আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গ্রামের নাম সিমপ্লাম্পি (তাজিংডং-8)

ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....

তাজিংডং অভিমুখে খুব সকালেই রওনা দিলাম। যতদূরে যাওয়া যায়। আজকে আমাদের পথের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই। আমাদের সঙ্গে নেয়া খাবার দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাগের ওজন কমে যাওয়ায় এখন আমাদের আগের তুলনায় হাটতে সুবিধা হচ্ছে।

অবশ্য পথের কান্তি, ঠাণ্ডা এবং স্বভাবিক খাবারের অভাবে আমাদের দু-এক জনের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। পাথরে লেগে আমার এক পা ব্যথায় ফুলে গিয়েছিল। তবে এসব দিকে মনযোগ দেয়ার মতো সময় ছিল না। পরে অবশ্য হাটতে হাটতেই পা ঠিক হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুদেরও জানানোর দরকার হয়নি।

আমরা যে পায়ে চলা পথটি দিয়ে যাচ্ছি তা মূলত স্থানীয় পাহাড়িরা শিকার করার জন্য ব্যবহার করে। বন্য জীব জন্তুও ব্যবহার করে এ পথ। এ এলাকাটা ঘন জঙ্গল এবং প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গাছে পূর্ণ। কোথাও অরণ্য এতো গভীর যে, সেখানে দিনের আলোও ঢুকছে না। কোথাও আবার হাজার হাজার লতা ছেকে ধরেছে প্রকাণ্ড গাছকে।

এ ধরনের গাছে বাসা বানিয়েছে হাজার হাজার পাখি। কয়েক জায়গার চারপাশে অনেকগুলো পাহাড় আছে। ফলে মাঝখানের অংশে সূর্যের আলো পৌছাতে বেগ পেতে হয়। ফলে সেখানে দিনের বেলাও জমে আছে কুয়াশা। সেখানে ঘন গাছপালা ঘেরা পাহাড়ের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে এক অপরূপ দৃশ্য।

তাড়া থাকায় প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো মন ভরে দেখার সুযোগ পাচ্ছি না। তাজিংডং পৌছার জন্য আমরা এতোই ব্যাকুল যে, এসব নিয়ে বেশি ভাবার সুযোগ নেই। পথ চলতে চলতে শিকার করতে বের হওয়া দুএকজন পাহাড়ির সঙ্গে দেখা হয়েছে। কয়েকজন পাহাড়ি কিশোরকে দেখলাম, একটা শিয়ালকে বেধে বাশে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বেচারা শিয়াল শুধু লেজ নাড়াচ্ছে।

মাঝে মাঝে পায়ে হাটা পথের ছিরি দেখে আমাদের খুবই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো। পথটা পাহাড়ের একেবারে চুড়া দিয়ে নিতে হবে কিজন্য তা বুঝতে পারছিলাম না। পাহাড়ের পাশ দিয়ে নিয়ে গেলেই তো হতো। তাহলে আর পথটা এতো উচু নিচু হতো না। কিন্তু পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই।

পায়ে চলা পথটা কিছুদূর পর পর উঠতে উঠতে উঠতে একেবারে চূড়ায় চলে যায়। মাঝে মাঝে এমন পাহাড়ও পাচ্ছিলাম যেখানে গাছের গুড়ি কেটে মইয়ের মতো করা হয়েছে। পায়ে চলা পথ শেষ হয়েছে মইয়ের নিচে। মই বেয়ে পাহাড়ের একেবারে চূড়ায় উঠে তারপর আবার নিচে। উচু নিচু এ ধরনের বেশ কয়েকটা পাহাড় পেরোনোর পর পথে দেখলাম এক আর্মি ক্যাম্প- বাকলাই ক্যাম্প।

এভাবে চলতে চলতে এক সময় বিকেল হয়ে গেল। আমরা ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রামের কাছে গিয়ে পৌছলাম। এ এলাকার পাহাড়িরা বেশ হাসিখুশি এবং বন্ধুবৎসল বলেই মনে হলো। গ্রাম থেকে এগিয়ে আসলেন হাসিখুশি এক বৃদ্ধ। আমরা তার কাছে তাজিংডং বলে ইশারা করলাম (কারণ সে বাংলা জানে না)।

দূরে কয়েকটা পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছিলো। সেগুলোর একেবারে ডান পাশেরটিকে তিনি দেখিয়ে দিলেন। দূর থেকেই তাজিংডং দেখে আমাদের মাঝে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। আজকে আমরা এখানেই তাবু খাটিয়ে থাকবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ তাজিংডং এখনও অনেক দূরে।

আজকে ওখানে গিয়ে পৌছাতে রাত হয়ে যাবে। চোখ খুলেই দেখি তাজিংডং- আমাদের স্মৃতিকথায় আগামীকাল সকালের কথাটা এভাবেই লিখতে হবে। এক বন্ধুর এ কথায় সবার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। লক্ষ্য করলাম, এ এলাকাটাও প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।

আগুনের পাশ থেকে একটু দূরে গেলেই শরীর কেপে উঠছে। এ গ্রামের লোকজন সম্ভবত আগে তাবু দেখেনি। আমাদের তাবু খাটানো, আগুন জ্বালানো, কাড়াকাড়ি করে ঝোল সহ নুডলস খাওয়া, সবই তারা ভিড় করে দেখতে লাগলো। গ্রামেরই একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এ গ্রামের নাম কি? প্রথমে বুঝতে পারলো না। ইশারায় তাকে ব্যাপারটা বুঝাতে হলো।

সে জানালো, গ্রামের নাম সিমপ্লাম্পি। প্রথমবার আমি উচ্চারণ করতে পারলাম না। বললাম- সিমপাপি। আরও কয়েকবার তার কাছ থেকে শুনে ভালোভাবে উচ্চারণটা শিখে নিলাম- সিমপ্লাম্পি, সিমপ্লাম্পি, সিমপ্লাম্পি। গ্রামটার কথা এখনও ভুলিনি।

(ছবি: সিমপ্লাম্পি গ্রামের সামনে আমরা তাবু টাঙ্গাচ্ছি। দূরে ডান পাশের চূড়াটাই তাজিংডং, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।