আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকা ও বিজ্ঞাপনী শিল্প



ঢাকা ও বিজ্ঞাপনী শিল্প পত্রিকার পাতা খুললেই পৃষ্ঠাজুড়ে রঙবেরঙের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। এদিক থেকে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াও পিছিয়ে নেই। পিছিয়ে নেই রাস ার ধারে দেয়াল বা সুউচ্চ অট্টালিকার ছাদ। চারদিকে তাকালেই বিলবোর্ড, বান্টিং, ড্যাঙ্গলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ঠাসা ঠাসা বিজ্ঞাপন দেখে কান িতে চোখ বুজে আসে। কিন্তু বিজ্ঞাপন শিল্পের ইতহাস একদিনের নয়।

আজ থেকে 50 বছর আগে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন শিল্পের অভিযাত্রা শুরু হয়। গত 50 বছরে বাংলাদেশে বিজ্ঞাপন ব্যবসায় একটি সমৃদ্ধ এবং লাভজনক শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। গত শতকের শুরুতে ঢাকা ভিত্তিক কোনো বিজ্ঞাপন ব্যবসায় ছিল না। 50 দশকের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা কেন্দ্রিক প্রথম বিজ্ঞাপন শিল্পের চর্চা শুরু হয়। কিন্তু ঢাকা তখনও এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যভাবে জড়িত ছিল না।

ঢাকার বিজ্ঞাপন ত্রেকে তখন পাকিস ান (তৎকালিন পশ্চিম পাকিস ান) থেকে নিয়ন ণ করা হতো। ম লত মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকাতে বিজ্ঞাপন ব্যবসায় প্রত্যভাবে শুরু হয়। 80-র দশকে এদেশে বিভিন্ন বহুজাতিক কোমঙ্ানি গড়ে ওঠে। শুরু হয় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্যের সঙ্গে তুমুল লড়াই। সেই সঙ্গে বিজ্ঞাপন শিল্পও ক্রমে প্রসারিত এবং বৈচিত্রময় হতে শুরু করে।

দেশ বিভাগের পর 50-এর দশকে বাংলাদেশে (তৎকালিন প র্ব পাকিস ান) কোনো বহুজাতিক শিল্প-কারখানা ছিল না। ফলে তখন এখানে তেমনভাবে কোনো বিজ্ঞাপন সংস্থাও গড়ে ওঠেনি। তখন পশ্চিম পাকিস ানের কিছু বিজ্ঞাপনি সংস্থা এদেশে শাখা হিসেবে তাদের অফিস প্রতিষ্ঠা করেছিল। মরহুম গুলাম মহিউদ্দিন 1948 সালে গ্রীন ওয়েজ পাবলিসিটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার ইতিহাসে এটাই প্রথম বিজ্ঞাপনী সংস্থা।

পরবর্তীতে 1965 সালে গুলাম মহিউদ্দিন বিজ্ঞাপন জগতে নতুনত্ব ও ভিন্ন ধারা সৃষ্টিতে প্রতিষ্ঠা করেন চ্যামঙ্িওন নিয়ন সাইন। 54 বা 55 সালে মরহুম সালাম কবির প্রতিষ্ঠা করেন ইস্টল্যান্ড এ্যাডভার্টাইজিং কোমঙ্নী। ইস্টল্যান্ড এ্যাডভার্টাইজিং কোমঙ্নী তখন অল পাকিস ান নিউজপেপার সোসাইটি এবং বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদের সদস্য ছিল। 56/58 সালের দিকে যাত্রা শুরু করে কোহিনুর । 60 দশকের শুরুতে মরহুম শরফুদ্দিন আহমেদ, শের আলী রামজি এবং ইফতেখারুল আলম মিলে প্রতিষ্ঠা করেন স্টার এ্যডর্ভাটাইজিং।

এ সময় লিভার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাডভার্টাইজিং সার্ভিস (লিনটাস), ডিজেকিমারও এদেশে তাদের যাত্রা শুরু করে। 1965 সালে মরহুম শরফুদ্দিন আহমেদ বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নবংকুর এ্যডর্ভাটাইজিং লিমিটেড। 1967 সালে পাকিস ানের এশিয়াটিক এ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেড ঢাকাতে ইস্ট এশিয়াটিক এ্যাডভার্টাইজিং লিমিটেড (বর্তমানে এশিয়াটিক) নামে তাদের শাখা অফিস চালু করে। তখন আলী যাকের ঢাকা অফিসের ম্যানেজার ছিলেন। দু-এক বছরের ব্যবধানে রেজা আলী প্রতিষ্ঠা করেন বিটপি।

69/70 সালে ব্যবসায়ী লতিফুর রহমান এ শিল্পে বিনিয়োগ করেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইন্টারসঙ্্যান (বর্তমানে ইন্টারসঙ্ীড)। পরবর্তীতে লতিফুর রহমান এনায়েত করিমের কাছে ইন্টারসঙ্্যান বিক্রি করে দেন। স্বাধীনতার পর দেশিয় উদ্যোক্তারা নতুন শক্তি ও সাহসে উৎসাহিত হয়ে বিজ্ঞাপন শিল্পে বিনিয়োগ করেন। এ সময় পাকিস ানের বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো তাদের বাক্স-পেটরা গুটিয়ে ফেলেন।

এছাড়া বাংলাদেশ সরকারও পাকিস ানের কিছু বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে অধিগ্রহণ করে। এর মধ্যে কোহিন র নামক বিজ্ঞাপনী সংস্থা উল্লেখযোগ্য। 1971 সালের পর প্রথম এক দশক বাংলাদেশে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান বা বহুজাতিক কোমঙ্ানি ছিল না। এ সময় দেশিয় প্রতিষ্ঠানের তৈরি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীও সীমিত ছিল। 1980 পর্যন স্থানীয় ট্রয়লেট্রিজ প্রতিষ্ঠানের বাইরে লিভার ব্রাদাসই (বর্তমানে ইউনিলিভার) একমাত্র আনর্ জাতিক ট্রয়লেট্রিজ প্রতিষ্ঠান ছিল।

তখন লিভার ব্রাদার্স সাবানছাড়া এখনকার মতো এতোকিছু উৎপাদন করতো না। স্থানীয় ট্রয়লেট্রিজ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কোহিন র কেমিক্যালস। তারা ছোট পরিসরে হলেও সাবানসহ সবকিছুই উৎপাদন করতো। স্বাধীনতার পর মরহুম শরফুদ্দিন আহমেদ কবি ফজল শাহাবুদ্দিন এবং অভিনেতা হারুন রশিদকে নিয়ে নান্দনিক এ্যডর্ভাটাইজিং লিমিটেড এবং আলী যাকের ইস্ট এশিয়াটিক এ্যডভার্টাইজিং লিমিটেডের যাত্রা শুরু করেন। পরবর্তীতে 1994 সালে ইস্ট এশিয়াটিক এ্যডভার্টাইজিং লিমিটেডের নাম পরিবির্তন করে রাখা হয় এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনস লিমিটেড।

1972 সালে মরহুম রশিদ আহমেদ প্রতিষ্ঠা করেন কারুকৃত। গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী এ্যডকমের যাত্রা শুরু করেন 1974 সালে। 1975 সালে মরহুম আনিসুল হক এ্যডবিজ ইন্টারন্যাশনাল এ্যাডর্ভাটাইজিং প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর বিজ্ঞাপনের পথকে আরো মসৃণ ও প্রাণবন করতে হাজী আরশাদ আলী এলিট প্রিন্টিং প্যাকেজেস লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন। 80-এর দশকে বেশ কয়েকটি শিল্প-প্রতিষ্ঠান এবং বহুজাতিক কোমঙ্ানী বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে।

শুরু হয় বিভিন্ন ধরণের ভোগ্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন। আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের ক্রয় মতাও বাড়ে। ফলে চাঙ্গা হয়ে ওঠে বিজ্ঞাপন শিল্প। বিভিন্ন কোমঙ্ানীর উৎপাদিত পণ্যের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞাপনী সংস্থার তৈরি বিজ্ঞাপনগুলোর মধ্যেও প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এ সময় বেশকিছু বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পেশাদারি মনোভাবেরও সৃষ্টি হয়।

লিভার ব্রাদার্স আনর্ জাতিক বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর সঙ্গে দেশিয় বিজ্ঞাপনী সংস্থার সংযোগ ঘটান। 1980 সালে অভিনেতা পিযুষ বন্দোপাধ্যায় এ্যড বেস্ট প্রতিষ্ঠা করেন। 1984 সালে অভিনেতা আফজাল প্রতিষ্ঠা করেন মাত্রা। 1985 সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউনিট্রেন্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পাড় করে মুনির আহমেদ খান ও জুলফিকার আহমেদ ইউনিট্রেন্ড প্রতিষ্ঠা করেন।

এরপর আরো অনেক বিজ্ঞাপনী সংস্থার জন্ম হয়। 90 দশক থেকে বিজ্ঞাপনী জগতে তুমুল পরিবর্তন আসে। এ সময় বিজ্ঞানসম্মত বিজ্ঞাপন তৈরির ধারা শুরু হয়। সেই সঙ্গে বিজ্ঞাপন তৈরির আগে মার্কেটিং রিয়েলাইজেশনের বিষয়কে প্রাধাণ্য দেওয়া হয়। এ সময় বিজ্ঞাপন চিত্রের দৃশ্য ধারণের জন্য বেটার পাশাপাশি ইউমেটিকের প্রচলন শুরু হয়।

নতুন শতাব্দির শুরুতে বিজ্ঞাপন শিল্পে আম ল পরিবর্তন আসে। প্রচুর ব্যবসায়ী এই শিল্পে বিনিয়োগ করেন। এছাড়া অনেকেই এই শিল্পকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আগ্রহ দেখান। বর্তমানে বাংলাদেশে আনুমানিক 250 টিরও বেশি বিজ্ঞাপনী সংস্থা আছে। এ সময় উদ্ভব হয় আধুনিক প্রযুক্তিসম্মত নিত্য নতুন বিজ্ঞাপনী মাধ্যম।

সবচে বেশি পরিবর্তন আসে বড় বড় বিলবোর্ডের েেত্র। রাস া ও বিশাল অট্টালিকায় ইলেক্ট্রনিক বিলবোর্ড শোভা পেতে শুরু করে। চ্যামঙ্িওন নিয়ন সাইন, ইস্টল্যান্ড এ্যাডভার্টাইজিং কোমঙ্নী, বিটপি এ্যডভার্টাইজিং লিমিটেড, ইন্টারসঙ্্যান (বর্তমানে ইন্টারসঙ্ীড) এবং আরো দু-একটি বাংলাদেশি বিজ্ঞাপনী সংস্থা স্বাধীনতার আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পরও এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপন শিল্পে কাজ করতে থাকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বপ্রথম নান্দনিক এ্যডভার্টাইজিং লিমিটেড, এ্যডকম এবং কারুকৃতসহ কয়েকটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।

তবে এদের মধ্যে কারুকৃতই স্বাধীনতার পর প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিজ্ঞাপন জগতে গ্রাফিকস ডিজাইনের প্রচলনের কথা উঠতেই মরহুম রশিদ আহমেদের নাম চলে আসে। তিনি 1958 সালে ঢাকার সরকারি ইন্সটিটিউট অব ফাইন আর্ট থেকে পড়াশোনা শেষ করে পাকিস ানের করাচিভিত্তিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা জে ওয়ালটার থমসনে আর্ট ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। 1972 সালে রশিদ আহমেদ ঢাকাতে কারুকৃত নামে তার নিজের বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন শিল্পের ইতিহাসের সঙ্গে যে কয়েকজন ব্যক্তির নাম সবসময় উচ্চারিত হয় তাদের মধ্যে মরহুম শরফুদ্দিন আহমেদ অন্যতম।

শরফুদ্দিন আহমেদ 60-এর দশকের শুরুতে স্টার এ্যডভার্টাইজিং প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। বিজ্ঞাপন শিল্পে জড়ানোর আগে শরফুদ্দিন আহমেদ একজন সাংবাদিক ছিলেন। স্বাধীনতার পর 1975 সালে তিনি কবি ফজল শাহাবুদ্দিন এবং অভিনেতা হারুন রশিদকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নান্দনিক এ্যডভার্টাইজিং লিমিটেড। নান্দনিক বিজ্ঞাপন জগতে প্রচুর ব্যতিক্রমধর্মী কাজ করেছে। নান্দনিকই সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপন শিল্পে প্রথম রঙিন দৃশ্যের ব্যবহার শুরু করে।

এছাড়া নান্দনিকই প্রথম বাংলাদেশে আন র্জাতিক মানের ট্রাভেলারস চেকের ডিজাইন করে। নান্দনিক তখন অগ্রনী ব্যাংকের হয়ে ট্রাভেলারস চেকের ডিজাইনটি করেছিল। অন্যদিকে মরহুম এনায়েত করিমের নাম বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনী শিল্পের ইতিহাসে স্বর্নারে লেখা রয়েছে। তিনি 60 দশক থেকে মৃতু্যর আগ পর্যন বিজ্ঞাপন শিল্পে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তিনিই প্রথম বিমানের 'যাত্রী' নামক পত্রিকা এবং ক্যালেন্ডার বাংলাদেশের প্রেস থেকে প্রকাশ করেন।

এছাড়া তিনি ডিসপেনসার, সান ভিসর, বান্টিং, ড্যাঙ্গলসহ প্রচুর মাধ্যমের সঙ্গে বিজ্ঞাপনী শিল্পের পরিচয় ঘটান। 80-এর দশকে এনায়েত করিম প্রথম 'টাইড' নামক চার রঙের ইংরেজি ট্যাবলয়েড ম্যাগাজিন বের করেছিলেন। তিনি ছিলেন টাইডের প্রকাশক। 90-এর দশকে তিনি 'সাপ্তাহিক তরঙ্গ' নামে একটি বাংলা ট্যাবলয়েডও বের করেন। এছাড়া বাংলাদেশে ফাস্ট ফুডের দোকান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে তার প্রচুর অবদান রয়েছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.