মুখের রং কি কুচকুচে কালো? রাস্তাঘাটে দিনের পর দিন পড়ে থাকা সবকিছুই একসময় ধুলা-বালি, কালো ধোঁয়া, ময়লার আস্তরণে ছাই, তেল চিটচিটে ও কালচে বর্ণের হয়; বিশোর্ধ আনুর শরীর-নাক-মুখ-চোখের পাতার রঙ তেমনি। ওর চোখের দিকে তাকালে ভয় করে_ জন্তুর মতো ডাগর জ্বলজ্বলে হলুদ চোখ। কাকের বাসার মতো হিজিবিজি মাথার লালচে চুল বিরতিহীন চুলকাচ্ছে, মাথার পেছনের চুলে আবার জট লেগেছে_ বাবুইয়ের বাসার মতো ঝুলছে। পরনে উধর্াংগে ব্লাউজ, নিম্নাংগে স্যালোয়ার। স্যালোয়ারটি বহু ব্যবহারে জীর্ণ, কয়েক জায়গায় ছেঁড়া ও ইদুঁরের গর্তের মতো বড় বড় ফোঁক আর ধুলা-বালির মায়াবি আস্তরণে পূর্ণ।
তবে শরীরে ময়লা চিকচিক করলেও ব্লাউজের খোলসে আবদ্ধ যৌবন বিবর্ণ নয়। রাস্তার অধিকাংশ পথচারীর লোভি দৃষ্টির তৃষ্ণা মেটাতে ও তাই ব্যর্থ নয়।
দিনরাত সারাণ তারের খাম্বায় পিঠ ঠেকিয়ে আরাম করে বসে মুখ-হাত-পা-আঙুল নাচিয়ে আনু নিজের সাথে কথা বলে_ এলেমেলো সব ধ্বনি আর শব্দ, যার কোনো মাথামুণ্ডু নেই, কেউ কিছু কখনো বুঝেছে বলে শোনা যায়নি; তবে আনু খুব বিজ্ঞের মতো বকে যায় যেন ছাত্রকে বুঝাচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকের মতো 'আনু আনু' বলে চেচিয়ে উঠে আর হাসে। কেউ ওর পরিচয় জানে না, কোত্থেকে একদিন উড়ে এসে এই ডাস্টবিনটার সামনে জুড়ে বসেছে।
একমাত্র 'আনু' শব্দটিই সর্বসাধারণের বোধগম্য হওয়ায় সবাই ধারণা করে পাগলির নাম বোধ হয় আনু। হাসলে ওর মুখ গহ্বরে সাদা আলো উঁকি মারে_ হলদেটে দাঁতের সারির একাংশ দেখা যায়। হঠাৎ হঠাৎ খুব জোরে পিলে চমকানো বিশ্রী ভয়ংকর হাসি হেসে উঠে আনু। হাঁটতে গিয়ে পথচারীরা থমকে যায়, স্কুলগামি শিশুরা ভয় পেয়ে তাদের অভিভাবকের কোলে উঠে পড়ে। কখনো কখনো দু-একজন দয়াবশত টাকা-পয়সা দিলে ও খেকিয়ে উঠে, মুহূর্তে তা আক্রোশে তার দিকে ছুড়ে মারে।
তাদের কণ্ঠে তখন রাগ ফেটে পড়ে, মাগির দেমাক কতো, ভিা লয় না!
কিন্তু পেটের ষড়যন্ত্রের সাথে কতণ টিকতে পারা যায়? খাদ্যের যোগান তো চাই। পাশের ডাস্টবিনটার সামনে থাকা কুকুরটিই ওর চোখে পথনির্দেশ এঁকে দিয়েছিল একদিন। আনু দৌড়ে উঠে গিয়েছিল ডাস্টবিনটিতে। একজন কী যেন ফেলে গেল! ম ম গন্ধ আনুর নাকেও ধাক্কা মেরেছিল তখন। কুকুরটির মুখের সামনে থেকে দু'হাতে খাবার ছিনিয়ে মুখে পুরেছিল ও।
রাস্তায় চলতে থাকা মানুষজন দৃশ্যটি দেখে খুব একটা অবাক না হলেও চারপেয়ে কুকুরটি কিন্তু খাওয়া থামিয়ে বড় বড় চোখে আনুকে দেখছিল। কুকুরটির অবাক হওয়ার কারণ হয়তো তার ছোট্ট জীবনে মানুষের এমন স্ফুরিত ভালোবাসার নিদর্শন পায়নি যে কিনা তার খাওয়ার সঙ্গি হতে পারে। _এভাবেই শুরু। এরপর আর খাওয়ার ভাবনা ভাবতে হয়নি আনুকে। খিদে পেলে ডাস্টবিনটায় এসে বসে।
আশেপাশে কয়েকটি হোটেল রয়েছে_ উচ্ছিষ্ট, বাসি-পচাঁ খাবারের সদ্ব্যবহার হয়ে যায়। ক্রমে দু'জন সঙ্গিও জুটে যায় আনুর_ সেই কুকুরটি যে ওকে খাবার ভাবনা থেকে মুক্তি দিয়েছিল আর একটা কালো বিড়াল। কুকুর বিড়ালটির মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। আনুর পাশেই এদের ঘোরাফেরা, যেন তিনজনের এক উদ্বাস্তু পরিবার। ঝপ করে ডাস্টবিনে কিছু নিিেপত হলেই প্রাণী দুটি অভ্যর্থনা জানাতে দৌড়ে যায়।
আনু বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে দ্যাখে। খিদে মোচড়াতে শুরু করলে একসময় উঠে আসে। নিজে একবার খায় তো কুকুরটিকে খাওয়ায়, আরেকবার বিড়ালটিকে; দেখলে মনে হবে যেন মা তার সন্তানদের খাওয়াচ্ছে। কুকুরটি আবার বড় কোনো হাড্ডির মাংস পেলে আনু কেড়ে নিয়ে তা নিজে চাবায়, কিন্তু বিড়ালটির সাথে পারে না, কোনো মাছের মাথা পেলে কোনদিকে না তাকিয়ে ওটা নিবিষ্ট মনে চর্বণ করে চলে। আনু ছিনিয়ে নিতে হাত বাড়াতেই এক লাফে সামনে ছুট লাগায়।
এই এলাকায় আসার পর থেকে প্রায় প্রতি মাঝরাতেই আনুর বিভৎস করুণ চিৎকার একটা স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাদের বাসা থেকে ডাস্টবিনটা দৃষ্টির সীমায় তাদের কেউ কেউ প্রথম প্রথম অধোঘুম নিয়ে জানলায় উঁকি-ঝুঁকি মারতো। আর্তচিৎকারের হেতু দেখতে পেয়ে কেউ কেউ শিহরিত হতো, কিছু গৃহিনীরা হয়তো আতঙ্কে শেষপর্যন্ত তাদের ােভ ঝারত স্বামীর ঘাড়ে, ছিঃ, কী জঘন্য তোমরা পুরুষরা, একটা ডাস্টবিনের নোংরা পাগলি যে আবর্জনা খায়, গায়ের গন্ধে বমি আসে তারেও ধর্ষণ করতে ছাড়ো না ! স্বামীরা প্রতিবাদ করতে গেলেই উত্তর আসতো, থামো, সব পুরুষরাই এক জাতের, সুযোগ পেলে সবই করতে পারো। তবে কিছুদিন যেতেই মাঝরাতে রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর চিৎকারের মতই অনেকে আনুর আর্তচিৎকারেও একসময় বিরক্ত হয়ে ওঠেন। কিন্তু কিছু লোক সবসময়ই জানলা-বারান্দা দিয়ে অভ্যাসের মতো ব্যাপারটা অবজার্ভ করে, এদের মধ্যে কেউ কেউ দুই ঠোঁটের ফাঁকে চুকচুক শব্দ তুলে তাদের কোমল হৃদয়ের সংবেদনশীলতাও প্রকাশ করে।
কোনোদিন হয়তো দ্যাখা যায় তিনটা মরদ যাদের দু'জনের পরনে প্যান্ট, একজনের লুঙ্গি, আনুর দুইহাত আর চুল ধরে একটা অন্ধকার স্থানে টেনে নিচ্ছে, কোনোদিন দ্যাখা যায় মাত্র দশ-বারো বছরের টোকাই ছেলেরা হাসতে হাসতে আনুর উপর হামলে পড়ছে, একজন ধরেছে হাত, দু'জন পা আর অন্যজন স্যালোয়ার খুলছে।
আনুর সাথে থাকা মাদী কুকুরটি রাত হলেই যেন কোথায় চলে যায় ফিরে আসে ভোররাতে, কালো বিড়ালটি যদিও হলুদ জ্বলজ্জলে চোখে আগুন জ্বেলে রাগে গরগর করতে থাকে তাতে আনুর উপর হামলে পড়া প্রাণীগুলো বিন্দুমাত্র ভয় পায় না। ওরা শুধু বলাৎকার করেই ান্ত দ্যায় না কেউ কেউ মজা করে সিগারেট শরীরে চেপে ছ্যাকাও দিয়ে যায়! তাই ছোট ছোট বৃত্তের পোড়া দাগের অভাব নেই আনুর শরীরে, সারাণ মাছি ওগুলোতে ভন ভন করে। নিরাময়ের সুযোগ নেই বলেই হয়তো প্রকৃতির অপার কৃপায় একসময় ওসব আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়, শুধু চিহ্ন হিসেবে দাগগুলো রয়ে যায়। আনু ডাস্টবিনের সামনের ফুটপাথে থাকা শুরুর কদিন পরই ওর গায়ের ব্লাউজটি বোতামহীন হতে হতে একসময় গলা ছিলা মুরগির মতো ছেঁড়া কাপড়ের টুকরা হয়ে কাঁধে ঝুলে থাকে।
তখন ওর সামনের ফুটপাথ দিয়ে লোক চলাচল হঠাৎ বেড়ে গেলে একদিন দুই বিয়ে করা 'সুরের মেলা' দোকানের মালিক দিলখোলা রহিমুদ্দি সামনে এসে নাক কুচকে আনুকে একটা কামিজ ছুড়ে দ্যায়, ল খানকিমাগি, জামাডা পইরা ফালা_ রাস্তায় তো এক্কেরে মেলা বহায়া দিছছ ! তারপর রহিমুদ্দি একটুণ আনুর নিরাভরণ পুরুষ্ট বুকের দিকে তাকিয়ে যেন আফসোস কণ্ঠে খেকিয়ে উঠে, মাগি খাইতে পাছ না মাগার বুক দুইডা তো ভালই বানাইছছ_ ব্লাউজ তো ছিড়বই, জামাডা কয়দিন যায় কেডায় জানে? সত্যি সত্যি কিছুদিন পরই আনুর গায়ের জামাটি ছিঁড়ে গিয়ে এমন হয় যে তাতে আর লজ্জা ঢাকার অবস্থা থাকে না।
প্রকৃতি চলমান, একসময় প্রকৃতিতে পৌষের জার শুরু হয়, শীত তেমন না হলেও রাতে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। এক হোটেল মালিক তখন দয়া করে আনুকে একটা চালের বস্তার ছালা জামার মতো করে কেটে দ্যায়। আনু সেটা জুতসই করে শরীরে পেচিয়ে নেয়। সকালের রোদ একটু চড়া হলে তারপর ডাস্টবিনে কাকদের মাঝখানে এসে বসে।
সকালের নাস্তা হিসেবে দু'হাতে সাদা ভাত গিলতে শুরু করে। একটু পর পর দু'হাত উপরে তুলে কাক খেদায় আর মুঠি করে ভাত গিলে। কুকুরটি এসে আনুর সাথে যোগ দ্যায়। এবার বায়সকুল ছাড়াও কুকুর ছানাগুলো আনুর খাওয়ার ব্যাঘাত ঘটায়। কিছুদিন হলো কুকুরটি বাচ্চা বিইয়েছে।
চোখ ফোটার আগে ভালোই ছিল কিন্তু চোখ ফোটার পর বাচ্চাগুলি সারাণ মায়ের স্তন্যে ঝুলে দুধ খায়, মাকে ইচ্ছেমত বিচরণ করতে দ্যায় না। কুকুরটি আনুর সাথে খেতে থাকলে ছানাগুলো দুধ খেতে গিয়ে বারবার খাবারের ওপরে এসে পড়ে, লাফ দিয়ে আনুর হাতে তোলা ভাত ফেলে দ্যায়। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। চরম বিরক্ত আনু হঠাৎ একটা ছানাকে খাবলে ধরে ফুটপাথে ছুড়ে দ্যায়। মা কুকুরটি আর্তনাদ করে ওঠে সাথে সাথে।
ছানাটার কুঁই কুঁই আওয়াজে দিশেহারা হয়ে সামনে ছুটে যায়, মমতাভরে মুখ দিয়ে আদর করতে থাকে। অন্যগুলিও ক্রমে পিছন পিছন গিয়ে ফের স্তন্যে ঝুলা শুরু করে। আনু হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে কুকুরটির দিকে চেয়ে থাকে, একমনে কী যেন দ্যাখে, ছানাটির গায়ে মা-কুকুরটি তখন অবিরত মুখ ঘষছে। বিড়ালটি আনুর পায়ের পাতা চাটতে শুরু করেছে, নির্লিপ্ত আচরণের সুযোগে একটা কাক ওর মাথায় চড়ে বসেছে অথচ আনুর কোনো ভ্রুপেই নাই। আনু মূর্তির মতো স্থির, ঘোরলাগা দৃষ্টিতে শুধু কুকুরটির দিকে তাকিয়ে আছে : ছানাগুলো হুড়োহুড়ি করে দুধ খাচ্ছে, মা-কুকুরটি শরীর এলিয়ে দিয়ে মুখ দিয়ে শাবকদের আদর করছে, মাথা ঘষছে ওদের তুলতুলে নরম শরীরে।
আনু বিকারহীন, চোখ নিশ্চল পলকহীন, শরীর যেন ধ্যানস্থ। হঠাৎ কী হলো ওর? হারিয়ে যাওয়া নিঃশেষিত স্মৃতির ঝোপঝাড়ে আচমকা কোনো ছবি কি দুলে উঠল? বজ্রপাত ঘটল ভ্রষ্ট স্মৃতিকোষে? হয়তো স্বপ্নের মতো আলো-আধাঁরিতে ভাসা ভাসা এক অস্পষ্ট ছবি ভাসে আনুর চোখে। হয়তো বহু যুগের ওপার হতে ওর ভ্রষ্ট স্মৃতিকোষ থেকে স্বপ্নের মতো ভেসে আসে একটা দৃশ্য ঃ শাড়ি পরা কে একজন যেন একটা ছোট মেয়েকে কোলে বসিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছে, আদর করে মুখে তুলে কিছু খাইয়েও দিচ্ছে। আনুর চোখে ভাসা কে অই ছোট মেয়েটি, অই শাড়ি পরা নারীটি? মেয়েটির নামও বুঝি আনু ! অই যে মহিলাটি ওকে আনু আনু ডাকছে, পরম আহলাদে কোলে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে! কুকুর ছানাগুলোর মায়ের মতো তারও হয়তো একসময় মা ছিল, আদর করার কেউ ছিল, কোনো স্তন্যদাত্রী ছিল ! অকস্মাৎ আনু দু'হাতের উল্টো পিঠে চোখ ডলতে থাকে যেন ছোট মেয়ে মায়ের উপর মিছে অভিমান করে কাঁদতে শুরু করেছে, কণ্ঠে ওর ভাঙ্গা বিষণ্ন বেসুরো সুর বেজে ওঠে যেন বহু বছরের ভুলে যাওয়া অনুচ্চারিত ধ্বনি : মা-আ..মা-আ..মা...। কিছু পথচারী দৃশ্যটি দেখে চমকে যায়, তাদের কানেও এ ধ্বনি অনুরণন তোলে, তারা হোঁচট খায় তবে পায়ে নয় চোখে।
এপ্রিল 2003
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।