আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি করলেই ‌'বখাটে' !

রিজাউলের(রেজাউল) দেখা হলে স্মৃতিটি জাবর কেটে এখনো দুইজন হেসে কুটিকুটি হই। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত ফার্ষ্টবয় ছিলাম। রিজাউল বরাবরই ছিল পেছনের বেঞ্চের ছাত্র। কিন্তু পরীক্ষার হলে সে যে কোন মুল্যে আমার পেছনের বেঞ্চিতেই বসতো। স্কুল ছাড়ার আগ পর্যন্ত এর কোন ব্যতয় হয়নি।

একবার কি হলো,সমাজ পরীক্ষার দিন আমি লিখছি-‌‌'যুদ্ধে হারিয়া শাহজাহান ভাঙ্গিয়া পড়িতেন না। ' পেছনের বেঞ্চিতে তা অনূদিত হলো‌-‌‍'যুদ্ধে হারিয়া শাহজাহান জাঙ্গিয়া পরিতেন না !' সংকটটা আলতাব স্যারের ঈগলের চোখে পড়তে সময় লাগেনি। কিছুক্ষন পরই বাল্যবন্ধুর ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার শূনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি,রিজাউলের কানের লতি নিয়ে ছেলেখেলায় মেতে আলতাব স্যার বলছেন-‌,'ওরে কাঠবানর,টুইকপ্যার (নকল) গেলিও শিক্ষ্যা লাগে !' আসলেও তাই। যে দেশে অন্তত মুখস্ত বিদ্যার ওপর শিক্ষার মান নির্ধারিত হয় সেখানে টোকা-টুকিই তো সেরা অস্ত্র,সেরা প্রতিবাদ। তা এই প্রতিবাদের খপ্পরে পড়ে আমার অবস্থাও হয়েছিল ত্রাহি ত্রাহি ! তখন সিক্সে পড়ি।

বার্ষিক পরীক্ষার আগে জ্বরে ভুগলাম টানা ১৫ দিন। বিজ্ঞানের প্রস্তুতি ভাল ছিল না,বিধায় আগের রাত্রেই নিউটনের আপেল পড়ার গল্পটি ডান উরুতে লিখে নিলাম। সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই চোখ ছানাবড়া ! বিছানার চারপাশে লাইন করে দাড়িয়ে ভিনগ্রহের প্রাণী দেখার চোখে আমায় দেখছিল গোটা পরিবার। ‌'নাক টিপলি এহুনো দুধ বাড়ায়,অথচ বখাটেপনার একশেষ'-ছোট কাকার কটুক্তি। ঘটনার আকষ্মিকতায় তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।

পরে ছোট বোনের কাছ থেকে জানলাম-সকালে ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে 'নিউটনের আপেল'কে দেখে ফেলে আম্মা। ঘুমের ঘোরে ছিলাম,তাই উরুর একাংশ বেরিয়ে ছিল। এতে আমার কোন দোষ ছিল না। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের চরিত্র 'সাধু কাঁলাচাঁদ'ও তো মাধ্যমিকে এভাবেই টুকতে গিয়েছিল। ‘...প্রথম তিনটে আনসারের শুধু মুখটুকু বাঁ ঊরুতে পরিষ্কার করে লিখে নিল।

আলগোছে হাঁটতে হবে। বসতে হবে। পাছে ধুতির ঘষায় উঠে যায় লেখাগুলো। ভাল করে কাচানো পুরনো ধুতি। ট্রেসপেপারের মতোই কাপড় ফুঁড়ে লেখাগুলো উঠে আসবে।

গ্রামারের কয়েকটা ছাক্কা জিনিস লিখতে লিখতে ডান পায়ের ঊরু ভরে গেল। ...বাঁ ঊরুতে চলে আসতে হল কালাচাঁদকে। ...আবার ভূগোলের জন্যও তো কিছুটা জায়গা রাখা দরকার। ’ যদিও পরীক্ষার হল-এ, টোকার সময় বাইরেটা মেঘলা হয়ে আসায়, খুব ভাল করে দেখা যায়নি উত্তরগুলো। তখন কালাচাঁদকে ধুতিটা অনেকটা তুলতে হয়েছিল, গার্ডকে বলতে হয়েছিল, ‘খুব খারাপ জায়গায় ফোঁড়া হয়েছে স্যার।

’ আমার এক বান্ধবি অবশ্য ওসব ‌ফোঁড়া-টোরার ধার ধারেনি। সে টোকাটুকিকে একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া হিসেবে নিয়েছিল। সে গ্যাসট্রিকে আক্রান্ত। এটা সবাই জানত। প্রায়ই তার গ্যাসট্রিকের ব্যথা ও ডাক্তার-বদ্যির ইতিহাস সে ইস্কুলে ফলাও করে বলত।

সব্বাই টিফিনে ভেলপুরি খেলেও সে কক্ষনও দাঁতে কাটত না। তাই পরীক্ষায় বসলেও তার পাশে থাকত পানির বোতল আর বিস্কিটের প্যাকেট। মেয়েটা একটা করে প্রশ্ন লেখে আর হাতে ধরে রাখা বিস্কুটটা খেয়ে নেয়। কেউ জানতেও পারে না প্রতিটা বিস্কিটের উলটো দিকে পেনসিলে লেখা আছে উত্তর ! লেখাটি তৈরির আগে কয়েক জনকে প্রশ্ন করেছিলাম, জীবনে নকল করেছ ? প্রশ্ন শুনেই এক বন্ধু দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠলো। না, সে নিজে নিতান্ত ক্যাবলাকান্ত ছিল বলে কষ্মিনকালেও ও-সব অপকম্ম করতে পারেনি, কিন্তু দু-এক জন বান্ধবীকে যা করতে দেখেছে, তাতেই সে নারীজাতির ওপর খড়্গহস্ত।

এই সব বান্ধবীরা সরল সরল মুখ করে পরীক্ষার সময় শাড়ি পরে আসত আর শরীরের বিপদজ্জনক সব খাঁজে টুকলি-কাগজ সেঁটে রাখত। ওইসব 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু' জয় করা সম্ভব নয় দেখে গার্ডেরা তাই রথ দেখার আনন্দে মেয়েদের কলা বেচতে দিতেন। এবার আসি মুল বিষয়ে,টুকলি কি ও কেন ? এটা এমন একটা উপায় যা আপনাকে দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। এই কাণ্ডটি করলে পরীক্ষক ধরে, পুলিশ ধরে, নিউজ চ্যানেলের ক্যামেরা ধরে এবং বাবা-মা জানলে ইমেজে ফাংগাস ধরে। কিন্তু না ধরতে পারলে, টুকলির মতো বন্ধু আর জগতে নেই।

টুকলি হল ১২ বছরের বিবাহিত জীবন পেরিয়ে এসে কলেজের একটা ষোড়শী মেয়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করে নিশ্বাস নেওয়ার মতো। মুখস্থ করাটাকে গুণ ধরা হয়। নকল করা দোষ। আমার বন্ধু ইমন ছয়টা চিঠি মুখস্থ করে গিয়েছিল, কমন পড়েনি একটাও। চিঠি লিখতেই পারল না।

কিন্তু আমার চাচাত বোন মাধ্যমিকে অঙ্ক সব মুখস্থ করে (রাফ সহ) লিখে এসে পাশ করে, ভাল মেয়ের তকমা পেল। আর আমি তো আগে থেকেই 'বখাটে' নিউটনের আপেল সমেত ধরা পড়ে ! কিন্তু এটার বাইরে তো আর কিছুই টুকিনি! সে জন্য সাধুবাদ পাব না? তার মানে এমন নয় যে বাকি সব প্রশ্নে আমি দ্বিগ্গজ। আসলে আমি যে স্কুলে পড়তাম সেখানে চোখের জ্যোতি ভাল থাকলেই পাশ। ক্লাসে ঢুকতেই দরজার বাঁ পাশে- ‌'মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ'। ডান পাশে-পিথাগোরাসের উপপাদ্য।

আর গোটা রুমের কোথাও ঝুলছে মাইটোকন্ড্রিয়া,কোথাও কারক ও বিভক্তি,আবার কোথাও বা বীজগনিতের একতাড়া সুত্র ! আসলে টুকলির এত পদ্ধতি আছে যে,তা নিয়ে রীতিমতো মহাকা্ব্য লিখে ফেলা যায়। এর এত কায়দা, রকমফের, দুঃসাহস, ভাবলেও রোমাঞ্চ হয়। একটা স্কেলের পেছনে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছ’টা সাবজেক্টের ষোলোটা উত্তর,ভাবুন একবার ! আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার আগে কত ছেলের হাত-পা কেটে যেত ! শরীরে ইতিউতি ব্যান্ডেজ। একটা আঙুলে পেঁচিয়ে আছে গোটা ইউরোপের ইতিহাস। কেউ ফুলহাতা জামা পরে দু’স্টেপ হাতা মুড়ে তার মধ্যে মুড়ে রেখেছে ব্যাঙের প্রজনন কিংবা ২৩ জোড়া ক্রোমোজাম, গার্ড কাছে এলে বা দূরে গেলে জামা ভাঁজ হচ্ছে আর ভাঁজ খুলছে— এ সব তো অল্পবিস্তর সকলেই করেছি।

ঘড়ির ব্যান্ডের তলায় যদি টুকলি পাকিয়েই না রাখা থাকবে, তবে আর ঘড়ি পরা কেন? হল-এ তো বিরাট ঘড়ি ঝোলানোই আছে! আমার এক সিনিয়র ভাই আবার সঙ্গে করে টুকলির সূচিপত্র করে নিয়ে যেত, নইলে পিলপিল করা অত কাগজ কোথায় কী লুকিয়েছে, তা বেমালুম ভুলে যাবে বলে। আর এক জন এতশত ঝঞ্ঝাটের পক্ষপাতী ছিল না। পরীক্ষা শুরু হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই প্রচুর লুজ পেপার নিত, আর নিজের ডেস্কটাকে পেনসিল-বক্স, জ্যামিতি-বক্স, স্কেল,প্রেয়সীর ছবি,একটা গোলাপ ফুল ও লুজ পেপার মিলিয়ে একেবারে আঁস্তাকুড় বানিয়ে ফেলত। তার পর তার ফাঁকে সাজিয়ে নিত টুকলি। কোন কোন বন্ধু তার সঙ্গে আঁতাত করে, উত্তর লিখত ।

তার পর দু’জনেই খাতা মেঝেয় ফেলে দিয়ে, তোলার সময় বিনিময় করে নিত। অবশ্য খাতা জমা দেওয়ার আগে ফের এক বার এক্সচেঞ্জ করতে না পারলে ফেল ! পাতা বিনিময়ের অবশ্য একটা বড় বিপদ আছে। সপ্তম শ্রেনীতে আমাদের ফার্স্ট বয়ের লুজ পেপার এক বার সে তার সামনের ছেলেকে দিয়েছে। সেখান থেকে নিয়েছে তার সামনের ছেলেটা। এ ভাবে রিলে হতে হতে সেই পাতা কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না।

পরীক্ষার শেষে, খাতা জমা দেওয়ার সময় উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় কাঁদো কাঁদো সুরে ফার্ষ্টবয়ের মিনতি, ‘ভাই , আমার কাগজটা দিয়ে দে’। আর ঘরের ও-ই কোণ থেকে এক জন বলছে ‘এই নে, থ্যাংকিউ !' বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এক জন আবার দর্শনশাস্ত্রের পরীক্ষা দিতে গিয়ে আবিষ্কার করে, গোটা সিলেবাসটাই তার অজানা। তখন সামনের ছেলেটিই ভরসা। সে বেশ জানেটানে। ছেলেটি বাংলায় লেখে, আর সেটা দেখে ওই অসহায় পাবলিক ইংরেজিতে লেখে।

হুবহু এক। রেজাল্ট বেরোবার পর দেখা গেল ছেলেটি বাংলায় লিখে যা পেয়েছে, অনুবাদকটি ইংরেজি তর্জমা করে ছ’নম্বর বেশি পেয়েছে ! ‘বাড়িতে বাবা-মা স্কুল-টিচার হলে পরবর্তী প্রজন্ম পরীক্ষা-প্রতিবন্ধী হয়’— কথাটি সুকুমার সেনই বলে গেছেন। বাবা-মা বাড়ি এসে টুকলি ধরে ফেলার নানা ঘটনা রং চড়িয়ে বলেন। প্রমাণ করে ছাড়েন তিনিই সেরা শার্লকহোমস কুল শিরোমনি। আর তাতেই মিইয়ে যায় তাঁদের সন্তান।

সে পরীক্ষার হল-এ নার্ভাস হয়ে ব্রহ্মতালু চুলকে মরে আর তার সামনেই একটা ছেলে জাদুকর পি সি সরকারের মতো এ দিক ও দিক হাত ঘুরিয়ে নানান কাগজ বার করে আনে, আর তাদের সদ্ব্যবহার করে, চিবিয়ে বেমালুম খেয়ে ফ্যালে। ওর কারবার হাঁ করে দেখতে দেখতে শিষ্ট সন্তানের খাতা সাদা পড়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পরীক্ষার সময় বাথরুমে গেলে মেঝে দেখা যেত না, শুধু ঝরা পাতার মতো মাইল মাইল টুকলি পড়ে আছে। একটি ছেলে এক বার বাথরুমে দিয়ে পকেট থেকে চোতা বের করে, খুব ভাল করে পড়ে, ঘিচিমিচি পাকিয়ে, হিসি করার জায়গায় ফেলে দিয়ে চলে এসেছে। লিখতে গিয়ে মাঝপথে দেখে, একটা ফর্মুলা কিছুতেই মনে পড়ছে না।

ফের বাথরুমে যাওয়ার প্রার্থনা, আর প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে সেই ঘেন্নার কাগজকেও জীবনতরী পারি দেয়ার ফর্মুলা ভেবে দেখে। তবে এই নিয়ে খ্যাপালে তার জবাব ছিল, ‘না রে, ওইটুকু সময়ের মধ্যে অন্য কেউ ওখানে জলবিয়োগ করেনি!’ এই সুযোগে টুকলির একটা দুর্ধর্ষ রেসিপি বলে দেই-‌'প্রথমে কালির পেনের সব কালি ফেলে পেনটাকে ভাল করে পানিতে ধুয়ে খটখটে করে শুকিয়ে নিন। অন্য দিকে পাতিলেবু কেটে তার রসটা ছেঁকে একটা পাত্রে রাখুন। এর পর ওই রসটা খুব সাবধানে কলমের মধ্যে ঢালুন। তার পর একটা সাদা কাগজে মনে না-থাকা উত্তরগুলো লিখতে থাকুন এবং তার পরেও ওই সাদাই থেকে যাওয়া কাগজটা পকেটে পুরে নির্ভয়ে চলে যান পরীক্ষা দিতে।

প্রশ্ন কমন পড়লে, ঘেমে যাওয়া অন্য হাতের ওপর সেঁটে দিন কাগজটা, সব লেখা স্পষ্ট পড়ে গরম গরম লিখে ফেলুন। টুকলি কেন এল বুঝতে গেলে অবশ্য তার প্রেক্ষিতটা বিশ্লেষণ করতে হবে। বাঙ্গালীর আটপৌরে জীবনে সর্বনাশের মূলে মুখস্থ-বিদ্যের জয়জয়কার। সিলেবাস নিয়ে কারও কোনও আগ্রহ নেই, জানার জন্য পড়াশোনা কেউ করলে তো তার নাম স্রেফ ডাইনোসর, পরীক্ষার্থীর কাজ শুধু টেস্ট পেপার থেকে প্রশ্ন ছেঁকে নেওয়া। ধরা যাক: আপনি ২০১৪-য় মাধ্যমিক দেবেন।

চোখ বুজে ’১৩-র প্রশ্ন বাদ। ’১১-র যে সব প্রশ্ন ’১৩-তে এসেছে, সেগুলোও বাদ। হাতে রইল ’১২-র প্রশ্ন আর ’১১-র পড়ে থাকা প্রশ্নগুলো। এই বার এদের উত্তর আমি ঝাড়া মুখস্থ করবেন। এটাই শিক্ষা।

শিক্ষিত হওয়ার প্রসেস। অথচ এই প্রসেসে পা দিয়ে টুকলিকে ব্রক্ষাস্ত্র বানিয়েও আমি আর রিজাউলের কেউই বেশিদুর এগুতে পারিনি। কিন্তু অনেক বাঘা বাঘা লোকজন আজকাল টুকলিতে পারি দিয়েই তারকা। এখন গান অবধি হুবহু টোকা হয়। হলিউডের মাল বলিউডে,সেখান থেকে টালিউডে তারপর উচ্ছিষ্ট বলে কিছু থাকলে সেটাও নকল হয় ! হুঁম, ঠিকই ধরেছেন ঢালিউডে ! বড় বড় শিল্পীরা ফাংশনে সিডি চালিয়ে ঠোঁট নাড়েন, মাইক হাতে নেন শুধু থ্যাঙ্ক ইউ বলার জন্য।

এগুলো কি নকলের জ্ঞাতি ভাই নয় ? সুকান্তই তো বলেছেন, ‘পড়ায় একটু টোকে বলে খোকার পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব চোতা মেরে লক্ষ টাকা ভাগ করো— সেই বেলা?’ প্রখ্যাত দার্শনিক বেনথ্যাম বলেছেন, যে দেশে মুখস্থ বিদ্যার ওপর শিক্ষার মান স্থির হয়, সেখানে টুকলিই সেরা অস্ত্র, সেরা প্রতিবাদ। শেলি বলেছেন: পড়িলে টুকিতে হবে সব মুখস্থ কার কবে অতি স্থির কোন বীর হায় রে পরীক্ষার হলে। এমনকী, যুব সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করতে প্রখ্যাত দার্শনিক, সাহিত্যিক এন কে সলিলও কলম ধরেছিলেন: টোকাবাবু যায়, চোতা সাঁটা পায় পরীক্ষক হলে বসে আকাশে তাকায়। বন্ধুগণ, এ বার আসি মূল বিষয়ে, টোকা কী ও কেন? টুকলি হইল এমন এক উপায় যা আপনাকে দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। শহরে যেমন মেট্রো রেল।

সবাই যখন ঘেমে-নেয়ে জ্যামজটে অস্থির হয়ে আপিসে যায় তখন মাটির তলা দিয়ে এক দল লোক গুড়গুড় করতে করতে অনেক আগেই দফতরে পৌঁছে চাউমিন সাঁটায়। কেউ কেউ আবার আরও দ্রুত যাবে বলে এসকেলেটরে উঠেও দৌড়য়। কিন্তু ওগুলো বৈধ, সরকারি অনুদান-সমৃদ্ধ। আর টুকলি হল অবৈধ। এই কাণ্ডটি করলে পরীক্ষক ধরে, পুলিশ ধরে, নিউজ চ্যানেলের ক্যামেরা ধরে এবং বাবা-মা ইত্যাদি জানলে ইমেজে ফাংগাস ধরে।

কিন্তু না ধরতে পারলে, টুকলির মতো বন্ধু আর জগতে নেই। টুকলি হল ১২ বছরের বিবাহিত জীবন পেরিয়ে এসে কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের একটা মেয়ের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করে নিশ্বাস নেওয়ার মতো। টুকলির মূল অস্ত্র: চোতা। চোতা কেন এল বুঝতে গেলে অবশ্য তার প্রেক্ষিতটা আচ্ছাসে বিশ্লেষণ করতে হবে। বঙ্গজীবনের সর্বনাশের মূলে মুখস্থ-বিদ্যের জয়জয়কার।

সিলেবাস নিয়ে কারও কোনও আগ্রহ নেই, জানার জন্য পড়াশোনা কেউ করলে তো তার নাম ডাইনোসর, পরীক্ষার্থীর কাজ স্রেফ টেস্ট পেপার থেকে প্রশ্ন ছেঁকে নেওয়া। ধরা যাক: আমি ২০১৪-য় মাধ্যমিক দেব। চোখ বুজে ’১৩-র প্রশ্ন বাদ। ’১১-র যে সব প্রশ্ন ’১৩-তে এসেছে, সেগুলোও বাদ। হাতে রইল ’১২-র প্রশ্ন আর ’১১-র পড়ে থাকা প্রশ্নগুলো।

এই বার এদের উত্তর আমি ঝাড়া মুখস্থ করব। এটাই শিক্ষা। এটাই শিক্ষিত হওয়ার প্রসেস। মুখস্থ করাটাকে গুণ ধরা হয়। চোতা দোষ।

আমার বন্ধু সুদীপ ছ’টা চিঠি মুখস্থ করে গিয়েছিল, কমন পড়েনি একটাও। চিঠি লিখতেই পারল না। আমার দিদি মাধ্যমিকে অঙ্ক সব মুখস্থ করে (রাফ সহ) লিখে এসে পাশ করে গেল, ভাল মেয়ের তকমা পেল। আমি মাধ্যমিকে ‘সকল ক্ষারই ক্ষারক, কিন্তু সব ক্ষারক ক্ষার নয়’-এর ব্যাখ্যা চোতায় লিখে নিয়ে গেলাম বলে ‘বখাটে’ লেবেল পেয়ে গেলাম! বাঃ, এটার বাইরে আর কিছুই যে টুকিনি! সে জন্য হাততালি পাব না? তার মানে এমন নয় যে বাকি সব প্রশ্নে আমি দিগ্গজ। আসলে আমি যে স্কুলে পড়তাম সেখানে চোখ ভাল থাকলেই পাশ।

প্রতি ঘরের দেওয়ালে সব কিছুর উত্তর লেখা। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের এতগুলো কারণ লেখা ছিল, আওরঙ্গজেবের চোখে পড়লে তিনিও লজ্জা পেতেন। আসল কথা, সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই চোতার তাৎপর্য খুঁজতে হবে। যার পেল্লায় মুখস্থের ক্ষমতা নেই সে কী করবে? মায়ের পেটের মধ্যে যখন মাথা-টাথা তৈরি হচ্ছিল তখন ব্রেনটা কোন দিকে তেড়েবেঁকে গেছে সে তো আর তার হাতে ছিল না। একে তো সে মুখস্থ করতে পারবে না বলে কোনও দিন মেগা-সিরিয়ালে পার্ট পাবে না।

তাই বলে পরীক্ষায় পাশ করার অধিকারও নেই? এমন নয় যে সে লেখাপড়ার টাচে নেই। ইতিহাস পরীক্ষায় তো ভূগোলের চোতা নিয়ে যাচ্ছে না। রীতিমত প্রশ্ন আন্দাজ করে, রাত জেগে ছোট ছোট হরফে পুরোটা লিখে, সকালে বেরোবার আগে ঘরের দরজা বন্ধ করে সেগুলোকে বিভিন্ন জায়গায় লুকিয়ে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তবে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। তাই তার প্রতি অমানবিক হওয়া মোটে ভাল না। এই বার আসলি ব্যাপার।

অর্থাৎ, চোতা মারার কায়দাকানুন বা রীতিপদ্ধতি। এর এত কায়দা, রকমফের, দুঃসাহস, ভাবলেও রোমাঞ্চ হয়। হারমোনিয়াম-চোতায় ছোট কাগজকে বেলো-র মতো ভাঁজ করে করে বিশাল বানিয়ে তাতে উত্তর লেখা হচ্ছে, কোথাও একটা স্কেলের পেছনে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছ’টা সাবজেক্টের ষোলোটা উত্তর। তবে এ আর্টে রাজা সরকারের মতো আনাড়ির স্থান নেই। কী করেছিল রাজাদা? আমি তখন জীবনবিমার এজেন্ট।

লোককে টুকটাক মৃত্যুভয় দেখাই আর হাতখরচের টাকা উঠে আসে। এক বার বিমা কোম্পানি জানাল, সব এজেন্টদের পরীক্ষা দিতে হবে। আমি আর রাজাদা গেলাম পরীক্ষা দিতে। আমাদের চেয়েও টেনশনে আমাদের ডেভেলপমেন্ট অফিসার। রাজাদা আমার পিছনে বসে।

পরীক্ষা শুরু হলে আমি লেখা শুরু করলাম। সিম্পল প্রসেস: অফিসার এসে উত্তর বলেন, আমি লিখি, আমার দেখে রাজাদা লেখে। প্রথমে নাম, তার পর বাবার নাম, ঠিকানা, এটা-ওটা। পরীক্ষার ক’দিন পর খাতা নিয়ে হাজির ওই অফিসার। দেখা গেল রাজাদা নিজের নাম ছাড়া সব টুকেছে।

আমার বাবা-ঠিকানা সব এক। এই লেখা তৈরির জন্য কয়েক জনকে প্রশ্ন করেছিলাম, জীবনে চোতা মেরেছ? প্রশ্ন শুনেই এক জনের মনে লিঙ্গবৈষম্যের ঢেউ উঠল। কী ব্যাপার? না, সে নিজে নিতান্ত ক্যাবলা আর ভিতু ছিল বলে কোনও কালেই ও-সব অপকম্ম করতে পারেনি, কিন্তু দু-এক জন বান্ধবীকে যা করতে দেখেছে, তাতেই সে নারীজাতির ওপর খড়্গহস্ত। এই সব বান্ধবীরা সরল সরল মুখ করে পরীক্ষার সময় শাড়ি পরে আসত আর শরীরের বেশ কিছু বিপজ্জনক জায়গায় টুকলি-কাগজ সেঁটে রাখত। বিপজ্জনক জায়গা মানে, যিনি সন্দেহবশে সার্চ করবেন, তিনি বিপদে পড়ে যেতে পারেন।

পরীক্ষার গার্ড বয়স্ক অধ্যাপকেরা আর কী করেন, রথ দেখার আনন্দে মেয়েদের কলা বেচতে দিতেন। ছেলেরা ধুতি পরলে অবশ্য একটু ঘুরিয়ে এই গোছের সুবিধে নিতে পারত। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের চরিত্র ‘সাধু কালাচাঁদ’ মাধ্যমিকে এ ভাবে টুকতে গিয়েছিল। ‘...প্রথম তিনটে আনসারের শুধু মুখটুকু বাঁ ঊরুতে পরিষ্কার করে লিখে নিল। আলগোছে হাঁটতে হবে।

বসতে হবে। পাছে ধুতির ঘষায় উঠে যায় লেখাগুলো। ভাল করে কাচানো পুরনো ধুতি। ট্রেসপেপারের মতোই কাপড় ফুঁড়ে লেখাগুলো উঠে আসবে। গ্রামারের কয়েকটা ছাক্কা জিনিস লিখতে লিখতে ডান পায়ের ঊরু ভরে গেল।

...বাঁ ঊরুতে চলে আসতে হল কালাচাঁদকে। ...আবার ভূগোলের জন্যও তো কিছুটা জায়গা রাখা দরকার। ’ যদিও পরীক্ষার হল-এ, টোকার সময় বাইরেটা মেঘলা হয়ে আসায়, খুব ভাল করে দেখা যায়নি উত্তরগুলো। তখন কালাচাঁদকে ধুতিটা অনেকটা তুলতে হয়েছিল, গার্ডকে বলতে হয়েছিল, ‘খুব খারাপ জায়গায় ফোঁড়া হয়েছে স্যর। ’ ফোঁড়া ছাড়াও অন্য অসুখ টোকার অ্যাসিস্ট্যান্ট হতে পারে।

এক জন মেয়ের কথা শুনলাম, সে টোকাটাকে একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া হিসেবে নিয়েছিল। সে গ্যাসট্রিকে আক্রান্ত। এটা সকলে জানত। প্রায়ই তার গ্যাসট্রিকের ব্যথা ও ডাক্তার-বদ্যির ইতিহাস সে ইস্কুলে ফলাও করে বলত। সব্বাই টিফিনে আলুকাবলি খেলেও সে কক্ষনও দাঁতে কাটত না।

তাই পরীক্ষায় বসলেও তার পাশে থাকত জল আর বিস্কুটের প্যাকেট। মেয়েটা একটা করে প্রশ্ন লেখে আর হাতে ধরে রাখা বিস্কুটটা খেয়ে নেয়। কেউ জানতেও পারে না প্রতিটা বিস্কুটের উলটো দিকে পেনসিলে লেখা আছে উত্তর। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার আগে কত ছেলের হাত-পা কেটে যেত! শরীরের ইতিউতি ব্যান্ডেজ। একটা আঙুলে পেঁচিয়ে আছে গোটা ইউরোপের ইতিহাস।

কেউ ফুলহাতা জামা পরে দু’স্টেপ হাতা মুড়ে তার মধ্যে মুড়ে রেখেছে ব্যাঙের প্রজনন, গার্ড কাছে এলে বা দূরে গেলে জামা ভাঁজ হচ্ছে আর ভাঁজ খুলছে— এ সব তো অল্পবিস্তর সকলেই করেছি। ঘড়ির ব্যান্ডের তলায় যদি চোতা পাকিয়েই না রাখা থাকবে, তবে আর ঘড়ি পরা কেন? হল-এ তো বিরাট ঘড়ি ঝোলানোই আছে! আমার এক সিনিয়র দাদা আবার চোতার সূচিপত্র করে নিয়ে যেত, নইলে পিলপিল করা অত কাগজ কোথায় কী লুকিয়েছে, তা বেমালুম ভুলে মেরে দেবে। আগে, যখন সকলে ফাউন্টেন পেনেই পরীক্ষা দিত, সঙ্গে করে অনেকেই নিয়ে যেত কালির দোয়াত। একটি জিনিয়াস তার দোয়াতের প্যাকেটের একটা দিক কেটে সরিয়ে নিত। আর সেখানে, একটা দেশলাই কাঠি সেট করে, সেটাকে স্পুল বানিয়ে জড়িয়ে রাখত চোতাগুলো।

এ বার, যত দুঁদে গার্ডই হোন না কেন, তিনি তো আর ত্রিমাত্রিক বস্তুর সবক’টা দিক এক বারে দেখতে পাচ্ছেন না! ছেলেটি গার্ড যে দিকে যাচ্ছেন সেই অনুযায়ী প্যাকেটটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাখত, আর সুবিধেমত চোতা দেখে উত্তর লিখত। আর এক জন এতশত ঝঞ্ঝাটের পক্ষপাতী ছিল না। পরীক্ষা শুরু হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই প্রচুর লুজ পেপার নিত, আর নিজের ডেস্কটাকে পেনসিল-বক্স, জ্যামিতি-বক্স, স্কেল, মা কালীর ছবি, দুটো শুকনো জবা ফুল, গুচ্ছের লুজ পেপার মিলিয়ে একেবারে আঁস্তাকুড় বানিয়ে ফেলত। তার পর তার ফাঁকে সাজিয়ে নিত চোতা। কেউ কেউ বন্ধুর সঙ্গে সাঁট করে গিয়ে, এ কয়েকটা উত্তর লিখত, ও কয়েকটা।

তার পর দু’জনেই খাতা ‘এ বাবা’ বলে মেঝেয় ফেলে দিয়ে, তোলার সময় এক্সচেঞ্জ করে নিত। অবশ্য খাতা জমা দেওয়ার আগে ফের এক বার এক্সচেঞ্জ করতে না পারলে কেলো! এই এর কিছু পাতা ওর কাছে যাওয়ার একটা বড় বিপদ আছে। আমাদের ফার্স্ট বয়ের লুজ পেপার এক বার সে তার সামনের ছেলেকে দিয়েছে। তার থেকে কখন নিয়ে নিয়েছে তার সামনের ছেলেটা। এ ভাবে রিলে হতে হতে সেই পাতা কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না।

পরীক্ষার শেষে, খাতা জমা দেওয়ার সময় ফার্স্ট বয় উঠে দাঁড়িয়ে ডেসপারেট হয়ে চেঁচাচ্ছে, ‘ওরে, আমার কাগজ কই’ আর ঘরের ও-ই কোণ থেকে এক জন বলছে ‘এই নে, থ্যাংকিউ’, দৃশ্য দেখে আমাদের ভালমানুষ গার্ড-স্যরের হেঁচকি উঠে একাকার। এক জন আবার দর্শনশাস্ত্রের পরীক্ষা দিতে গিয়ে আবিষ্কার করে, গোটা সিলেবাসটাই তার অজানা। তখন সামনের ছেলেটিই ভরসা। সে বেশ কিছু জানেটানে। ছেলেটি বাংলায় লেখে, আর সেটা দেখে এই অসহায় পাবলিক ইংরেজিতে লেখে।

হুবহু এক। রেজাল্ট বেরোবার পর দেখা গেল ছেলেটি বাংলায় লিখে যা পেয়েছে, অনুবাদকটি ইংরেজি তর্জমা করে ছ’নম্বর বেশি পেয়েছে। আমার আর এক বন্ধু এক সময় শিক্ষকতা করত। এক বার গার্ড দিতে বসে সে এক ছাত্রের শার্ট দেখে মুগ্ধ! এক রঙের জামা, কিন্তু রোদ পড়লে নানান রঙিন গোল গোল আভা দেখা যাচ্ছে। খানিক বাদে বোঝা যায় ওটা ডিজাইন নয়।

মার্বেল পেপার কেটে সাঁটানো আর তার উল্টো দিকে যাবতীয় উত্তর-ভাণ্ডার। ওই যে কালাচাঁদের কথা বলছিলাম, সে এমন টুকলি এক্সপার্ট ছিল, শিক্ষকেরা তাকে দেন টুকলি ধরার কাজ। প্রথম দিনেই সে একাশি জনকে ধরে ত্রাহি ত্রাহি রব ফেলে দেয়। স্কুলের অ্যাফিলিয়েশন না এ বার কাটা যায়! এমন শিক্ষকের কথা শুনেছি, গার্ড দেওয়ার সময় মুখের সামনে তুলে ধরে খবরের কাগজ পড়ছেন, এ দিকে তার মধ্যে দুটো ফুটো করা আছে, তাই দিয়ে গোটা হলের ওপর নজর রাখছেন। এক জন গার্ড দেওয়ার সময় কক্ষনও স্ট্রেট লাইনে হাঁটতেন না।

এই বোঁ করে পিছনে ঘুরে যাচ্ছেন, এই টেবিলের সামান্য ফাঁক দিয়ে সুড়ুৎ করে পাশের লেন-এ চলে যাচ্ছেন। আর এক জন টিচার গার্ড দেওয়ার দিন পরে আসতেন মায়ের ছানি-অপারেশনের কালো চশমা। বছরে দু’বার তাঁর এই চশমা পরার সময় আসত: পরীক্ষা আর জয়বাংলার সিজন। ‘বাড়িতে বাবা-মা স্কুল-টিচার হলে পরবর্তী প্রজন্ম পরীক্ষা-প্রতিবন্ধী হয়’— বলেছেন সুকুমার সেন। বাবা-মা বাড়ি এসে টুকলি ধরে ফেলার নানা ঘটনা রং চড়িয়ে বলেন।

প্রমাণ করে ছাড়েন তিনিই সেরা ব্যোমকেশ। আর তাতেই বোম্কে যায় তাঁদের সন্তান। সে পরীক্ষার হল-এ নার্ভাস হয়ে ব্রহ্মতালু চুলকে মরে আর তার সামনেই একটা ছেলে পি সি সরকারের মতো এ দিক ও দিক হাত ঘুরিয়ে নানান কাগজ বার করে আনে, আর তাদের সদ্ব্যবহার করে, চিবিয়ে বেমালুম খেয়ে ফ্যালে। ওর কারবার হাঁ করে দেখতে দেখতে শিষ্ট সন্তানের খাতা সাদা পড়ে থাকে। জুতোয়, মোজায়, কলারের ভাঁজে, পেনসিল-বাক্সে কাগজ লুকনো, ক্লিপবোর্ডে উত্তর লিখে নিয়ে যাওয়া, এমনকী অ্যাডমিট কার্ডের পিছনে থিয়োরেম— এগুলো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট যুগের।

আমাদের স্কুলের ছেলেরা হালকা হাওয়াই-এর মাঝখানে দেশলাই বাক্সের মতো জায়গা বার করে, কিংবা ডটপেনের রিফিলের চার পাশের শূন্যতাকে ভরাট করে, কিংবা স্টেপ্লারের হাফ পিন বার করে, তার মধ্যে চোতা লুকোত। এখন তো মোজায় মোবাইল ভরা থাকে। আমাদের স্কুলে পরীক্ষার সময় বাথরুমে গেলে মেঝে দেখা যেত না, শুধু ঝরা পাতার মতো মাইল মাইল চোতা পড়ে আছে। একটি ছেলে এক বার বাথরুমে দিয়ে পকেট থেকে চোতা বের করে, খুব ভাল করে পড়ে, ঘিচিমিচি পাকিয়ে, হিসি করার জায়গায় ফেলে দিয়ে চলে এসেছে। লিখতে গিয়ে মাঝপথে দেখে, একটা ফর্মুলা কিছুতেই মনে পড়ছে না।

ফের বাথরুমে যাওয়ার প্রার্থনা, আর প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে সেই ঘেন্নার কাগজই কোনও রকমে দু’আঙুলে তুলে ফর্মুলা দেখা। তবে এই নিয়ে খ্যাপালে তার জবাব ছিল, ‘না রে, ওইটুকু সময়ের মধ্যে অন্য কেউ ওখানে হিসি করেনি!’ ও, এই সুযোগে ‘সাইন্টিফিক চোতা’র একটা দুর্ধর্ষ রেসিপি এখানে বলে দিই, কতকটা টিভির রান্নার অনুষ্ঠানের স্টাইলে— প্রথমে কালির পেনের সব কালি ফেলে পেনটাকে ভাল করে জলে ধুয়ে খটখটে করে শুকিয়ে নিন। অন্য দিকে পাতিলেবু কেটে তার রসটা ছেঁকে একটা পাত্রে রাখুন। এর পর ওই রসটা খুব সাবধানে পেনের মধ্যে ঢালুন। তার পর একটা সাদা কাগজে মনে না-থাকা উত্তরগুলো লিখতে থাকুন এবং তার পরেও ওই সাদাই থেকে যাওয়া কাগজটা পকেটে পুরে নির্ভয়ে চলে যান পরীক্ষা দিতে।

প্রশ্ন কমন হলে, ঘেমে যাওয়া অন্য হাতের ওপর সেঁটে দিন কাগজটা, সব লেখা স্পষ্ট পড়ে গরম গরম লিখে ফেলুন। এক বার আমাদের ক্লাসের বাঘার পকেট থেকে একটা চোতা বেরিয়ে ছিল, এস টি ডি বুথের স্লিপের মতো সরু, দ্রৌপদীর শাড়ির চেয়েও লম্বা। আবার তন্ময় ছিল বিশ্ব-কুঁড়ে, নিজে হাতে চোতা লিখতেও আলিস্যি। বোনকে দিয়ে লেখাত, আর পরীক্ষা দিতে বসে হাতের লেখা উদ্ধার করতে না পেরে একে ওকে পড়ে দিতে বলত, আর দাঁত কিড়মিড় করে বোনকে গালাগাল দিত। তন্ময় আর বাঘা চোতার কল্যাণে বেশি দূর উঠতে পারেনি, কিন্তু অনেক বাঘা বাঘা লোকজন আজ চোতা করেই কাপ্তেন।

আজ গান অবধি হুবহু টোকা হয়। সাউথের ছবি বাংলায় এনে ফ্রেম টু ফ্রেম টোকা হচ্ছে। বড় বড় শিল্পীরা ফাংশনে সিডি চালিয়ে ঠোঁট নাড়েন, মাইক হাতে নেন শুধু থ্যাঙ্ক ইউ বলার জন্য। এগুলো চোতার পিসতুতো ভাই নয়? সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘পড়ায় একটু টোকে বলে খোকার পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব চোতা মেরে লক্ষ টাকা ভাগ করো— তার বেলা?’ প্রতি বার মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের সময় এক দল ফোটোগ্রাফার ক্যামেরা কাঁধে এ ইস্কুল ও ইস্কুল ঘুরে বেড়ায়, পর দিন কাগজে দেখি দোতলায় চোতা পৌঁছতে পাইপ বেয়ে উঠছে কয়েক জন। এক দল ওটা দেখে বলে— ছি ছি, সমাজের কলঙ্ক, আগাপাছতলা ধরে চাবকাতে হয়।

আর আমাদের মতো লোকরা বলে— আহা, কী সমাজকল্যাণের দায়, অন্য মানুষের কেরিয়ারের জন্য ঠ্যাং ভাঙার রিস্ক নেওয়া! মোদ্দা কথা: ট্যালেন্টেড বা কমিটেড বা দুইই না হলে এ কাজ করা যায় না। যাত্রা সিনেমায় আজও প্রম্পটারের সংলাপ আওড়ে এক দল যদি স্টার হয়, তা হলে পরীক্ষায় কাগজ দেখে লিখে আমি স্টার পাব না কেন? সত্যজিৎ রায় এক বার লিখেছিলেন ‘তুমি উত্তম হইলে আমি সৌমিত্র হইব না কেন?’ অতএব টোকাটুকি জিন্দাবাদ। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.