অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
অবশেষে দুপুরে খেতে যাওয়ার সময় হলো, কোলকাতা নিউমার্কেটের রাস্তায় বেশ বড় একটা মুসলিম হোটেল, রোজার মাস,কিছু ধার্মিক ভাইয়েরা রোজা রেখেছে, তাদের বাদ দিয়ে সবাই দুপুরে খাবে, যাত্রার এই পর্যায় থেকে ট্রাভেল এজেন্সির সকল বিল মেটানোর পালা। আমাদের বেডিং, ইটিং, মুভিং সব কিছুর খরচা দিবে তারা। এমনটাই চুক্তি। গেলাম সেই হোটেলে, ম্যানেজারকে বলতে হবে, কোডের মতো, বিল দিবে ঐ জনা, এমন ধাঁচের বিষয়, বসলাম হোটেলের সবচেয়ে পেছনের টেবিলে, খাওয়ার অর্ডারও দিলাম, তবে উপভোগ করতে পারি নি, বিভিন্ন মসলার ঘ্রান, এবং তেলের পরিমান খাওয়া বরবাদ করে দিলো। খাওয়া শেষে ফেরার পথে প্যাকেটে দেখি সিগারেট বাড়ন্ত, বর্ডারে আমি কিছু টাকা বদলে নিয়েছিলাম সেইটুকুই পকেটের সম্বল ।
চিরকালীন বেহিসেবি আমি দোকানের সবচেয়ে দামি সিগারেটটা কিনলাম। লন্ডন ফাইফ ফাইফ ফাইভ, আমার মনে হয় প ৃথিবীর সবচেয়ে স্বাদু সিগারেট এটা, মোলায়েম একটা আস্বাদ লেগে থাকে মুখের ভেতরে, নরম পাঁকের সন্দেশের মতো জিনিষ। এবং আরও এক প্যাকেট কিনে ফেললাম আনন্দে, এর পর সবাইকে ডেকে এই অমৃত খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম, অসুরের মুখে অমৃত তিতা লাগে, তানভীর এমন এক পাবলিক, ওর পছন্দ হলো না, ওর বক্তব্য নেভি বেস্ট, সেকেন্ড বেস্ট গোলডলীফ। ওরে গালি দিয়া আর সিগারেট দেই নাই। ও বাংলাদেশ থেকে আসার পথে এক কার্টন সিগারেট কিনে এনেছে।
আমি আয়েশ করে অমৃত খাই, আর হোটেলের সামনের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করি। জনগন দল বেঁধে নিউমার্কেট গেলো। আমি লিটু ভাই তানভীর, আশফাক মিলে কোলকাতা ভ্রমনে বের হলাম। পায়ে হেঁটে ভ্রমন যাকে বলে। বিকালের রোদ মরে আসছে, শীত কালের হলদে চনমনে রোদে হেঁটে যাওয়ার সুখে আপ্লুত, কোলকাতা আমাদের খুব পরিচিত, সুনিলের শীর্ষেন্দুর, সত্যজিতের কোলকাতা, সুমনের গানের কোলকাতা, গড়িয়া হাটার মোড়, এসপ্লানেড, হাজারি বাগ, বিবাগিবাগ, সব এলাকার নামই তুমুল পরিচিত, সেখানে গিয়ে নিজেকে উটকো অতিথি মনে হয় না, মনে হয় অনেক দিনের পর ফিরে আসলাম।
হাঁটতে হাঁটতে কোলকাতা আর্ট কলেজ, সেখান থেকে মিউজিয়াম, সেখান থেকে গড়িয়া হাটার মোড়, আবার ঘুরে নিউমার্কেটের পাশে আসলাম। মন চাইলো ট্রামে চাপবো, কোলকাতার ট্রাম, ট্রামে চেপে বসলাম, টিকেট 1টাকা 50 পয়সা, কোথায় যাবো জানি না। ট্রামের কন্ডাক্টর কে জিজ্ঞাসা করলাম রূট কি,সে রুটের নাম বললো, আমরা কফি হাউসের জন্য কোথায় নামতে হবে জিজ্ঞাসা করে ট্রাম থেকে লাফ দিয়ে নামলাম। ট্রাম আহামরি কোনো জিনিষ না, মাথার উপর একটা তার ঝুলনো আছে, সেই তার দিয়েই চলে, যদি কোনো কারনে লোড হসেডিং হয় তাহলে আটকে থাকবে রাস্তায়। আর গতি খুবই কম, আমার নিজের ধারনা কোলকাতার মানুষ হাঁটতে হাঁটতে বিরক্ত হলে ট্রমাে চড়ে রেস্ট নেয়, আবার ট্রাম থেকে নেমে হাঁটা দেয়।
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই হেঁটে ট্রামের চেয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়া সম্ভব।
স্বপ্নের কফি হাউসের আশে পাশেই বই পাড়া, কোলকাতার সবচেয়ে রোমান্টিক জায়গা, এখানেই কত শিল্পি সাহিত্যিক নিয়মিত আড্ডা দেয়, দিয়েছে, এবং ভবিষ্যতে দিবে। আমরাও ঢুকে গেলাম সেই কফি হাউসে। সংকীর্ন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম ধোঁয়ায় অন্ধকার চারদিক, মানুষের মাথা চুল দিয়ে ঢোঁয়া উঠছে, প্যাসিভ স্মোকিংএ ক্যান্সার হয় তাহলে এখানের চেয়ার টেবিলের এতদিনে কয়েশশতবার মৃতু্য হয়েছে, আমার মনে হয় এখানের চেয়ার টেবিল চাটলেও 10টা সিগারেটের নিকোটিন পেয়ে যাবে মানুষ, ন্যাংটা হয়ে বসলে নিকোটিন প্যাচ ছাড়াই সিগারেট ছেড়ে দেওয়া যাবে।
সেখানে ঢোকার পর দোতালায় উঠলাম, উঠে একটা টেবিল নিয়ে বসলাম, পাশের টেবিলে একজন কবি, একজন চিত্রকর একজন মেয়ে, চমৎকার শাড়ী পড়া মেয়ে, আমি সুন্দর এবং শাড়ী পড়া মেয়ে দেখলে উত্তেজিত হই, এখনও হই হয়তো তবে পরখ করার সুযোগ পাচ্ছি না।
সেখানে কফির অর্ডার দিবো, সাথে কি খাবো জানতে চাইলো, অর্ডার দিয়ে বসে আছি, অনেক ক্ষন, মিনি মাংনায় বিড়ির ধোয়া ঢুকছে, আর ভারতের কমদামি এবং নিম্নমানের সিগারেটের ধোঁয়া জঘন্য, একজন ডেকে বললাম কি ব্যাপার ভাই আমাদের জিনিষ আসবে কখন। সে খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো ওটার দায়িত্বে এটা পড়ে না।
আমি বিরক্ত হয়ে কিছু একটা বলতাম, অচেনা দেশে আর যাই হোক দেশের মতো আচরন করা যায় না। দেখলাম একদল বেয়ারার মাথায় পায়রার পেখম মেলা আছে ওদের কাজ অর্ডার নেওয়া এবং ওটা নিয়ে আসা, অন্য একদল যাদের পাগড়ি ফ্ল্যাট, ওদের কাজ পানি দুধ চিনি সাপ্লাই দেওয়া। আমি ভুল করে ওরেই জিগাইছিলাম অর্ডারের খবর।
চরম বিস্বাদ খাওয়ার, অর্ডার দিয়ে ফেলেছি বলে নিজের আফসুসের সীমা নাই। 7টাকা থেকে 10 টাকার কাটলেট, সুনিলের আর শীর্ষেন্দুর মায়েরে বাপ, ওগোর খাওয়ার রূচি এত খারাপ ক্যান। হয়তো স্পেশালিটি আইটেম কিছু আছে। তবে ফিস কাটলেট, মাটন কাটলেট, শ্রিম্প কাটলেট, খুবই আশ্চর্য বিষয় এই তিনটার স্বাদই একই রকম। কোনো ভাবেই আলাদা করা সম্ভব হলো না।
কফি হাউসের কফি, পৃথিবীর নিকৃষ্ট তম একটা পানীয়। ঘোড়ার মুত, বিড়ালের মুত, এসব মিক্স করে খাইেেলা বোধ হয় এর চেয়ে ভালো স্বাদ হবে, দুধের কাপ উলটে দুধ ঢাললাম, 4 চামচ চিনি দিলাম, এবং স্বাদ বাড়ানোর সব প্রচেষ্টাকে ব্যার্থ করে এটার স্বাদ কমতেই থাকলো এবং একটা পর্যায়ে ওটাতে চুমুক দিয়ে কাপ দেয়ালে ছুড়ে মারার বাসনা জাগ্রত হলো। সেই সময়েই আমরা রওনা দিলাম বাইরে।
আশফাক বইপ্রিয়, এখানেও সে কিছু টেক্সট বই কিনবে ভাবছে, কিছু রেফারেন্সের বই নিয়ে যাবে, আসলে ও খুব সিরিয়াস ছাত্র, ওর সাথে প্রার্থিত বইয়ের দোকান গিয়ে দেখলাম দোকানের ঝাঁপ নেমে গেছে। আজকের মতো দোকান বন্ধ।
হেঁটে হেঁটে ফিরলাম। কেসি দাসের মিস্টি, খুবই বিখ্যাত, সেখানে মিস্টি খাওয়ার বাসনা ছিলো। খুঁজে খুঁঝে গেলাম সেখানে। যাওয়ার পথে দেখি কি জানি একটা বিক্রি হচ্ছে, কোলকাতার রাস্তায় চলার জন্য হিন্দিতে ভালো দখল থাকতে হয়, আমি কোলকাতায় গিয়ে বাগলায় কথা বলে জবাব পেয়েছি হিন্দিতে, এই অভিজ্ঞতাটা সুখকর নয় মোটেও। ফুচকা বিক্রেতার কাছ থেকে শালপাতায় ফুচকা কিনে খেলাম।
তখন গোবিন্দের ম্যায় তো রাস্তে সে যা রাহা থা, ম্যায় তো ভেল পুরি খা রাহা থা তুমুল হিট। আমারও ইচ্ছা ভেলপুরি খাবো। ভেরপুরি খুজতে গিয়ে পানিপুরি খেলাম, যা আদতে দেশের ফুচকার একটা ভার্সন।
অবশেষে কে সি দাসের দোকান( হতে পারে কে সি মিত্তির, যাই হোক নামটা কাল চাঁদ দাস কিংবা মিত্তির কিংবা ঘোষ, বোস যাই হোক কিছু যায় আসে না,) চমৎকার দোকান, থরে থরে মিস্টি সাজানো, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আয়েশ করে বসলাম টেবিলে।
সন্দেশের অর্ডার দেওয়া মাত্রই হাতে চলে আসলো, 2 কি 3টা খাওয়ার পর পানির পিপাসায় কাতর। আমি সামনের বেয়ারাকে ইশারা দিলাম, শুনলো না, পানি দাও বললাম তাও শুনলো না।
হাত উচিয়ে ইশারা করলাম শুনে না, মেজাজটা খারাপ ছিলো, একটু জোড়ে বললাম কি ব্যাপার মিয়ারা পানি দাও না ক্যান। ম্যানেজার আমার দিকে তাকালো তাকিয়ে বললো, জল খাবেন তো জলসেনাকে বলুন। আমি সালার যাকে বলে উলটে পড়লাম, জলসেনা মালটা কি।
পড়ে দেখলাম উর্দি পরা বেয়ারা যার কাজ পানি দিয়ে যাওয়া। এই বেয়ারার যে আবার এমন সংগ্রামী নাম থাকতে পারে এটা আমার আশাতীত ছিলো। আমরা জলসেনার ধাককা নিয়ে বাইরে নামলাম, গন্তব্য কোলকাতার লিকার শপ, নিউমার্কেটের সময় শেষ, দোকান বন্ধ হয় হয় অবস্থা, হাতে টানা রিকশায় চেপে ছিলাম, আমি মুহূর্ত খানেক পর নেমে গেছি, রীতিমতো ক্রিতদাস ধাঁচের মনে হয়েছিলো। যদিও দেশে আমার প্রধান বাহন রিকশা তবে আমাদের দেশের রিকশায় যান্ত্রিক বউাবস্থা কখনই শ্রমটাকে এমন নগ্নভাবে উপস্থাপন করতে পারে না। একজন হাতে করে মানুষ টেনে নিয়ে যাচ্ছে চাকা দেওয়া গাড়ীতে এটা কষ্টকর।
তবে রিকশায় সমস্যা না হওয়ার কারন সাইকেলের সাথে এর সাযুজ্য, আমরা সাইকেল চালিয়ে অভ্যস্ত।
লিকার শপের ঝাঁপ বন্ধ হয় হয় অবস্থা। কোলকাতা সহ সমস্ত ভারতের নিয়ম এটাই 8টার পর সব দোকান বন্ধ, প্রায় সব, চায়ের দোকান কফির দোকান, সিগারেটের দোকান এসব খোলা থাকে সারারাত তবে মূলত বেশীর ভাগ বড় মার্কেট বন্ধ হয় 8টার মধ্যেই। লিকার শপের ঝাঁপ ঠিক মতও নামার আগেই আমরা ঢুকে গিয়েছি, আমরাই শেষ গ্রাহক। তানভীর পছন্দ মতো হুইস্কি, জিন কিনলো, বীয়ার কেনা হলো 4 বোতল।
আর বিল চুকানোর সময় নামানো শাটারের নীচ দিয়ে ঢুকলো একজন, দোকানী তাকে মদ বিক্রি করবে না, তার কথা হলো সময় শেষ দোকান বন্ধ, সেই লোকের কাতর অনুনয়, গালগালি, এক ফোঁটা দিয়ে দে না বাবা, একটু রেখে লিস, কোনো আবেদনেই কিছু হলো না। আমরা মদ নিয়ে ফিরলাম হোটেলে। এসে শুনি তানভীরের মা ফোন করেছে। তানভীর বাসার একমাত্র ছেলে এবং তার বাবা-মা হাইপার চিন্তিত তাকে নিয়ে। পুরা ট্রাভেল প্লান নিয়েছে, কোথায় কোন হোটেলে থাকবো, কবে কখন পৌঁছাবো আনুমানিক, সবই তারা লিখে রেখেছে, তাই কোলকাতার হোটেলে রাত 8টার পর ফোন করেছে, এর আগে 2 বার ফোন করে ব্যার্থ হয়েছে, দুবারই এই ল্যাঠা সামলেছে তমাল।
তানভীরের 2 বগলে 2টা মদের বোতল আর উল্লসিত কণ্ঠ খুব ভালো আছি বাপু, খুব ভালো আছি আম্মু। আমার কাছে আশ্চর্য লাগে এই বাপু সম্বোধন, এর পরও যার যার বাপ সে তার মনের মতো ডাক দিবে। হোটেলের রূমে ছুটে গিয়ে সে বোতলের ছিপি খুলে সঠিক ব্যাবহার শুরু করলো।
তমাল তখন ডলার ভাঙিয়ে রুপি করেছে সে হিসাব নিয়ে ব্যাস্ত। তার সামনে 100, 500,1000, 50, 10, 5 রুপির পাহাড়, প্রায় 4 লাখ রুপি আছে সেখানে।
ওটার আবার 2 রেট, ডলার যা এনডোর্স করে আনা হয়েছে সেটাকে লীগালি ভাঙাতে হবে, ওটার জন্য কম রেট আর অবৈধ ভাবে আসা ডলারের রেট হাই, কখনও কখনও 2টাকার পার্থক্য। এই 2 হিসাবের টাকা বিতরন করতে হবে, সবার দেওয়া টাকার পরিমান, কনভার্ট করে পরিমান মতো দেওয়া হচ্ছে তাদের। সে চরম ব্যাস্ত।
25শে ডিসেম্বর আবার ছিলো তমালের জন্ম দিন, আমরা বাসেই হ্যাপি বার্থ ডে গেয়ে ক্ষুদে জন্ম দিন পালন করেছি, সে আবেগে তমালের চোখে পানিও এসে গিয়েছিলো। এখন তার কাছে খাওয়া পাওনা অথচ সে রাজ্যের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত।
অতএব রুবেল বাবু তমালকে হোটেলের রূমে রেখে আমরা আবার বাইরে বের হলাম। উদ্দেশ্য বিহীন ঘোরা ফেরা। পরদিন রাতেই কোলকাতা ছাড়তে হবে দিল্লির উদ্দেশ্যে, তাই এক রাতে যতটা দেখে নেওয়া যায়।
হাঁটতে হাঁটতে আবার আর্ট কলেজ কোলকাতা মিউজিয়াম, ভক্তের নিবেদন বটগাছের এক পাশ সিঁদুরে লাল করে ফেলেছে, সেসব দেখতে দেখতে একটা দৃশ্য আটকে গেলো মাথার চেতরে, সামান্য বৃষ্টির পর ঝকঝকে রাস্তায়, সুনীলের কোলকাতার রাস্তা নোংরা, অপরিস্কার তবে আমার দেখা কোলকাতার রাস্তা খুবই পরিস্কার এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মিরা খুবই নিবেদিত এই কাজে, হয়তো সিটি ওফ জয়ের পরে কোলকাতা ভ্রমনপিপাসুদের জন্য খুবই উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছিলো, ঝকঝকে তকতকে রাস্তা দেখে ঢাকা শহরের গুষ্টি উদ্ধার করলাম, সেখানেই একটা পুরোনো লয়াম্পপোষ্টের উপর লতানো একটা গাছে ফুল ফুটেছে, সাথে স্ট্রিট লাইটের তীর্যক আলো, কিছু ফুল উজ্জল, কিছু ফুলের দীর্ঘ ছায়া পড়ে ম্লান হয়ে আছে বাকি গুলো, শমিকের কয়ামেরার কয়েকটা স্ন্যাপ যেনো এখানে বরাদ্দ হয় তা নিশ্চিত করলাম, বেশ কায়দা করে লোকেশন বলে বলে সত্যজিত রায় রাসেল মিয়া ফটোগ্রাফির ডিরেকশন দিলো। ছবিটা ক্যামোন এসেছে জানি না।
সেসব শেষ করে বন্ধ মার্কেটের পাশ দিয়ে গেলাম আবার পাতাল রেল দেখতে। মাটির নীচে ঢুকে যাওয়া এবং কবরে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে, সেখানে ভেন্ডিং ম্যাশিন বসানো, সেখানেই পেপসি খেলাম, ওসব দেখে আবারও রাস্তায়, এবার পার্কস্ট্রিট, সেখানের হোটেলে বড়দিনের উৎসব চলছে, নানা রকম সজ্জিত নারী পুরুষের দল ঘুরছে, ক্রিসমাস ট্রি সাজানো। ভেতরে নাচের ব্যাবস্থা, জুটি নিয়ে ঢুকতে হবে, আমরা অল্প সময়ের জন্য জুটি বানাতে পারতাম, সেখানে ঢুকে বুঝলাম আসলে নাচের জায়গাটা মানে বলরুমের ঢোকার জন্য টিকিট কাটতে হবে, বাঙালি মানুষ, হাড় কেপ্পন এই কোমড় দুলানোর জন্য বাড়তি পয়সা খরচ করতে কেউ উৎসুক নয়। এভাবেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে অবশেষে রাত 12টায় হোটেলে ফিরলাম। এসে দেখি তানভীর খুব উত্তেজিত, তানভীর পছন্দ করতো যুঁথিকে, যুঁথি ছিলো আমাদের সাথে, তাকে রেখেই আমরা গিয়েছি এটা ওর পছন্দ হয় নি, আর পেটের উগ্রতরলের প্রভাবে ওর চন্ডাল রাগ, বাঘের হোগা মেরে ফর্দাফাই করে দিতে পারে ও এমন অবস্থায়।
আমি ভেতো বাঙালি কোনো রকম ঝামেলায় না গিয়ে ওকে ওর মতো কথা বলতে দিয়ে শোয়ার আয়োজন করলাম। কোলকাতার রাত নামছে, তখনও দিনের বেলার আঁচ মরে যায় নি, ঠান্ডা লাগছে সামান্য ডিসেম্বরের ঠান্ডা, ঘরের বিছানায় জমেছে। ওখানে বসে শক্তির কবিতা পড়ছি,ইচ্ছা ছিলো এই অবসরে দেশের অফিসে গিয়ে সাহিত্যিকদের দেখবো, ওদের সুবাদেই চেনা কোলকাতায় পা রাখলাম।
সেটা সম্ভব হবে না,কোলকাতায় থাকবার মেয়াদ আর 20 ঘন্টা। আগামি কাল রাতেই ট্রেনে চড়তে হবে গন্তব্য দিল্লি।
এর মধ্যে টাকাপ য়সার বিলিবন্টন শেষ, অবশেষ তমাল রুবেল বাবুর নিস্কৃতি হলো, তারাও আসলো ঘরে, আড্ডা জমবে, আমরা চিরচারিত আদিরসাত্বক কথাবর্তা চালাচ্ছি, আড্ডা জমানোর সেরা মাধ্যম আদিরস। সবাই বুঝে, সবাই অংশগ্রহন করতে পারে, সবার কাছে এমন একটা দুইটা খাইস্টা কৌতুক পাওয়া যায়।
এর মাঝে ঘরে ঢুকলো রহিমা, আমিও লাফ দিয়ে ডাক দিলাম রহিমা সুন্দরি কেমুন আছো।
রহিমা উত্তরে সুন্দর করে হাসলো। আমার পরিচিত হিজাবি মেয়ে একজন।
যদিও আমার ধারনা ছিলো ওর মাথায় টাক আছে। তবে এখন আমি জানি ওর চুল সুন্দর, এমন সুন্দর চুল হিজাবে ঢেক রাখার মানে নেই। কেউ ফিচকেমি করে যদি বলে কারো কারো স্তন সুন্দর ওটাও মুক্ত করে দাও, আমার এ প্রস্তাবেও আপত্তি নেই কোনো, দুরন্ত পায়রাকে বন্দি করতে নেই খাঁচায়, ওদেরও স্বাধীনতা চাই, প্রকৃতির পোশাকের চেয়ে সুন্দর পোশাক আর কিছু নাই।
লিটু ভাইদের পাশের রুমে ছিলো এক বাঙালি, সে মাঝ রাতে তুমুল মাতাল। উচ্চস্বরে গান গাইছে, হো হো করে হাসছে, জুয়েল কিছু দিন ব্যায়ম করেছে, ওর সাহস একটু বেশি, ও গিয়ে সেই দরজার নক করে বলেছে, একটু ভদ্্র ব্যাবহার করার জন্য, এখানে কিছু ভদ্্রলোকেরা ঘুমানোর চেষ্টা করছে।
মাতালকে উস্কে দেওয়া ঠিক হয় নি, সেই লোক অর্ধ নগ্ন অবস্থায় বোতল হাতে বাহির হয়ে হুমকি দিচ্ছে কোন চুদির পোলা কইলো এইটা, বাপের পয়দা হইলে সামনে আয়, জুয়েল রণমুর্তি দেখে চম্পট দিয়েছে, লিটু ভাইয়ের পাশের রুম, লিটু ভাইয়ের রুমেও নক করেছিলো, আশফাকের ঘুম ভেঙেছে, সে বীয়ারের বোতল হাতে নিয়ে দরজার সামনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করেছে যদি ভুল করে ঢুকেই পরে মাতাল ব্যাটা সোজা বোতল ভাঙবে ওর মাথায়। অবশেষে সেই মাতাল ঢুকেছে তার ঘরে, ঢুকে শুরু করেছে আবার গান গাওয়া, বিদেশে এসেছি, মাল খাবো ফুর্তি করবো কার বাপের কি?
কিছুক্ষন পর ওয়াক ওয়াক করে বমির আওয়াজ পাওয়ার পর আশফাক নিশ্চিত মনে শুতে গিয়েছে।
সকালে উঠে সবার প্রধান লক্ষ্য প্রাতকৃতাদি সম্পাদন। এর পর হালকা নাস্তা করা, একটু পড়েই বের হবো, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল যাবো, পার্কে যাবো যাবো গঙ্গার ধারে, সেখানে একটু জমিয়ে নিয়ে একটু আড্ডা দিয়ে দিল্লি রওনা দিবো। কোলকাতার সেরা পানীয় পেলাম এই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ঢোকার মুখে।
লেবু পানি, চমৎকার জিনিষ, 50 পয়সা গ্লাস, বাদাম খাওয়া, পার্কের গাছের আড়ালে প্রেমিকের হস্তের সুনিপুন কারুকাজ প্রেমিকার স্তনে দেখলাম, এসব দৃশ্য সোহওয়ার্দিতেও দেখা যায় ,কিন্তু বিদেশে এসে দেখার আনন্দই অন্য রকম। সেখানের পুকুর পাড়ে বসে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে, কেউ কেউ উৎসাহ নিয়ে গেলো মিউজিয়াম। আমার নিজের মিউজিয়াম পছন্দ না আমি বাইরে বাইরেই কাটালাম। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছবি তোলা হলো, একটা দলবদ্ধ ছবিও তোলা হলো, সবার ক্যামেরাই ব্যাস্ত।
সেসব শেষ করে গঙ্গার পারে গেলাম।
সেখান থেকে ফেরার পথে মিউজিক্যাল ফাউন্টেন দেখলাম খানিকক্ষন বসে, তবে ওখানের গার্ড খুব কড়া মানুষ, ফাউন্টেনের আশে পাশের নির্ধারিত টেবিল ব্যাতিত অন্য কোথাও কাউকেই বসতে দেয় না। আমরা একটু দুরে গিয়ে বসেছিলাম, আমাদের খেদিয়ে আনলো ভীড়ে, দেখালো লেখা আছে সন্ধ্যার পর ওসব জায়গায় যাওয়া নিষেধ, তবু কেউ কেউ অন্ধকারের সুযোগে ভালোবাসর স্বাদ লুটতে কোনা কাঞ্চিতে যায়, ওদের ঠেকাতেই এ ব্যাবস্থা, মনে আসলো রাতের সোহওয়ার্ডির সামনের রতিউৎসব, পুলিশের টহল ভ্যান অনবরত ঘুরলেও কেউ কিছু বলে না। মাঝে মাঝে ডিউটির পুলিশও গিয়ে তাদের কামতৃপ্তি নিয়ে আসে মুফতে।
রাস্তায় দেখলাম ভেলপরী বিক্রি করছে একজন, আমি ভেল পুরি খাো তাই থামলাম, তখনই দেখলাম তাকে, আহা কি মনোরম মেয়ে, কমসে কম 5 ফুট 9 ইঞ্চি, দুধে আলতা গায়ের বরন, খুবই সুন্দর মুখশ্রি, চিরকালীন প্রেমের মুর্তি হিসেবে যেমন মেয়েকে কল্পনা করা যায় সে রকম একজন, টাইট টি শার্ট আর প্যান্ট পড়ে আছে, যদি শাড়ী পড়া থাকতো তাহলে নিশ্চিত একটা দুর্ঘটনা ঘটেই যেতো রাস্তায়। আমি ভেলপুরির বদলে সেই মেয়েকে দেখছি মুগ্ধ চোখে।
কোলকাতার সন্ধ্যায় বাসা ফেরা মানুষের থকথকে ভিড়ের ধাককা উপেক্ষা করে সেই মেয়ের পিছনে পিছনে হাঁটছি, হাতে ভেল পুরি, দেশি মুড়ি মাখানো, পার্থক্য হলো একটা লাল সস দেয়, মিস্টি সস, সেটা মুড়িতে নেতিয়ে ফেলে , ফলে ন্যাতানো মুড়ি, টক ঝাল মিষ্টি একটা স্বাদ, মনোগ্রাহি নয়, এর বাইরে সেই অপ্সরি হেঁটে যাচ্ছে, হৃদয় আমার নাচেরে আজি কে ময়ুরের মতো নাচেরের বদলে বলতে হবে প্রহর শেষের আলোর রাঙা সেদিন চৈত্র মাস তোমার চোখেই দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ, তবে এপপ্রিয়েট শব্দটা হবে কারো পৌদ মাস কারো হোাগায় বাঁশ। এমন একটা মেয়ে চোখে গেঁথে গেলে মেনেকা উর্বশীকে দাসি বাঁদি মনে হবে। শি গট এভরি থিং, মনে গান গুন গুন করছে, ইউ আর অল দ্যাট আই নিড গার্ল------
বেশ কিছু দুর যাওয়ার পর আচমকা রাস্তা পেড়িয়ে চলে গেলো মেয়েটা, তখনই লাল বাতি সবুজ হলো, জান্তব শহরের সব কটা গাড়ি হর্ন বাজিয়ে আমার হৃদয়ের আবেগটা নিহত করে ছুটে গেলে, গাড়ী চাপা পড়ার ভয়ে আর রাস্তায় পা নামাতে পারলাম না,
আমার হিয়ার পরে চলে গেলো কে বসন্তের ঐ বাতাস খানির মতো আমার হিয়ার পরে চলে গেলো কে,
যেতে যেতে হাসিখানি রেখে গেলো সে...........।
ওখানে থেকে ফিরে শুনলাম যাওয়ার সময় হয়েছে, জিনিষপত্র গুছিয়ে রওনা দিলাম স্টেশনের পথে, কোলকাতার ট্যাক্সি, এ এক আশ্চর্য জিনিষ, দেখতে ছোটোখাটো তবে ভেতরে বিশাল জায়গা, আমরা 4 জন উঠেছি এর পরও পিছনের সীটে বেশ আয়েশ করেই বসা গেলো। মূলত ভক্সওয়াগন, আমি গাড়ী চিনি না, কেউ কেউ বলে এম্বাসাডর, হতে পারে, কিন্তু চমৎকার বসার ব্যাবস্থা।
স্টেশনের পৌঁছানোর পথে শুনলাম 52 জনের সীট এক বগিটে হয় নি, এক বগিতে হয়েছে 38 জনের সীট অন্য বগিতে 14 জনকে থাকতে হবে। এবং হলবাসী ভাইয়েরা কেউই সেই 14 জনের বগিতে যাবে না। এটা নিয়ে বচসা শুরু হওয়ার যোগার। তমালের অসহায় অবস্থা, আশফাক 14 জনের বগিতে যাবে, তানভীরও যাবে 14 জনের বগিতে, অবশেষে দেখা গেলো লিটু ভাইয়ের ন তৃত্বে আমরা 13 জন পাশের বগিতে , পাশাপাশি 2 বার্থে 12 জনের সীট আর দুরে এক জায়গায় 2 জনের সীটের ব্যাবস্থা হয়েছে। আমাদের মূল যাত্রা শুরু হবে আর একটু পরেই, অন্তত এখানের মানুষজন হিন্দিতে কথা বললেও তারা বাংলা বুঝে এর পর যেতে হবে দিল্লি সেখানে মানুষ বাংলা বুঝবে কিনা জানি না।
একেবারে অপরিচিত ভাষার মুখোমুখি হতে হবে এর পর থেকে। এটাও একটা বাড়তি চিন্তার কারন। আমরা স্টেশনের প্লাটফর্মের দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি আর আড্ডা দিচ্ছি, আমাদের উদ্দেশ্য চলতি ট্রেনে দৌড়ে উঠবো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।