সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সদস্য (রুকন) পলাতক আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে আজ সোমবার রায় ঘোষণা করা হবে। আর এর মধ্যদিয়েই ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায় ঘোষণা হচ্ছে আজ।
গতকাল রবিবার এক সাংবাদিক সম্মেলনে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার এ কে এম নাসিরউদ্দিন মাহমুদ এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন পলাতক আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রায় ঘোষণা করা হবে সোমবার। গত ২৬ ডিসেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে মামলাটির রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিলেন ট্রাইব্যুনাল-২।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বিচারপতি মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারক শাহিনুর ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত তিন সদস্যের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করবেন। এর মধ্যদিয়ে ১৯৭১ সালে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের কোন মামলার রায় ঘোষণা হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি গোলাম আরিফ টিপু বলেন, এ দিনটির জন্য গভীর প্রত্যাশা নিয়ে অধীর আগ্রহে ছিলাম। আমাদের প্রত্যয়দীপ্ত বিশ্বাস আগামীকাল (সোমবার) আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে প্রত্যাশিত রায় ঘোষণা করা হবে।
আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান বলেন, আযাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা আটটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
রায়ে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে।
২০১১ সালের ১০ এপ্রিল আযাদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেন। সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে রাষ্ট্রপক্ষ গত ২৫ মার্চ আবুল কালাম আযাদকে গ্রেতারের আবেদন করে। পরে ২ এপ্রিলের মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি জানতে চান ট্রাইব্যুনাল। গত ৩ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আযাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।
কিন্তু সেদিন উত্তরখানের বাসা থেকে আযাদ রহস্যজনকভাবে নিখোঁঁজ হন। যদিও গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আগেই তাকে নজরবন্দি করে রেখেছিলো গোয়েন্দা পুলিশ। নজরবন্দি অবস্থায় তিনি কীভাবে পালিয়ে গেলেন তা নিয়েও রহস্য রয়েছে। এ নিয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকে দায়ী করে হাইকোর্টে একটি হেভিয়াস করপাস রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তার পরিবারের আইনজীবী আবেদনটি শুনানির জন্য আদালতে উত্থাপন করেনি।
গত ২ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করে। ৯ সেপ্টেম্বর আযাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। এ সময় তাকে গ্রেফতারে আবারো নির্দেশ দেয়া হয়। তাকে গ্রেফতার করতে না পারায় ২৫ সেপ্টেম্বর আযাদকে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার জন্য দু'টি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও তিনি হাজির হননি। পরে তার অনুপস্থিতিতেই বিচার শুরু হয়।
৭ অক্টোবর পলাতক আযাদের পক্ষে ট্রাইব্যুনাল মামলা পরিচালনার জন্য মো. আবদুস শুকুর খান নামে একজন আইনজীবীকে নিয়োগ দেয় ।
আযাদের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
গত বছরের ৪ নভেম্বর আবুল কালাম আযাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৩ এর (২) ধারা অনুযায়ী আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে ছয় ধরনের অপরাধে আটটি অভিযোগ গঠন করা হয়। অপরাধগুলো হলো গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতন। প্রথম, দ্বিতীয় ও অষ্টম অভিযোগে আযাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে অপহরণ, আটক রাখা ও নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়।
আযাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ অভিযোগে। পঞ্চম অভিযোগে তার বিরুদ্ধে নতিবদিয়া গ্রামের দুই নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া সাত নম্বরে আযাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার একমাত্র অভিযোগটি আনা হয়েছে। এ অভিযোগ অনুসারে, একাত্তরের ১৭ মে তিনি ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র রাজাকারকে নিয়ে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় হামলা চালান। সেখানে নির্বিচারে গুলি করে শরত্চন্দ্র পোদ্দার, সুরেশ পোদ্দার, শ্যামাপদ পোদ্দার, জতীন্দ্র মোহন সাহা, নীল রতন সমাদ্দার, সুবল কয়াল ও মল্লিক চক্রবর্তীকে হত্যা করা হয়।
হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয় বলে তার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের যতগুলো মামলা হয়েছে তার মধ্যে আযাদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি।
মামলার বিচার প্রক্রিয়া
মাত্র দুই মাসের মধ্যে আযাদের বিরুদ্ধে মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। মূলত আবুল কালাম আযাদ পলাতক থাকায় এবং তার পক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী না থাকায় দ্রুত বিচার কাজ শেষ হয়। গত ৪ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের মধ্যদিয়ে আযাদের বিরুদ্ধে মামলার বিচার কাজ শুরু হয়।
এরপর ২৬ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে ৩৩ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর ওইদিনই তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেনসহ রাষ্ট্রপক্ষের মোট ২২ জন সাক্ষ্য প্রদান করেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে এক নারী সাক্ষী ক্যামেরা ট্রায়ালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামির পক্ষে স্টেট ডিফেন্স আবদুর শুকুর খান তাদের জেরা শেষ করেন।
রাষ্ট্রপক্ষে ২২ জন সাক্ষ্য দিলেও আসমিপক্ষে কোনো সাফাই সাক্ষী হাজির করা সম্ভব হয়নি। সাফাই সাক্ষী না থাকায় ট্রাইব্যুনাল যুক্তি উপস্থাপনের জন্য ২৩ ডিসেম্বর দিন ধার্য করেন। দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর মামলার কার্যক্রম শেষ হয়। রাষ্ট্রপক্ষে কৌঁসুলি সাহিদুর রহমান অভিযোগের বিষয়ে এবং অপর কৌঁসুলি সৈয়দ হায়দার আলী আইনি বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।