তোমাদের অর্থ-সম্পদ কমে যাবে তা তোমাদের কে বলেছে? এটা একটা অমূলক ভয়। বরংচ, কিছু করেই দেখো -প্রকৃতি কোন না কোন দিক দিয়ে তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেবে।
আর মনে রাখো , এটা সবচেয়ে বড় সত্য , তোমরা যদি তোমাদের মা-বাবাকে না দেখতে পারো , সেবা না করতে পারো তাহলে তোমাদের সন্তানরাও এক সময় একই কাজ করবে। তোমাদেরকেও পরিশোধ করতে হবে তোমাদের আজকের আচরনের মূল্য । আর তুমি কেন ভাইয়ের সাথে ঝগড়া করবে? তাদের বুঝাও , টাকার ম্যানেজ করো , দৌড়ঝাঁপ করো-- মায়ের জন্য মমতা নিয়ে চেষ্টা করো । অবশ্যই পারবে । আর তুমি তো জানো - মায়ের পায়ের তলে সন্তানের বেহেশত।
সেই বেহেশত বা স্বর্গের জন্য যে মৃতু্য পর্যন্ত অপো করতে হবে তাও নয়। তাদের নি:স্বার্থ সেবার মাধ্যমে যে পরম প্রশান্তি পাবে , তাতে দুনিয়াতেই বেহেশতের স্বাদ পাবে ।
আলোর কথাগুলো ভেতরে গিয়ে বিধছিল । কথা শুনতে শুনতে কতন হাঁটছিলাম জানি না । গলি পার হয়ে নি:শব্দে একটা বড় রাস্তায় এসে পৌঁছেছি ততনে।
অনেক অন্ধকার পেরিয়ে এতনে আলো দেখা যাচ্ছে আমার চারপাশে , আমার অন্তরেও।
- ঠিক আছে , আজকের মত বিদায়, খোদা হাফেজ ।
- কিন্তু আলো আপনার ঠিকানাটা আমাকে.....
- ঠিকানার দরকার নেই ...আমি আছি.....আমাকে তুমি পাবে... মুচকি হেসে হাত মিলিয়ে হেঁটে চললেন তিনি। একবার ভাবলাম গিয়ে ধরি তাকে । আবার মনে হলো আমার তো এখন মায়ের কাছে যেতে হবে।
মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে হবে-- মা , মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি মা। আমি তোমাকে কষ্ট পেতে দেবো না - কিছুতেই না । তোমার সন্তান বিজয়ী হবেই......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।