আদিম সমাজগুলোতে নির্যাতিতদের কেউ একজন প্রতিবাদ করে উঠতো। তার জাতি-গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতো, শোষকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে নতুন ধর্মের ডাক দিতো। সেই সাহসী মানুষ অস্বীকার করতো শাসকের ধর্মকে। নিজেকে সম্পর্কিত করে তুলতো ঈশ্বরের সাথে; হয় ঈশ্বর-পুত্র নয় পয়গম্বর হিসেবে দাবী করতো নিজেকে। পয়গম্বরদের ইতিহাসগুলোর সরলীকরণ করলে এই আমরা পাই।
এ কথাগুলোই প্রথম কিসত্দিতে (ভূমিকা) বর্ণনা করা হয়েছে। এই সরলীকরণে অনেকেই আপত্তি করেছেন। তুলেছেন নানা প্রশ্ন; কতটা ইতিহাস সিদ্ধ এ তত্ত্বকথা?
সমস্যা এই ইতিহাসেই। ইতিহাস কোথায় পাওয়া যায়? কে লিখবে ইতিহাস? 1971 এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে 1991 তেই পাওয়া যায় নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য। আর পৌরাণিক ইতিহাসের সত্যাসত্য নির্ধারণ করার উপায় কী? প্রধান প্রধান পয়গম্বরদের সত্যিকার ইতিহাস পাওয়া দুরুহ (ড্যান ব্রাউনের দ্য ভিঞ্চি কোড বা জন ক্যামেরনের কফিন আবিষ্কারের কথা ভাবুন)।
এসব ইতিহাস থেকে পয়গম্বরদের উত্থানকে বুঝতে গেলে সমস্যা দেখা দেয় অন্তত: তিন রকমের; ক) অনুসারীরাই মূলত: পয়গম্বরের জীবনেতিহাসের প্রথম বয়ানকারী। সুতরাং সেগুলো পক্ষপাতদুষ্ট, ফোলানো-ফাঁপানো, মিথিক্যাল। খ) অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠীর পক্ষে এসব ইতিহাস সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিল না। সঠিক ঐতিহাসিক বয়ান পাওয়া না, জবাব পাওয়া যায় না অনেক প্রশ্নের, একারণেই। গ) পরবর্তীতে আসা অন্য কোনো ধর্মের ষাঁড়দের দ্বারা বা পরাক্রমশালী সম্রাটের বাহিনীর দক্ষযজ্ঞে ইতিহাসের অনেক চিহ্নই ধ্বংস হয়েছে।
সুতরাং পয়গম্বরদের প্রকৃত জীবনী এখন আমরা আর ঠিকঠাক জানতে পাই না।
সুতরাং মানুষের পয়গম্বর হওয়া বুঝতে এমন একজনকে বেছে নেয়া উচিত যার সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। পক্ষ-বিপক্ষের অনেকগুলো সূত্র থেকে তার তথ্য যাচাই করা যায় এরকম একজন পয়গম্বরকে এখানে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই। কয়েকটি কারণে এই উদাহরণ আমাদেরকে পয়গম্বরত্ব লাভ সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দেবে:
1. এই পয়গম্বর আধুনিক কালের হলেও অনগ্রসর সমাজের সদস্য। বর্তমান সময়ের অনগ্রসর সমাজের মানুষের আচার-আচরণ থেকে আমরা সহজে সভ্যতার উষালগ্নের মানুষের সমাজব্যবস্থা একটা স্পষ্ট ধারণা পেতে পারি।
2. আধুনিক সময়ের বলে তার সম্পর্কে তথ্যের ঘাটতি নেই।
3. পয়গম্বর হিসেবে তিনি তার সমাজ-জাতিকে কাঙ্খিত মুক্তি এনে দিতে পারেননি। পয়গম্বর হিসেবে তার এই ব্যর্থতা পৃথিবীর প্রতিষ্ঠিত 2/3 টি ধর্ম বাদে বাকী বিপুল সংখ্যক ব্যর্থ পয়গম্বরদের সম্পর্কে অনুমান করতে সাহায্য করবে।
পয়গম্বরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: আমাদের আলোচ্য এই পয়গম্বর জন্মেছিলেন উত্তর আমেরিকায়। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়।
উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের কথা। ইউরোপ থেকে সাদা চামড়ার লোকেরা দলে দলে এসে তখন দখল করে নিচ্ছে উত্তর আমেরিকার বিস্তীর্ণ প্রান্তর। পয়গম্বরের জাতির জন্য নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। তারা তখন বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত, দলাদলিতে লিপ্ত, কেউবা ইউরোপিয়ানদের দালালিতে রত। ইউরোপিয়ানদের আনা মদ ও সসত্দা চাক্যচিক্যময় ভোগ্যপণ্যের মোহে পড়ে (রেড)ইন্ডিয়ান জাতির অনেকেই তখন বিভ্রান্ত।
সাদা চামড়ার লুটেরাদের হাতে তখন তারা নির্যাতিত হচ্ছে, আটকা পড়ছে, হয়ে পড়ছে দাস। এসময় রেড ইন্ডিয়ানদের মাঝে একজন জেগে উঠলেন, তার নাম টেকুমসে। তিনি বললেন, "মহান ঈশ্বর হচ্ছেন আমার পিতা। এই মাটির পৃথিবী আমার মা। " তিনি বললেন, এই মাটি সমষ্টিগতভাবে সব রেড ইন্ডিয়ানদের সম্পত্তি।
একক কোনো মালিক নেই এই মাটির। কেউ চাইলেই ব্যক্তিগতভাবে এর কোনো অংশ বিক্রি করতে পারে না। টেকুমসে'র এই ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদখলে বিরাধ বাধা হয়ে দাঁড়ালো। যুদ্ধ লাগলো সাদা চামড়ার ইউরোপিয়ানদের সাথে ভূমিপুত্রদের।
টেকুমসে' এখানে নির্যাতিত মানুষের নেতা, সাহসী যোদ্ধা।
যদিও তিনি ঘোষণা দিয়েছেন পরম ঈশ্বরের তিনি পুত্র তবু তিনি পয়গম্বর ছিলেন না। তেমন দাবীও তিনি করেননি।
পয়গম্বর ছিলেন টেনসকাওয়াতাওয়া (তার নামের মানে, যিনি দরজা খুলে দেন, 'হি হু ওপেন্স দ্যা ডোর'। )। তিনি ছিলেন সাহসী যোদ্ধা টেকুমসে'র ছোট ভাই।
টেনসকাওয়াতাওয়া (1778-1837) ছিলেন শাওনি নৃগোষ্ঠীর সদস্য। পশ্চিমা ঐতিহাসিকরা অবশ্য তার চরিত্রে নানা কালি-ঝুলি মেখেছেন। তাকে চিহ্নিত করেছেন ভন্ড, প্রতারক, মাতাল হিসেবে। তবে সব পয়গম্বরদের ক্ষেত্রেই এরকম মানহানির আর ষড়যন্ত্রের ঘটনা ঘটেছে। তার জীবনী পাঠ করলে মানুষ কীভাবে পয়গম্বর হয়ে ওঠে সে সম্পর্কে আমরা একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাবো।
এই পাঠ থেকে আমরা এও বুঝতে পারবো আদিকালে কেন গন্ডায় গন্ডায় পয়গম্বরের জন্ম হতো।
টেনসকাওয়াতাওয়ার মানুষ থেকে পয়গম্বর হয়ে ওঠাটা খুবই মিথিক্যাল। একবার কিছু লোক তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে। তারপর তিনি মারা গেছেন ভেবে তাকে ফেলে যায়। পরদিন চেতনা ফিরে পেয়ে টেনেসকাওয়াতাওয়া জানালেন যে, মৃতু্যর পর তাকে দেবদূতরা ঈশ্বরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল।
ঈশ্বর তার হৃদপিন্ড খুলে পরিষ্কার করে তাকে আবার পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে নবীন পয়গম্বর তখন আহ্বান জানালেন রেড-ইন্ডিয়ান জাতির ঐক্যের। বললেন সাদারা হচ্ছে শয়তান, ওদের সমস্ত আচার-আচরণ শয়তানী, ওদের হুইস্কি শয়তানের পানীয়। যারা সাদাদের দলে গেছে তাদেরকে প্রায়শ্চিত্ত করে ফিরে আসার আহ্বান জানালেন তিনি। তারপর তিনি নিজেই গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সে প্রায়শ্চিত্তের অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে শুরু করলেন।
কিন্তু তার বেশিরভাগ জাতভাইরাই তাকে বিশ্বাস করলো না। তারা তাকে বিকৃত মসত্দিষ্ক হিসেবে চিহ্নিত করলো। তাকে মিথ্যাবাদী, পাগল ও অসৎ বলে গালাগালি করলো। অবিশ্বাসীদেরকে পয়গম্বর তখন একটা যুদ্ধ করার লাঠি দেখিয়ে তা মাটি থেকে তুলতে বললেন। বিখ্যাত যোদ্ধা বড়ভাই টেকুমসে সেই লাঠি মাটি থেকে উঠাতে ব্যর্থ হলেন।
তারপর একে একে গোত্রের সবাই যখন সেই লাঠি তুলতে ব্যর্থ হলো, তখন তারা মেনে নিলো টেনসকাওয়াতাওয়া ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ। পয়গম্বর তখন কানাডা থেকে শুরম্ন করে মেঙ্কিান উপসাগর পর্যন্ত উত্তর আমেরিকার বিরাট অঞ্চলে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রে বিভক্ত রেড-ইন্ডিয়ান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশনা দিলেন। তাদেরকে জানালেন ঈশ্বরের পবিত্র আদেশ।
পয়গম্বর ও তার যোদ্ধা বড় ভাই মিলে ফোর্ট গ্রিনভিলে সাদাদের প্রভাবমুক্ত এক শহরের পত্তন করলেন। যার নাম হলো পরবর্তীতে 'প্রফেটস্ টাউন'।
পয়গম্বরের নগর। তিনি তখন রেড-ইন্ডিয়ানদের বিভিন্ন রাজ্যে যাচ্ছেন, সেগুলোকে সাদাদের শয়তানীমুক্ত করছেন ঈশ্বরের নির্দেশ অনুযায়ী, আর দলে দলে রেড-ইন্ডিয়ানরা তার ধর্ম বরণ করে নিচ্ছে। ইন্ডিয়ানার গভর্নর উইলিয়াম হ্যারিসন (পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট) পয়গম্বরের এই অগ্রযাত্রায় প্রমাদ গুণলেন। কারণ পয়গম্বর ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন ইন্ডিয়ানা, ইলিওনয়, মিশিগান ও উইসকনসিনে যে ভূমি কিনেছেন বলে গভর্নর দাবী করছেন তা ধর্মবিরুদ্ধ।
গভর্নর তখন দেশবাসীকে হুশিয়ার করে সংবাদ পাঠাতে শুরম্ন করলেন যে, টেনসকাওয়াতাওয়া একজন জোচ্চোর, প্রতারক, একজন ভন্ড পয়গম্বর।
ডেলওয়ারের অধিবাসীদের পরামর্শ দিলেন হ্যারিসন যে, টেনসকাওয়াতাওয়া যদি সত্য পয়গম্বর হবেন, তবে কোথায় তার স্বগর্ীয় ক্ষমতা। "তাকে বলো যে, তার ক্ষমতা থাকলে সূর্যকে থামাতে, চাঁদের গতি পরিবর্তন করতে, নদীর স্রোতধারা বদলে দিতে, মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করে তুলতে। তবেই না মানবো সে সত্যিকার পয়গম্বর"।
হ্যারিসনের এই চ্যালেঞ্জে দমে গেলেন না টেনসকাওয়াতাওয়া। তার ভাই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে নিষেধ করলেন তাকে।
পয়গম্বর শুধু আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে বললেন, সদাপ্রভু তুমি তোমার ধর্মকে জয়ী করো। তোমার পয়গম্বরকে জয়ী করো। তারপর পয়গম্বর হ্যারিসনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন। পয়গম্বর জানালেন 1806 সালের 6 জুন তারিখে তিনি সূর্যকে গ্রিনভিলের আকাশে থামিয়ে দেবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।