জাদুনগরের কড়চা
পর্বঃ (!@@!533382) (!@@!533383)
বাংলাদেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা বড় সমস্যা হলো শিক্ষক ও প্রশাসন। শিক্ষক জোগাড়ের ক্ষেত্রে সাধারণত "ট্রফি" হিসাবে দুই একজন বিদেশী পিএইচডি ডিগ্রিধারীকে ৮০ হাজার হতে ১ লাখ বা তার বেশি বেতন দিয়ে নিয়োগ করা হয়। বুকলেট, ব্রোশিওর, এসবে উনার ডিগ্রির উৎসস্থল নিয়ে বিশাল মাতামাতি করা হয়।
বাকি শিক্ষক হচ্ছে কারা? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থায়ী শিক্ষক থাকেনা। বুয়েট, বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের "খ্যাপ" মারা শিক্ষকদের দিয়ে ক্লাস নেয়া হয়।
এটাও ব্রোশিওরে বড় করে উল্লেখ করা হয়।
তবুওতো শিক্ষকদের ক্ষেত্রে গুটি কয় ব্যতিক্রম ছাড়া কিছুটা ভালো অবস্থা আছে। কিন্তু প্রশাসন? অধিকাংশ ভুঁইফোড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনই পরিবার কেন্দ্রিক। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সিন্ডিকেট বা এরকম প্রশাসনিক গোষ্ঠীর সদস্যরা মালিকের ভাই-ভাগ্নে হয়ে পড়ে। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা আলাদা, কিন্তু ঐ ৬-৭টি বাদে বাকি গুলাতে এই দশা।
আর এই প্রশাসন শিক্ষকদের সাথেও রুক্ষ আচরণে সিদ্ধ হস্ত। গুলশান এলাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান যিনি ছিলেন, তাঁর সাথে মন খুলে কথা বলছিলাম। উনি প্রচন্ড হতাশ, আর অপমানিত - চার বছর আগে ঐ সময় তিনি মাসে ৮৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন, কিন্তু তার বিনিময়ে মাছের বাজারের মতো যে বাজে ব্যবহার পেতে হতো, তাতে তিনি আর পেরে উঠছিলেন না। এই ব্যাপারে আমার নিজেরও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে, যা পরের পোস্টে বলবো।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলতি সময়ের হুজুগ যে বিষয়ে, সেটা নিয়েই কোর্স অফার করা হয়ে থাকে।
এতে দোষের কিছু নেই, হাজার হলেও যেটা মানুষে চায়, সেটা তো ওদেরকে দিতে হবে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গালভরা সব কোর্স অফার করে থাকে, যা অনেক সময় ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে খাপ খায় না। উদাহরণ দেইঃ ফার্মগেটের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রিয়াল টাইম সিস্টেমসের ক্লাস নিতে বলা হলো আমাকে। পড়াতে গেলাম তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের, যারা কম্পিউটার ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশল বা বিজ্ঞান বিষয়ে পড়তো। সিলেবাসটি বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হতে কেউ টুকে এনেছে।
যাহোক, কয়েক দিন পরে আমি যখন ক্লাসে বোর্ডে একটা ফটোইলেকট্রিক ডিভাইসের ডায়াগ্রাম এঁকে ব্যাখ্যা করছিলাম যে, এটার মধ্যে যে ট্রানসিস্টর আছে, তার বেইজে আলো পড়লে তার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ বেশি হয়, ফলে এটা তখন অ্যালার্ম চালু করে। ক্লাসের ছেলেপেলে হা করে আছে দেখে, আমি জানতে চাইলাম, সমস্যাটা কোথায়। ওরা জানালো, বেইজ শব্দটা তারা প্রথম শুনছে, কাজেই ওদেরকে আবার কিছু সময় ট্রানজিস্টরের গঠন প্রণালী নিয়ে বললাম। তখনো ওদের বিহবল ভাব দেখে প্রশ্ন করায় ওরা জানালো, জীবনে প্রথম ওরা ট্রানসিস্টরের কথা শুনছে।
(এই উদাহরণটা একটি টেকনিক্যাল হয়ে গেলো, ব্যাখ্যা দেই, ট্রানসিস্টর হলো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশের প্রাণ, এবং এটা ইলেক্ট্রনিক্সের যেকোনো কোর্সের প্রথম পাঠ, যা সাধারণত ১ম বর্ষের ছাত্ররা পড়ে)।
ইলেক্ট্রনিক্স বিষয়ের ৩য় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের মুখে ঐ কথা শুনে তাজ্জব হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা অনেকটা গণিতে অনার্স পড়া কেউ যদি ত্রিভূজ কাকে বলে জানতে চায়, তার মতো। ওদের প্রশ্ন করে জানলাম, ৩য় বর্ষে উঠে গেলেও ওদেরকে ইলেকট্রনিক্সের কিছুই পড়ানো হয়নি (যদিও ওরা ইলেক্ট্রনিক্স ও কম্পিউটার সাইন্স বিভাগের ছাত্র)।
ফার্মগেটের ঐ বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পরে সরকার বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলো, ৬টা বাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাতে ওটাও ছিলো। এখন আবার ফাঁক গলে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে।
ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক মন্ডলীর প্রায় সবাই ছিলো ভবন মালিকের পরিবারের সদস্য।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক আচরণে নিরীহ ছাত্ররা প্রতারিত হয়ে অনেক সময় প্রচন্ড ক্ষেপে উঠে। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির জন্য যেরকম আন্দোলন হয়, সেরকম আন্দোলন অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়েও হতে দেখা গেছে, তবে তা অনেকাংশেই বঞ্চিত ছাত্রদের আন্দোলন। জিগাতলার আশে পাশের এক বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি কিছু ক্লাস নিয়েছিলাম। ওখানে একদিন গিয়ে দেখতে পাই, রীতিমত ভাংচুর চলছে।
ছাত্ররা ইট পাটকেল ছুড়ে কাঁচ ভাংছে, এবং পরের সপ্তাহ খানেক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিলো। অবশ্য কেনো ছাত্ররা ক্ষেপেছিলো, তা সহজেই অনুমেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের "ভবন" বলতে দুইতলা একটি বাসাবাড়ি, আর ক্লাসের অনেক গুলাই হয় দুই গলি পরে আরেক চিপা গলির ভিতরে ৫ তলা একটা ফ্ল্যাট ভবনের ৪র্থ ও পঞ্চম তলায়। বিপুল অংকের নগদ টাকা খরচ করে যদি ছাত্ররা কিন্ডারগার্টেন পর্যায়ের স্থাপনা পায়, তাহলে এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।
অনেক সময় একই ভবনের এক তলায় একটা, অন্য তলায় আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয় আস্তানা গেড়ে আছে।
অনেক সময় কোচিং সেন্টারের বিভিন্ন শহরের শাখার মতো অমুক ইউনিভার্সিটিরও ঢাকা বা চট্টগ্রাম শাখা খোলা হচ্ছে।
সরকারের কী করার আছে? অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা। যাকে তাকে অনুমতি না দেয়া, নিজস্ব ক্যাম্পাস ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে না দেয়া। ধানমন্ডি এলাকার ব্যাঙের ছাতার মতো গজানো বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে ১ বছরের মধ্যে সরিয়ে নিতে বলা। স্থায়ী শিক্ষক ও অস্থায়ী শিক্ষকদের অনুপাত কেমন হবে, তা বেঁধে দেয়া।
সর্বোপরি, কিছু দিন পর পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনুমোদন স্বচ্ছ একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনঃর্বিবেচনা করা।
শিক্ষা একটা পবিত্র বিষয়, সেটাকে পণ্যে পরিণত করে ফেললে ভবিষ্যত ধাবিত হবে অন্ধকারের দিকেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।