আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভ্রমন 03

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

বাসে উঠার পর সবাই নিজের জায়গা খুঁজে নিয়ে বসেছে, পদাধিকার বলে বাসের প্রথম 2 সারি শিক্ষকদের দখলে, তার সামনের অংশে যারা ভ্রমনের দায়িত্বে নিয়োজিত সেই কয়েকজন মানুষ বসেছে, যে বাসটা এসেছিলো ওটাতে আবার সিটগুলো এ1 এ2 এভাবে চিহি্নত ছিলো, পদাধিকার বলে এ সারির সবগুলো সিট দখল করেছে বিবাহিত শিক্ষক দ্্বয়, তার পেছনে একলা সীটে বসে বসে আছে লিটু ভাই, লিটু ভাইয়ের পাশ থেকে শুরু হয়েছে হলবাসিদের বসা। এবং এখানেও জুটি প্রথা। প্রেমিক-প্রেমিকারা পাশা পাশি বসেছে। সম্ভবত 5 জোড়া গিয়েছিলো, ওখানে সেই 5 জোড়া যমজ সীটে বসে আছে, তাদের আশে পাশে ঘনিষ্ট জনেরা। এদের পরে ঢাকাবাসি, সবচেয়ে পেছনের সারি ফাঁকা, সেখানে কয়েকটা বিষন্ন ব্যাগ পড়ে আছে।

মানুষ খুবই সচেতনভাবে পরিচিতমন্ডলীর বাইরে যেতে চায় না, এখানেও হলবাসী কেউ এসে বসে নি ঢাকাবাসির পাশে, ঢাকাবাসী এবং হলবাসী একই বাসে দুটি ভিন্ন গোলার্ধ বানিয়ে বসে আছে। এই প্রবনতা আসলে খুবই প্রবল একটা প্রবনতা, এই প্রথা ভাঙার জন্য মাঝে মাঝে বিভিন্ন পন্থা আবিস্কার করে মানুষ। একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম, সেখানে মানুষের ইন্টারাকশন বাড়ানোর জন্য তারা 16টা ছক বানিয়েদিটেছিলো, যারা সেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলো তাদের প্রতি অনুরোধ ছিলো, সবাই যেনো এই ফর্দ নিয়ে সবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে তার কোন গুনাবলি এই ফর্দের সাথে মিলে, যেমন একাধিক ভাষা জানা মানুষ কয়জন, কয়জন মানুষ ছুটি কাটাতে দেশের বাইরে যায়, কতজন যায় সমুদ্্রে, কতজন পাহাড় পছন্দ করে, কতজন নতুন পরিবেশে গিয়ে সেখানের খাওয়া পছন্দ করে খায়, তালিকাটা সম্পুর্ন মনে পরছে না, তবে আমার ফর্দে মাত্র 5জনের ছাপ এসেছিলো, আমি মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ার কাজে চরম ব্যার্থ একজন মানুষ, কারন এরা সবাই আমাকে এসে বলেছিলো ফর্দের কোন গুনটা তাদের আছে। এই বাধা কিংবা দ্্বিধার প্রাচীর ভাঙার জন্য বাসে কোনো ফর্দ ছিলো না। আমরা 4 বছর একসাথে থাকার সুবাদে অনেকের নামে রটনা, কূৎসা, মুখরোচক গল্প, রোমহর্ষক গল্প শুনেছি।

অনেকের বিচিত্র অভ্যাসের কথা শুনেছি, কখনই যাচাই করার জন্যও জিজ্ঞাসা করা হয় নি, তাই ঢাকাবাসি এবং হলবাসীর সঙ্গের কাছাকাছি নিসঙ্গ পেছনের সীটে বসে আয়েশ করে সিগারেট ধরানো মাত্রই, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেয়েলী গলার প্রতিবাদ আসলো। বাসের ভেতরে সিগারেট টানবে ধরনের মেয়েলী প্রতিবাদে কখনই মাথা ঘামাতে হয় না। এর উপর জানালা খোলা, বাস চলছে পূর্ন গতিতে অযথা ন্যাকামি না করে নিজ নিজ কর্মে মোনোযোগী হওয়ার গুরুত্বপূর্ন উপদেশটা দিবো দিবো ভাবছিলাম, লিটু ভাই হন্তদন্ত হয়ে এসে বসলো পাশে। বেচারা শিক্ষকশ্রেনীতে উত্তরনের পর সবচেয়ে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে না ঘর কা না ঘাট কা অবস্থায় পড়েছে। সেসব শিক্ষক তারও শিক্ষক, সদ্য জয়েন করেছে বলে তাদের সামনে সিগারেট ধরানোর জড়তায় ভুগছে।

অন্যদিকে আমরা এখনও ছাত্র আমাদের সামনে সিগারেট টানতে কোনো সমস্যা নেই। আমাদের কয়েক জনের এই বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই, লিটু ভাইয়ের অফিসে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককূল চলে যাওয়ার পর আমরাও ধোণয়ার দূর্গ বানিয়েছি, আমাদের হলবাসি বন্ধুদের ওটা পছন্দ না, তারা লিটু ভাইকে শিক্ষক হওয়ার পরবর্তি মুহূর্তেই সম্মানিত আসনে বসিয়েছে, সেই সোশ্যাল ট্যাবু থেকে বাইরে আসতে পারে নি তারা। লিটু ভাই এসে বসার পর মেয়েলি প্রতিবাদ খানিকটা কমে গেলো। শিক্ষক এবং সম্মানিত ব্যাক্তিরা এজন্যই অপরাধ করে পার পেয়ে যায়। প্রেমিকার হাত বসে আছে প্রেমিক, মুখে রহস্যময় হাসি, অপেক্ষা কখন বাসের বাতি নিভবে আরও একটু ঘনিষ্ট হওয়া যাবে।

অবশ্য লোকলজ্জার বিষয়টা ধীরে ধীরে উবে যাচ্ছে সময়ের সাথে, এরা সবাই রমনা-সোহওয়ার্দি, টিএসসি চত্ত্বরে প্রেম করে অভিজ্ঞ, বেশী ক্ষন লোকলজ্জা ধরে রাখতে পারে না। সামান্য সংশয় কেটে যাচ্ছে বন্ধুর সঙ্গে এবং সামান্য সঙ্কোচ যা অবশিষ্ট তা শুধুমাত্র শিক্ষকের কারনে। এর মধ্যেই বোমা ফাটার মতো আমাদের শিক্ষক তার ইটালিয়ান বধুকে চুমু দেওয়ার পর লজ্জাটা বে আব্রু হয়ে গেলো। তবে সবাই চুমু উৎসবে মাতে নি, কিন্তু একটু ঘনিষ্ট হয়ে যাওয়া, হাত থেকে ঘাড়ে চলে যাওয়া, এসব সামান্য সামান্য পরিবর্তন আসলো বসার ভঙ্গিতে। ঢাকা শহরের রাস্তায় সোডিয়াম লাইটের আলো আঁধারিতে ঘুরতে ঘুরতে বাস শহর ছাড়লো।

প্যাকের খোলা হচ্ছে, হলবাসী ভায়েরা সিগারেটের তৃষ্ণা চেপে বসে ছিলো, তারাও একে একে ছড়িয়ে পড়লো পেছনের দিকে, 64 সীটের বাসে 52 জন যাত্রি বসে আছে। অবশিষ্ট 12টা সিটে যার যার ধুমপানের ইচ্ছা তারা অবস্থান গ্রহন করছে এবং উঠে যাচ্ছে। আমি একটা বিষয় খেয়াল করেছি আমার বন্ধুদের ভেতরে অধুমপায়ী মানুষের সংখ্যা খুব কম, এবং এদের বেশীর ভাগই আবার তাসে দক্ষ, কিংবা অন্য কোনো খেলায় পারদর্শি, সুতরাং আমার পেছনের সীটে সঙ্গের অভাব ছিলো না কোনো। বাস আরও একটু সামনে আগাতেই মনে পড়লো ইফতারিতে পানি বেশী খাওয়া হয়েছে, সেই পানি বেয়ারা রকমের চাপ দিচ্ছে তলপেটে,চাপবিমুক্ত করা প্রয়োজন, বাস থামাতে হবে। এমন মতে কেউ কেউ গররাজি, তাদের কথা ছেলেদের নল আছে, সেই নল ঝুলিয়ে বাইরে পানি ঢাললেই হবে।

অতএব জানালা দিয়ে পেশাব করার প্রচেষ্টা চললো। খুবই কঠিন কাজ, এরোডিনামিক্স জানতে হয়, এবং হিসাব করে কাজ সারতে হয় নাতো নিজের পেশাবে নিজের গোসল ধাঁচের দূর্ঘটনা ঘটতে পারে, আমরা অভিজ্ঞ পদার্থ বিজ্ঞানীর দল, আমাদের এসব হিসাব নখদর্পনে থাকে। তবে বাতাসে ছেড়ে দেওয়া পানি সেই ভাষ্য বুঝে না, সব দিক থেকে নিরাপদ আসন হলো পেছনের সারির 2 জানালা, ওখান দিয়ে পানি ঢাললে ওটা কোনো ভাবেই বাসের ভেতরে ঢুকবে না তবে সাবধানতার খাতিরে কাজটা করতে হবে বাসের গতির দিকে পিঠ দিয়ে। সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে একটু চেপে ধরতে হবে পেছনের সিটের হাতল, নাতো যদি বাস আচমকা বাঁক নেয় হুমড়ি খেতে হবে। এসব তাত্তি্বক আলোচনা শেষে সদ্য টয়লেটট্রেইন্ড মুতকেরা তাদের অর্জিত শিক্ষার হাতে কলমে ব্যাবহার দেখালো।

মাঝে এক মেয়ে বলেছিলো তারও হালকা হওয়া প্রয়োজন, তবে আফসোসের সাথে তাকে জানানো হয়েছে তুমি পরবর্তি কোনো এক জায়গায় বাস থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করো, সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। জনদাবির মুখে অবশেষে কোন এক হোটেলের সামনে বাস থামলো, সেখানে মেয়েরা সবাই পরিচ্ছন্ন হতে গেলো ছেলেরা হাত পায়ের খিল ছড়ানো জন্য নামলো, সাথে রাতের খাওয়ার। খাওয়া দাওয়া ভালোই হলো। আবাড়ো বাসে এসে বসা। এবং গান, আমরা সবাই গাতক, গানে যাদের ঘুমের সমস্যা তাদের একটু কায়দা কসরত করে মুড়ি খেতে বলা হলো।

আমাদের সাথে ছিলো এক মেয়ে শায়লা, তখন কেউ একজন গান ধরেছে আমি যাবো চলে, দুরে বহু দুরে ,গান শুধু রবে ---- এর কোরাস ছিলো শালা লা লা লা এটাকে একটু বদলে সবাই গাইছে শালা লা লা লা শা লা লা শায়লা। বেশ আগুন মেয়ে ছিলো বলতেই আহা আহা গড়ন যেনো ভাস্কর্য। অনেকের তরুন হৃদয়ে বিস্তর দোলাও দিয়েছিলো, তবে কেউই শেষ পর্যন্ত স্থায়ী সম্পর্ক গড়তে পারে নি তার সাথে। শায়লার বিখ্যাত একটা উক্তি মনে পড়লো, আমাদের সাথে মাসুম ছিলো 2জন, একজন ফটকা মাসুম, অন্যজন তালেবান, তালেবান আসে নি আমাদের সাথে, বেচারা এক সংগ্রামী চরিত্র, মেধাবী, খুব মেধাবী, তাদের বার্ষিক আয় ছিলো বোধ হয় 10 হাজার টাকা। এমন একটা পরিবারের ছেলের এসব বিলাসিতা শোভা পায় না।

ফেলো কড়ি মাখো তেল জগতে তার জন্য কোনো অবস্থান ছিলো না বাসের ভেতরে। ফটকা মাসুম আবেগী একজন, মেয়ে দেখলেই প্রেম নিবেদন করে করে অবস্থা, যাকে বলে গদগদ আবেগে , সে এককালে শায়লাকে পছন্দ করলো, এবং কোনো এক পহেলা বৈশাখে শায়লাকে সাহস করে একটা ফুলদানি উপহার দিলো। শায়লার প্রতু্যত্তরটা সোনায় বাঁধিয়ে রাখার মতো। আমি শুনে শায়লার ঋিদা হয়ে গেলাম। শায়লা খুব নরম করে বলেছিলো, মাসুম তুমি আমাকে ফুলদানি দিচ্ছো ভালো লাগলো কিন্তু তোমার ফুলের জন্য আমার মনের ফুলদানিতে কোনো জায়গা নেই।

এমন নির্মম প্রত্যাখ্যান দেখে আমিও ভাবছিলাম জীবনে একবার শায়লাকে ফুলদানী দিতেই হবে। রাত্রি ঘনালো রাস্তায়, গভীর রাতে প্রেমিকার উষ্ণ আলিঙ্গনে বসে থাকা সুখী মানুষের দিকে তাকাই আর ইর্ষায় পুড়ি, শীতের সময়, বাসের জানালাও বন্ধ করতে হলো বাধ্য হয়ে, আর বদ্ধ বাসে সিগারেট টানা নিয়মত অন্যায় বলে চুপচাপ বসে আছি মুখাগি্ন না করেই। গায়কের দল হয়রান হয়ে থেমেছে, সবাই নিজের মতো এলিয়ে পড়ে আছে সীটে। মাঝে মাঝে একটা দুইটা কথা শোনা যাচ্ছে, নাতো নিশিথ রাইতে কোনো কাকপক্ষির সাড়া নাই। আমিও পেছনের সীটে বসে জানলা দিয়ে আকাশ দেখি আর গান গাই, এই শহরের কতশত অট্টালিকার ফাঁকে আমার জানালা ভরে ছবি হয়ে ঝুলছে আকাশ- তখন জেমসের দুঃখিনী দুঃখ করো না তুমুল হিট, এবং বাচ্চু আর জেমস ছাড়া অন্য কোনো গান শোনা হয় না মানুষের মুখে, সবার সাথে বাক্য বিনিময় শেষ, একেএকে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো, আমিও পেছনের সীটের এক কোনায় আকাশ দেখতে দেখতে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।