দেখতে চাই ধরনী
ইন্টান্যাশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ ডে
একটা সুন্দর দৃশ্যের কথা কল্পনা করি চলুন, যেই দৃশ্যে থাকবে কোনো প্রিয় মুখের সাথে একান্তে সময় কাটানো বা শুধুই বসে থাকা। করেছেন কল্পনা? আমি মোটামোটি নিশ্চিত যে আপনাদের মধ্যে অনেকেই একটা সুন্দর সমুদ্র সৈকতের কথা কল্পনা করছেন। যে সাগরের জল নীল, সৈকত বালীতে ঢাকা ঝকঝকে তকতকে। সবের্াপরি একটা স্বপ্নীল আবহ ঘিরে আছে আপনার বা আপনাদের চারপাশ। মোটামোটি অনেকের সাথে মিলে যাবে আমার এই কল্পনা...........
এবার স্বপ্নের সাথে বাস্তবতা কে মেলানো যাক।
ধরুন আপনি আপনার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে চান। সে জন্য আপনি চলে গেলেন বাংলাদেশের কোন সমুদ্র সৈকতে। গিয়ে আপনি যা দেখবেন তার সাথে আপনার স্বপ্ন টা মেলাতে গেলে একটু অলীক কল্পনা হয়ে যাবে মনে হয়। যারা কক্্রবাজার বা বাংলাদেশের অন্য কোন সৈকতে গিয়েছেন তারা হয়তো ইতিমধ্যেই বুঝে গিয়েছেন। আর যারা বোঝেননি বা কোথাও যাননি, তাদের বলছি আপনি হয়তো্ সাগরের নীল জলরাশি পাবেন, কিন্তু আপনি পাবেন না একটা ঝকঝকে তকতকে সমুদ্র সৈকত।
আপনি যখন আপনার স্বপ্নীল আবহের কথা চিন্তা করছেন তখন কেমন লাগবে সেই কল্পনায় নোংরা কোনো একটা পরিবেশ? নিশ্চয়ই ভালো লাগবেনা তাইনা? আমাদেরও ভালো লাগেনি।
আর ভালো লাগেনি বলে কিছু করার চিন্তাটা চলছিলো অনেকদিন ধরেই। যেহেতু এটা আমাদের সৈকত তাই এটাকে পরিষ্কার রাখাটা আমাদের একটা নৈতিক দায়ীত্ব। কিন্তু করবটা কি? আমরা যখন বেড়াতে গেলাম তখন হয়তো যতটুকু সম্ভব আমি নিজে কম নোংরা করার চেষ্টা করলাম কিন্তু তাতে কি? অন্যরা তো করছে? তাইনা? এমনটিই তো ভাবছেন। কিন্তু একবার মেলানোর চেষ্টা করুনতো আপনি কি কখোনো এভাবে চিন্তা করেছেন? হয়তো করেছেন আবার মনে করেছেন যে কি দরকার বাপু যার যার কাজ সেই করুক না।
কিন্তু আমরা আমাদের জন্য হলেও কিছু করে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। তখনই হঠাৎ নজরে এলো পৃথিবীর সমুদ্র সৈকতগুলো পরিষ্কার করার একটা প্রচেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলছে। দ্যা ওশেন কনসারভেনসী নামে একটা সংগঠন সমুদ্র বাঁচাও আন্দোলন নামে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের কার্যবিধির একটা বড় অংশ হলো ইন্টারন্যাশনাল কোষ্টাল ক্লিনআপ। এটি হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার হলো পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের অধিকারী হয়েও আমাদের দেশে এরকম কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনা।
তো এবার আমরা চিন্তা করলাম আমাদের সেই স্বপ্নটাকে বাস্তবে রুপ দিতে। অর্থাৎ একটা সুন্দর সমুদ্র সৈকতের জন্য কাজ করতে। যেহেতু এরকম ধারনা এদেশে এবারই প্রথম তাই আমরা আমাদের সহযোগীতার জন্য সাহায্য চাইলাম দ্যা ওশেন কনসারভেনসী সংস্থার কাছে। তারা আমাদের সাথে এক হয়ে কাজ করতে চাইলো।
আমরাও এক হয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এবার আমাদের পরিচয়টা দেয়া যাক। আমরা হলাম একদল ঘরছাড়া মানুষ। এই নগরের ব্যস্ত জীবন থেকে সুযোগ পেলেই হারিয়ে যেতে চাই। খুজে ফিরি প্রকৃতির কাছে আশ্রয়।
ছোট জীবনে যতটুকু সম্ভব এই প্রকৃতীর রুপ দর্শন করতে চাই আমাদের মতো করে। সোজা বাংলায় আমরা ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি, একা বা দলবেধে। আমাদের একটা কমিউনিটি আছে যারা ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসেন, একটু অ্যাডভেঞ্চার বা শুধুই ঘোরাঘুরি তাদের কমিউনিটি এটি। নাম কেওক্রাডং। ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন এমন যে কেউই আমাদের এই কমিউনিটি তে সাদর আমন্ত্রণ।
আমাদের ওযেব অ্যাড্রেস হলো (িি.িশবশিৎধফড়হম.পড়স)।
তো যা বলছিলাম, পর্যটকসহ সমুদ্র তীরবতর্ী অঞ্চলের মানুষ কে পরিবেশ সম্মন্ধে সচেতন করা্ই আমাদের এই কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিলো। আমাদের প্রতিদিনিকার ফেলে দেয়া জিনিসের মধ্যে যেসব জিনিস মাটির সাথে মেশেনা, যেমন: বিস্কুট, চীপস ইত্যাদির প্লাস্টিকের মোড়ক, সিগারেটের ফিল্টার ইত্যাদি পরিষ্কার করা যতটুকু সম্ভব। তবে তার আগে আমরা জনসচেতনতা তৈরীর জন্য মানব বন্ধনের আয়োজন করলাম "সমুদ্র বাঁচাও" শিরোনামে। মানব বন্ধনটি ঢাকার দুটি স্পটে আয়োজিত হয়েছিলো 17ই সেপ্টেম্বরে।
প্রথমটি ছিলো সকাল 8.00 টার সময় ঢাকা প্রেসক্লাবের সামনে, যেখানে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো প্রথম-আলো বন্ধুসভা; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবৃন্দ; ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভর্ািসটি বাংলাদেশের নৃতত্ব বিভাগের ছাত্র-ছাত্রি বৃন্দ; সাদা (সামাজিক দায়বদ্ধতা); বিটিএফ এবং ধানমন্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুলের ওল্ড স্কাউটস্ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যবৃন্দ। আমাদের দ্বিতীয় মানব বন্ধনটি আয়োজিত হয় মহাখালিস্থ ব্র্যাক সেন্টারের সামনে। এখানে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলো নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি আর্থ ক্লাব, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এনভাইরোমেন্টাল ক্লাব ছাড়াও আরো অনেকে।
আমাদের দ্বিতীয় কার্যক্রম ছিলো কক্্রবাজার বীচ থেকে এসব ক্ষতিকর বস্তু পরীষ্কার করা। জানি একদিনে খুব বেশী পরীষ্কার করা সম্ভব নয়।
তবুও ওইসব এলাকার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাই ছিলো এটা আমাদের। যাই হোক প্রবল বৃষ্টি মাথায় করে 21 তারিখে কক্্রবাজার রওয়ানা হলাম আমরা কেওক্রাডং কমিউনিটির জনা পঁচিশেক সদস্য। যদিও তখনও জানিনা কি বিপদ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কারণ, আমরা যে রাতে রওনা দেই কক্্রবাজারের উদ্দেশ্যে তার আগের দিন থেকেই নিম্নচাপের কারনে পুরো দেশে প্রবল বর্ষণ হচ্ছিলো। তো আমাদের প্রোগ্রাম কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ কাজ করছিলো।
এর সাথে মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো কক্্রবাজার বীচে 10 নম্বর সিগন্যাল ছিলো। এরকম একটা অবস্থায় আমরা যখন পরের দিন সকালে কক্্রবাজারে নামলাম তখন সেখানে বৃষ্টি হচ্ছে। আমরা মাথা গোজার জন্য আমাদের কক্্রবাজারের শরণার্থি ত্রাণ ও প্রত্যবাসন কমিটির কার্যালয়ে (আর আর আর সি) আশ্রয় নিলাম। বেলা 11টা নাগাদ বৃষ্টি একটু কমে এলে আমরা কাজে নামার সিদ্ধান্ত নিলাম। এরমধ্যে দর্শন ক্লাব কক্্রবাজার এবং কক্্রবাজার জেলা স্কুলের ছাত্রছাত্রিরা আমাদের সাথে কাজে যোগ দেয়ার জন্য এসে পড়লো।
তাদের নিয়ে আমাদের এই প্রোগ্রামের একটি উদ্বোধনী র্যালী অনুষ্ঠিত হলো যার সার্বিক তত্বাবধানে ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল কোষ্টাল ক্লিনআপ বাংলাদেশ এর কান্ট্রি কো অর্ডিনেটর মুনতাসির মামুন ইমরান ভাই।
র্যালীটি লাবণী বীচ পয়েন্ট এলাকা প্রদক্ষিণ শেষে এর উদ্বোধন করেন কক্্রবাজার জেলার এডিসি সাহেব। তারপর আমরা স্কুলের ছেলেদের নিয়ে কাজে নেমে পড়লাম, এবং প্রায় 6 ঘন্টাব্যপি বীচ এলাকা পরিষ্কারের কাজ করলাম। আমাদের এই কাজের ফাকে ফাকে এলাকার মানুষকে এই কার্যক্রমের ব্যাপারে অবহিত করা হচ্ছিলো। এবং পর্যটকদের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য লিফলেট বিলি করা হচ্ছিলো।
আমরা কাজ শেষে পেলাম প্রায 25ব্যাগ (!) পরিবেশের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর পদার্থ সমৃদ্ধ বস্তু এবং স্থানীয় মানুষের ভালোবাসা। এরপরে বৃষ্টি আবারো নামলে সেদিনের এই প্রোগ্রামের সমাপ্তি ঘোষনা করলেন এডিসি সাহেব। এবং আমরা আমাদের সংগৃহীত বস্তু গুলো ময়লা ফেলার জন্য নিদিৃষ্ট স্থানে ফেলে দিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিলেঅ কম জায়গা নিয়ে বেশী সময় ধরে পরীষ্কার করা। এবং আমরা মোটামোটি সফল।
এখানে বলে রাখা ভারো আমাদের সাথে কোন বড় কোম্পানীর স্পনসর ছিলোনা আমরা যা করেছি পুরোটাই ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
এবার আবার চলুন সেই স্বপ্নটায় ফিরে যাই। যদি আমরা আরেকটু সচেতন হই। যদি আমরা অন্তত আমাদের সমুদ্র সৈকতের ময়লাগুলো নির্দিষ্ট স্থানে ফেলি তবে আমার মনে হয় সেই দিন খুব বেশী দুরে নয় যেদিন কল্পনায় নয় বাস্তবেই আমরা এই সৈকত দেখতে পাবো। ধন্যবাদ নিত্য-উপহার কে আমাদের এই কাজে টি-শার্ট ও ব্যান্টেনা দিয়ে সহায়তা করার জন্য।
আর আপনাদের আমন্ত্রন রইলো আগামী প্রোগ্রামে আমাদের সহযাত্রী হওয়ার। আসুন আজ থেকে আমরা সমুদ্র সৈকত পরিষ্কার রাখি। অন্তত সেইসব ময়লা না ফেলি যা ক্ষতিকর। আমাদের সৈকত বাচাতে হবে আমাদেরই। খুব কি কঠিন স্বপ্নটাকে বাস্তবে রুপ দেয়া?
লেখন : বন্ধু প্রতিম জিটু
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।