আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নন্দীগ্রাম বিষয়ক একটি লেখা-

পুষ্প, বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ

আমার-আপনার নন্দীগ্রাম- -- ইন্দ্রনীল ঘোষ দস্তিদার -------------- কাল সারাটা দিন হাসপাতালে নানান ঝুট-ঝামেলায় কেটেছে। যেমন আর পাঁচটা কাজের দিন যায়, তার থেকে একটু বেশীই। সাঁঝের ঝোঁকে সোফাতে একটু গা এলালেই নয় যখন, ডক্টর"স রুমে ঢুকতেই কলকল করে বন্ধু ও সহকর্মীরা জানাল -আবার বাংলা বন্ধ। শুক্রবার। কে ডাকল? কে আবার, দিদি ছাড়া? কেন হে? নাকি নন্দীগ্রামে কিসব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট হয়েছে।

আ-ব্বার বন্ধ, শুক্কুরবারদিন যে আমার চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি! কিছু বাছা বাছা খিস্তি ঠোঁটে আসছে, এক-আধটা বলেওছি, সুরঞ্জনাদি বলল-নারে, অনেক লোক মারা গেছে। তখনো ভাবছি-নিশ্চয়ই কৃষিজমি বাঁচাও কমিটির সঙ্গে সিপিএম ক্যাডারদের খুচরো ক্যালাকেলি। তো, ধরো অনিকেশদাকে। অনিকেশদা (নাম পাল্টে দেওয়া হল) আমাদের কনসালট্যান্ট কার্ডিওলজিস্ট ও মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র; মাই ডিয়ার লোক। অনিকেশদা জানাল, না, সিপিএম নয়, ক্যাডার নয়, বিশাল পুলিশবাহিনী ঠান্ডা মাথায় গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছে।

মেয়েরাও মারা গেছে। বুদ্ধবাবু (উত্তেজিত গলায়) মেদিনীপুরকে শেষ না করে থামবে না। হতাশ ও ক্রুদ্ধ; অভিমানী। এই অনিকেশদাই নন্দীগ্রামের প্রথম ঘটনার পরে বলেছিল- এর নাম মেদনিপুর(না, মেদিনীপুর বলে নি, এব ংগলায় ভূমিপুত্রসুলভ অ্যাক্সেন্ট ছিল), ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার আগে ওখানটা স্বাধীন হয়েছে। তারপর তো বেশীরাতে বাড়ি ফিরে এসে দেখলাম টিভিতে।

বন্যার মত টেলিভিশন ফুটেজ আছড়ে পড়তে লাগল চোখে ও মাথায়। অপটিক নার্ভ , কায়াজমা , অপটিক ট্র্যাক্ট হয়ে মাথার পেছনদিককার অক্সিপিটাল কর্টেক্সে রক্ত এসে লাগতে থাকল, লিটার লিটার রক্ত, মানুষের রক্ত-মেয়েমানুষের রক্ত, পুরুষমানুষের রক্ত, বাচ্চা-বুড়ো-পাগল-মুনিষ-মাইন্দর-নকশাল-তৃনমূল-সিপিএম-পুলিশের রক্ত। যতটা রক্ত বেরোলে পরে মানুষ অনিবার্য হাইপোভোলেমিক শকে চলে যায়, ফেরে না আর কিছুতেই, হদৃযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়, অবসন্ন। যতটা রক্ত বেরোলে পরে মাথার ভেতরে নিও-কর্টিক্যাল এরিয়াতে সিগন্যালেরা সব ঘুলিয়ে যায় পথহারা, বুদ্ধিশুদ্ধি ঠিক তেমনি হাড়গোড়ভাঙা দ হয়ে যায়, যেমন হয়ে রয়েছে পুলিশে খোবলানো নন্দীগ্রামের মানুষেরা, তাদের ভাঙা কলার বোন, হাত-পা ও পাঁজর নিয়ে। ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া নয়া বাংলা গড়বো? না:, বুদ্ধবাবু, এই গান আর উঠে আসেনা,এ গান একদা আপনিও গুণগুণিয়ে গাইতেন কিনা সে প্রশ্নও উঠে আসেনা আর ।

শুধু ক্রোধ, পাশবিক; শুধু ঘৃণা, তাল তাল ও জমাট- বাঁধা- কালো, যতটা কালো হতে পারে জমাট বাঁধা রক্ত, মানুষের রক্ত। নকশালী রক্ত? তৃণমূলী রক্ত? আপনি ভাল জানবেন, হে সংস্কৃতিবান পুলিশমন্ত্রী; আরো ভাল জানবেন আপনার প্রিয় বয়স্য, সখা, কৃষকসভা নেতা বিনয় কোঙার, যিনি বলেছেন- পুলিশ কি ফুলের পাপড়ি ছুঁড়বে? প্রমোদ দাশগুপ্ত একদা বলেছিলেন-পুলিশের বুলেটে কি নিরোধ লাগানো আছে, নকশালরা মরে না কেন? হরেকৃষ্ঞ কোঙার নির্দোষ প্রশ্ন করেছিলেন-পুলিশ কি তবে রসগোল্লা ছুঁড়বে? আর কারা যেন একদা কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় শ্লোগানে শ্লোগানে ভরিয়ে দিয়েছিল-পুলিশ, তুমি যতই মারো/মাইনে তোমার একশ' বারো। হা:, রঙ্গপ্রিয় ইতিহাস! খবরে প্রকাশ , মৃত অন্তত: চোদ্দ, আহতের সংখ্যা পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। হতাহতদের প্রাথমিকভাবে নন্দীগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি নিশ্চিত্ জানি, যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের যথাযোগ্য চিকিত্সা ঐ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবশ্যই হয়েছিল, কেননা পশ্চিমবঙ্গের যে কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতই নন্দীগ্রামেও কি আর যথেষ্ট পরিমাণ হজমের ওষুধ, কৃমি ও আমাশার বড়ি এব ংগর্ভনিরোধক পিল (তেমন তেমন হলে চাই কি এক-আধখানা স্টেথোস্কোপ-ও !)ছিল না ! বিভাস চক্রবর্তী বললেন- বুদ্ধবাবুর সাদা পাঞ্জাবীতে কিন্তু রক্তের ছিটে লেগেছে, এব ংলেডী ম্যাকবেথের মত( "আমি নাটকের ভাষাই ব্যবহার করছি'-উনি বললেন) উনিও ওঁর হাতে লেগে থাকা রক্তের দাগ তুলবার চেষ্টায় প্রাণান্ত হয়ে যাবেন, কিন্তু পারবেন না।

লেডী ম্যাকবেথ? বুদ্ধবাবু? কল্পনা করবার চেষ্টা করলাম বুদ্ধবাবুর র ংও রুজ মাখানো গাল , স্বর্ণাভ উইগ ও মানানসই অ্যাটায়ার-রক্তাক্ত হাত নিয়ে তীব্র বেগুনী আঁধারে তীক্ষ্ণ চীত্কার করে প্রাসাদ অলিন্দ দিয়ে ছুটে যাচ্ছেন। হাসি পেয়ে গেল। কেননা আমরা তো নাটক দেখিনা সে আজ বহুকাল। বাচ্চাটা হওয়ার পর ওকে নিয়ে নাটক দেখতে যাওয়া যায় না, তাছাড়াও ওর পেছনে সময় দেওয়া, আমার হাসপাতাল, আরো পড়াশুনো, সঙ্গীতার অফিস। কফি উইদ অর উইদাউট করণ।

সিটি সেন্টার, কাফিলা;তার ডেকর পেশওয়ারী, তার দেয়ালে ঝোলানো সাজানো বন্দুক, হায় কি অসহায় নির্বিষ ! হাসি ছাড়া তাই কিছু আর নেই আমাদের। চিনিহীন কালো কফির মত তেতো হাসি, ঈষত্ বাঁকা, মুখটেপা ও কাষ্ঠ-কিন্তু কোনমতেই হা হা নয়-এমন হাসি। এই হাসি মেখে আমরা ট্রামে-বাসে চড়ি , সিট নিয়ে মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করি, বিকেলে বিষণ্ন হই,সকালে কোষ্ঠসাফ ও রাতে সঙ্গম করি, শিশুকে আদর করি, বসকে হ্যা-হ্যা বলি । আর গর্তে ঢুকি। মেট্রোরেলের, রাজারহাটের,ওপেল অ্যাস্ট্রার ..... প্রসঙ্গত:, বিভাসবাবু সহ আরো বেশ কয়েকজন নাট্যব্যক্তিত্ব-কৌশিক সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু এব ংসম্ভবত: মনোজ মিত্র ও অশোক মুখোপাধ্যায়ও -নাট্য একাডেমির পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।

বিভাসবাবু আরো বললেন- শঙ্খদার(কবি শঙ্খ ঘোষ) সঙ্গে একদিন দেখা হল, উনি বললেন- বুদ্ধবাবু যে বলেছিলেন, এইসব নিয়ে একদিন কথা বলবেন, কই , বললেন না তো ! বুদ্ধবাবু হাজারো কাজের মানুষ, সবার সঙ্গে কথা বলার সময় না-ও থাকতে পারে। ভুলে যেতেই পারেন নন্দীগ্রামের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলার কথা, ঝঊত -এর আওতায় তাঁদের গ্রামটিকেও ঢোকানো নিয়ে নোটিশ পড়বার আগে। ভুলে যেতে পারেন নন্দীগ্রামে পুলিশ ঢোকানোর আগে এলাকার সিপিআই বিধায়ককে অবহিত করবার কথা। আর, এমনই বা কে মাথার দিব্যি দিয়েছে যে ভুলে যাওয়া যাবেনা- বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নামের একজন মানুষ একদা একটি দল করতেন , যার নাম মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি , ট্রামভাড়া ন্যূনতম বাড়লে যারা কলকাতা অচল করে দিয়েছিল, খাদ্য আন্দোলন আর শিক্ষক আন্দোলনের সামনে তারাই ছিল, হ্যা হ্যা, সেইসব মানুষেরা যারা পুলিশকে ইঁট-পাটকেল ছুঁড়তে পিছপা হয় নি, দরকারে বোমা ও পাইপগান। এব , ংআমি বিশ্বাস করি, তারা ভুল কিছু করেনি।

বুদ্ধবাবু, আপনি? তবে , ভুলে যাওয়া কিছু বুদ্ধদেবের একচেটিয়া নয়। পৃথিবী জুড়ে অ্যামনেশিয়া-ডিমেনশিয়ার বাড়বাড়ন্ত, মানুষ-সব মানুষ সব কিছুই ভুলে যায়, সালভাদর আলেন্দে ও পিনোশে, গুলাগ ও হিরোশিমা, লুমুম্বা ও গেভারা, তেভাগা-তেলেঙ্গানা ও মরিচঝাঁপি। করন্দার কথা তো লোকে কব্বে ভুলে বসে আছে। নন্দীগ্রাম? মাসখানেক সময় দেবেন তো মশায়! তাছাড়া সামনে যখন ইলেকশন নেই ও ব্রান্ড বুদ্ধ যখন সেলি ংলাইক হট কচুরিজ, হ্যা, এখনো, এই আতান্তরেও,জাতীয় নিউজ চ্যানেলের ংসং পোলে। তাছাড়া , আমরা ই কি চাইনি, গোপনে ও প্রকাশ্যে কত মজলিশে-এদেশের বুকে আর্মি আসুক নেমে ! আজ সকালটাও শুরু হয়েছিল বড় অদ্ভুতভাবে।

বিধাননগর স্টেশনে নেমে দেখি ভিড় ঠেলে ওভারব্রীজে ওঠা যাচ্ছে না, এত লোক ! সার বেঁধে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছে। নিশ্চয়ই কোনো অ্যাক্সিডেন্ট । আমি তো ওসব দেখব না, ও বড় অশ্লীল, ভয়ুরিস্টিক, তাই মানুষ ঠেলে সটান এগিয়ে যাই। কিন্তু কোন বিড়ালই বা কবে বেঁচেছে কৌতুহলের কাছে ! তাই একটিবার তাকাই এব ংদেখতে পাই একটি মুন্ডহীন ধড়, আদ্যন্ত পরিষ্কার , তাতে রক্তের ছিটেফোঁটা লেগে নেই, শুধু হাত-পা- ক"টি শরীরের সঙ্গে অদ্ভুত কোণ রচনা করে মুচড়ে রয়েছে, যেন পিকাসোর বাউন্ডুলে কোনো ছবি। হনহনিয়ে এগিয়ে যাই,একেই যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে ... তাছাড়া ও তো মরেই গেছে, আমার মাঝখান থেকে গন্তব্যে পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে।

রাতে টিভি দেখে মনে হল, নন্দীগ্রামের প্রতিবাদও ঐভাবেই মুখ মুচড়ে পড়ে রয়েছে, একদা সোনালী ডানার চিল ছিল হয়তো বা, যখন আমরা, আমাদের বাপ-দাদারা স্বপ্নে দেখত যৌথ খামার। অবিকল পিকাসোর বাউন্ডুলে কোনো ছবি। লেননের ফার-ফেচেড ইমাজিনেশন। কিন্তু সে আজিকে হল কত কাল। ওসব এক্কেবারে মরে গেছে, অত্যাধুনিক ইনস্যাস রাইফেলের ঠেলায় কি আর কেউ টেকে ! এতেও না শানালে সেনা ছিল, এ কে ৪৭/৫৬ ছিল .. থাগগে।

কেমিক্যাল হাবের সঙ্গে সঙ্গে হোটেলটোটেলও হলে পর, সালেম গ্রুপ যখন, একবার বর ংঘুরে আসা যাবে উইকএন্ডে,ছোট পরিবার, সুখী পরিবার। বারংবার হটে হটে হঠাত্ হটেনটট যোদ্ধা যেন ছুটে যায় সিংহের দিকে/ এরকমই স্বপ্নে ঘুমে বুকের ভেতরে যেন গুরগুর ... তুষার রায় একদা লিখেছিলেন। কিন্তু তুষার রায় তো এখন মৃত। আর মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো। তাদের কবরের ওপর আর কেউ নয়, কিছু নয় শুধুই তুষার, শুধু ধূ ধূ প্রান্তরে বনে কেবলই তুষার ঝরে, শুধুই তুষার।

আর, যারা ফেরে, তারা তো প্রেত। তুষার ঠেলে ঠেলে ছাই র ংমুন্ডহীন কবন্ধ, শুকনো মামড়ি-ওঠা ঠোঁট, কাটা হাত তুষারযোনি অশরীরী। দেশ যাদের কোনো মাতৃভাষা দেয় নি কখনো। । ------------------------------------------ লেখাটা পেলাম [link|http://guruchandali.com/guruchandali.Controller?portletId=8&porletPage=2&contentType=content&uri=content409|MyiyP


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।