উদ্ধারকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক—সবার হাতে, পকেটে সুগন্ধীর ক্যান। চারদিকে বৃষ্টির মতো চলছে সুগন্ধি ছিটানো। কিন্তু এক মিনিটও থাকে না সুগন্ধের রেশ। তার পরও শুধুই বাতাস ভারী করা লাশের গন্ধ। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে শুধু পচা গন্ধ বের হচ্ছে, তবে সেখানে কত লাশ আটকে আছে বা নিখোঁজের প্রকৃত সংখ্যা কত, তার কোনো হিসাব নেই।
জেলা প্রশাসন জীবিত উদ্ধার, মৃত ও হস্তান্তর হওয়া লাশের তালিকা করে বোর্ডে সংখ্যা লিখে রাখলেও নিখোঁজদের তালিকা করেনি। তবে সাভার পুলিশের হিসাবে নিখোঁজের সংখ্যা এক হাজারের মতো।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার ক্লাবের শিক্ষার্থীরা নিখোঁজদের একটি তালিকা করছেন। তাঁদের হিসাবেও নিখোঁজের সংখ্যা এক হাজারের মতো।
আইবিএর ছাত্র রাজিবুল ইসলাম বলেন, গত বুধবার ভবনধসের পর থেকে এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা নিখোঁজের যে তালিকা সংগ্রহ করছিলেন, তাতে মোট এক হাজার ৩৫০ জনের নাম নিবন্ধিত হয়েছে।
এর মধ্যে বেশ কিছু লোক উদ্ধার হয়েছেন, কারও নাম দুইবার লেখা হয়েছে। এসব বাদ দিয়ে এখন পর্যন্ত তাঁদের হিসাব অনুযায়ী, এক হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। আইবিএর পরিচালকের নেতৃত্বে শিক্ষকেরা ওই নিখোঁজ তালিকা আরও যাচাই-বাছাই করে সুনির্দিষ্ট করার কাজ করছেন।
এই নিখোঁজদের খোঁজে ধ্বংসস্তূপের আশপাশে অবস্থান নিয়েছেন হাজারো মানুষ। নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে ছুটছেন হাসপাতালে, মর্গে, আরও যেখানে যেখানে যাওয়া সম্ভব।
অবিশ্বাস থেকে তাঁরা তল্লাশি করছেন ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজে নিয়োজিত ট্রাকগুলোতেও। অনেকেই রাত কাটাচ্ছেন ধ্বংসস্তূপের আশপাশে। প্রিয় স্বজনের খোঁজে নিরাপত্তাকর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেউ কেউ ঢুকে পড়ছেন নিরাপত্তা চৌহদ্দির ভেতরে।
নিখোঁজদের সন্ধান চেয়ে লাগানো পোস্টারে ভরে গেছে পুরো সাভার। অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়, বিভিন্ন হাসপাতালের ফটক আর ধ্বংসস্তূপের আশপাশে সাঁটানো হয়েছে প্রচুর পোস্টার।
তাঁদেরই একজন কারিনা বেগম। চোখে আর জল নেই। এখন আর কাঁদতে পারেন না। রানা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বামীর ছবিসংবলিত পোস্টার হাতে। জানতে চাইলে অনেকটা যন্ত্রের মতো বলেন, তাঁরা স্বামী-স্ত্রী একই ভবনের তিন ও চার তলায় কাজ করতেন।
ভবনধসের পরও চার তলা থেকে একা একাই বের হয়ে আসেন তিনি। শরীরে আঘাত লাগেনি। তবে কোনো খোঁজ নেই স্বামী ইসরাফিলের। ওই দিন থেকেই স্বামীর খোঁজ করছেন তিনি। স্বামীকে না পেলে দুই বছরের ছেলে আসাদুলের কী হবে—এই চিন্তায় প্রথম তিন দিন খুব কেঁদেছেন।
এখন পাথর হয়ে গেছেন। ধরে নিয়েছেন আর ফিরবেন না ইসরাফিল। এখন শুধু স্বামীর লাশের প্রতীক্ষা। কারিনা বলেন, ‘পোলাডারে তো তার বাপের কবর বুঝাইয়া দেওন লাগব। ’
স্ত্রী লিপি আক্তারের খোঁজ করতে করতে ভবনের পেছনের দিকে চলে এসেছিলেন জিল্লুর রহমান।
সেখানে তখন ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে উদ্ধারকাজ চলছিল। গতকাল দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে জিল্লুরকে দেখা গেল স্ত্রীর ছবিসংবলিত লেমিনেটেড পোস্টারটি জড়িয়ে ধরে ঘুমে ঢুলে পড়ছেন। পরে নিরাপত্তাকর্মীরা তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি জানান, লিপি তিন তলায় ছিলেন। তাঁদের দেড় বছরের একটি ছেলে আছে।
কান্নায় ভেঙে পড়ে জিল্লুর বলেন, ‘বাপের কিছু নাই। ভাবছিলাম ছইলডাক একনা নেখাপড়া শেখায়া ওর ভবিষ্যত্ গড়ি দেব। ওই জন্যই বউক ধরি ঢাকা আসলাম, কারখানাত কাজ নিলাম। এখন তো ওর মাওয়ে নাই। আমি একা ওরে ক্যামনে মানুষ করব, ভাই।
’ ছয় দিন ধরে স্ত্রীকে খুঁজে ফিরছেন তিনি।
আজ ভোর পাঁচটার দিকে রানা প্লাজার উল্টো দিকের এটিএম বুথের বারান্দায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছিল চারজনের একটি পরিবার। পরিবারের সদস্য গাড়িচালক মেহেদি হাসান বলেন, তাঁর ভগ্নিপতি উজ্জ্বলের জন্য পরিবারের সবাই এখানে। বেঁচে থাকতে উজ্জ্বলের সঙ্গে বোনের বিয়ে মেনে নেয়নি মেহেদির পরিবার। এখন উজ্জ্বলের ছয় বছরের মেয়ের জন্য অন্তত লাশটা চান তাঁরা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।