আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এশিয়া এনার্জির বিরোধিতাই নাসরিন হকের মৃতু্যর কারণ?-লন্ডন অবজারভারে চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন

বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংস্কৃতির জন্য অপমানজনক কোনকিছু এই ব্লগে লেখা যাবে না।

রহস্যময় এক গাড়ি দুর্ঘটনায় উন্নয়ন সংগঠন 'অ্যাকশন এইড'-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর নাসরিন হকের মর্মানত্দিক মৃতু্যর সঙ্গে কি সম্পর্ক থাকতে পারে ফুলবাড়ীতে কয়লাখনি প্রকল্প নিয়ে এশিয়া এনার্জির বির"দ্ধে সমপ্রতি সংঘটিত গণবিস্ফোরণের? লন্ডনের 'দ্য সানডে অবজারভার' এ সংক্রানত্দ এক চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গতকাল। প্রতিবেদনে সন্দেহ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, সম্পর্ক থাকতে পারে। জেমি ডওয়ার্ড ও মাহতাব হায়দারের লেখা প্রতিবেদনটি এরকম : বিতর্কিত 'উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলন' সংক্রানত্দ একটি প্রকল্পের ঘোর বিরোধিতা করার কিছুদিনের মধ্যে গত 24 এপ্রিল নিজ বাসভবনের সামনেই এক রহস্যজনক গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন নাসরিন হক। প্রথমে মৃতু্যকে নিছক দুর্ঘটনা মনে করা হলেও পরে এর পেছনে ষড়যন্ত্রের সন্দেহটি ডানা মেলতে থাকে।

ঘটনার দিন সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে নিজের গাড়িতে ওঠার জন্য তিনি যখন অপেক্ষা করছিলেন সে সময় তার ব্যক্তিগত ড্রাইভারই গাড়িটি চালিয়ে দেয় নাসরিন হকের ওপর। তাকে ঠেলে নিয়ে দেয়ালের সঙ্গে পিষ্ট করা হয়। এই রহস্যময় মৃতু্যর সঙ্গে বিতর্কিত এশিয়া এনার্জিকে জড়িয়ে গতকাল রোববার লন্ডনের দ্য সানডে অবজারভারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাসরিন হক অকারণে মারা যাননি। এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের যে প্রকল্প বাসত্দবায়ন করতে চাইছে তার বিরোধিতা করতে গিয়েই মৃতু্য হয়েছে নাসরিন হকের। প্রতিবেদনের বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, নাসরিন বাংলাদেশে মূলত একজন উন্নয়নকর্মী হিসেবেই বিপুলভাবে পরিচিত ছিলেন।

কিন' এক পর্যায়ে, দেশের দরিদ্রতম ফুলবাড়ী অঞ্চলে একটি ব্রিটিশ কোম্পানি কর্তৃক উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলন পরিকল্পনার বিরোধিতা করতে শুর" করেন। তিনি জানতেন ওই পরিকল্পনাটি যদি বাসত্দবায়িত হয় তাহলে 40 হাজার থেকে 1 লাখ লোক গৃহহীন হয়ে পড়বে। এশিয়া এনার্জির পরিকল্পনা ছিল ফুলবাড়ী থেকে বছরে অনত্দত দেড় কোটি 50 টন কয়লা উত্তোলনের। তাদের ধারণা অনুযায়ী পরের 30 বছর ধরে একটানা এ হারে কয়লা তোলা সম্ভব। এশিয়া এনার্জি এ কয়লা বিক্রি করতে চেয়েছিল জ্বালানি-ক্ষুধায় উন্মত্ত ভারত ও চীনের কাছে।

বছরে দেড় কোটি টন কয়লা মানে বিশাল ব্যাপার। বাসত্দবটা যদি এমনই হয় তাহলে ফুলবাড়ী হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো কয়লা উৎপাদন প্রকল্প। এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী প্রকল্পকে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে ব্রিটেনের প্রধান ব্যাংকগুলো, যার মধ্যে রয়েছে 'বারক্লে'ও। সানডে অবজারভারে বলা হয়েছে, ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জিকে যদি কয়লা খুঁড়তে দেওয়া হয় তাহলে কোম্পানিটি বিপুল পরিমাণ মুনাফা লুটবে। বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কোম্পানিটির যে চুক্তি হয় সে অনুযায়ী প্রতি টন কয়লার জন্য সরকার পেতো 2 হাজার টাকার (14.70 পাউন্ড) মতো।

ফুলবাড়ীর কয়লার যে মান সে অনুযায়ী প্রতি টনের জন্য প্রায় 7 হাজার টাকা (53.50 পাউন্ড) পাওয়া সম্ভব। এশিয়া এনার্জি কয়লার দামের ব্যাপারে সমঝোতা করতে রাজি ছিল। কিন' তারা ফুলবাড়ী থেকে বসতি উচ্ছেদ করতে চেয়েছে। চেয়েছে সেখানকার প্রাকৃতিক বিন্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে। তাদের এ চাওয়াটাই সৃষ্টি করেছে উত্তেজনা।

সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেনি কোম্পানির এ পরিকল্পনা। তারা প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে মারা গেছেন অনত্দত 5 জন। আহত হয়েছেন শত শত। সৃষ্ট গণআন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এশিয়া এনার্জির স্থানীয় অফিস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।

কোম্পানি কিন' দাবি করেছে বেশিরভাগ স্থানীয় মানুষ তাদের উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলন পরিকল্পনার সমর্থক। ডেভিড লেনিগাস নামে কোম্পানির এক পরিচালক বলেছেন, 'আন্দোলনকারীদের মধ্যে শতকরা 95 ভাগই স্থানীয় লোক নন। এই লোকগুলো এমন করছে যেন আমরা কয়লাখনি আবিষ্কার করে ফেলেছি। আমরা কিন' এখনো কয়লার খনি পাইনি। সম্ভাব্যতা যাচাই করতে গিয়েই 2 কোটি ডলারের মতো খরচ করে ফেলেছি।

' প্রতিবেদনে বলা হয়, লেনিগাস যা-ই বলুন এটা খুবই স্বাভাবিক যে নাসরিন হকের মতো টেকসই উন্নয়ন মতবাদীরা অল্প সময়ে বেশি পরিমাণ কয়লা উত্তোলনের ঘোর বিরোধিতা করেন। তারা চান উত্তোলনটা ধীরগতিতে হোক, যাতে পরিবেশের বিপর্যয় না ঘটে। এ ইসু্যর সঙ্গে রাজনীতি, ক্ষমতার হাতবদল খুব ভালোভাবেই জড়িয়ে আছে। আর সামনেই পরবর্তী নির্বাচন। এ প্রেক্ষাপটে এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী প্রকল্প হয়ে উঠেছিল খুবই গুর"ত্বপূর্ণ।

গত ফেব্রচ্ছারিতে নাসরিন হক যখন এশিয়া এনার্জির নির্বাহী পরিচালকদের কাছ থেকে পরিকল্পনাটি সম্পর্কে ধারণা নেন তখনই বিষয়টির বিরোধিতা করতে শুর" করেন। নাসরিনের ঘনিষ্ঠজনদের মতে, আনত্দর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক ব্রিটিশ দপ্তর নাসরিনের এ বিরোধিতা সহজভাবে নেয়নি। নাসরিন তার বোন শিরিনের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। শিরিন কাজ করেন ডেনিশ উন্নয়ন সংস্থা-ডানিডা'য়। তার কাছে নাসরিন বলেছিলেন যে, ব্রিটিশ দপ্তরের ঢাকাস্থ প্রধান ডেভিড উড তাকে কয়লাখনির বিরোধিতা না করার জন্য বলেছেন।

শিরিন জানান, আমার মনে আছে, ও খুব ক্ষেপে গিয়েছিল। নাসরিন বলেছিল, ওদের ভাবটা এমন যেন ওরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আমাকে বললো এশিয়া এনার্জিকে ছেড়ে দিতে। কারণ, অ্যাকশন এইড একটি ব্রিটিশ সংস্থা। নাসরিন কয়লাখনির পরিকল্পনা সম্পর্কে বিসত্দারিত জেনে যোগাযোগ করেছিল লন্ডনের আইনজীবীদের সঙ্গে।

চেয়েছিল আনত্দর্জাতিক আদালতে ওদের বির"দ্ধে মামলা করতে। শিরিন হক জানিয়েছেন, নাসরিন কয়লাখনি বিষয়ে একটি ডোশিয়ার তৈরি করেছিল। এটা সে প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছিল। অ্যাকশন এইড অবশ্য জানিয়েছে, এমন কোনো ডোশিয়ারের খবর তারা জানেন না। শিরিন হক বলেন, 'নাসরিনের মৃতু্যর পরপর ওর সহকর্মীরা এসেছিল দেখা করতে।

তখন মৃতু্যর আঘাতটাই ছিল বড়ো। প্রায় সবাই ছিলেন আবেগে আক্রানত্দ। তবে এর মধ্যেই কেউ কেউ আলাপ করছিলেন, ডেভিড উড নাসরিনকে বলেছেন, লন্ডনের অনেকেই নাসরিনের কাজকর্ম নিয়ে ক্ষিপ্ত। তারা বাড়াবাড়ি সহ্য করতে চাইছে না। অ্যাকশন এইড এবং এশিয়া এনার্জির মধ্যে কোনো মতপার্থক্য থাকলে তা নিরসন করে ফেলারও তাগিদ দেওয়া হয়েছিল নাসরিনকে।

' এমন দাবিও করা হচ্ছে যে, নাসরিনকে খনি নিয়ে বিরোধিতা করতে নিষেধ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, কয়লাখনির বিরোধিতা করলে অ্যাকশন এইডকে অর্থ সহায়তা দেওয়া হবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তবে এ বিষয়টি অস্বীকার করেছেন লন্ডন এবং ঢাকার অফিসিয়ালরা। ব্রিটিশ হাইকমিশনের এক মুখপাত্র বলেছেন, এমন গুজবের কোনো ভিত্তি নেই। ভিত্তি থাক বা না থাক, এটি সত্য যে, নাসরিন আকস্মিকভাবে মারা গেছেন মাত্র 48 বছর বয়সে।

তার মৃতু্যটাকে প্রথমে নিছক দুর্ঘটনা মনে করা হলেও পরে কিছু সন্দেহের সৃষ্টি হয় এবং ঘনিষ্ঠ আত্মীয়রা একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। নাসরিনের ব্যক্তিগত ড্রাইভারকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়। এই ঘটনাও অনেক আগের। এখনো ড্রাইভারের বির"দ্ধে কোনো চার্জ গঠন করা হয়নি।

পুলিশ বলছে তদনত্দ চলছে। ওদিকে অ্যাকশন এইডের মিডিয়া বিভাগের প্রধান জেন মোয়ো বলেছেন, 'আমরা মনে করি, এটা একটি দুঃখজনক দুর্ঘটনা। ' মোয়ো নাসরিনের মৃতু্যর কিছুদিন আগে বাংলাদেশে আসেন। তার বিশ্বাস, ড্রাইভার ব্রেকে চাপ দিতে গিয়ে এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে ফেলেন এবং দুর্ঘটনাটি ঘটে যায়। তবে ব্যক্তিগতভাবে অ্যাকশন এইডে কর্মরত নাসরিনের কয়েকজন সহকর্মী মনে করেন, কয়লাখনি নিয়ে মাথা ঘামানো নাসরিনের উচিত হয়নি।

কারণ, অ্যাকশন এইডের কাজ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে। পরিবেশের ইসু্য নিয়ে ব্যসত্দ হওয়ার কোনো কারণ নেই এর কর্মীদের। সংস্থার কর্মীরা অবজারভারকে জানিয়েছেন, কোনো ব্রিটিশ কর্মকর্তা নাসরিনকে কয়লাখনি বিষয়ে মাথা না ঘামাতে বলেছেন কিনা তা তাদের জানা নেই। মোয়ো বলেন, 'ওর পরিবারের পক্ষ থেকে এমন কথা আমাদের জানানো হয়েছে। কিন' সত্যি বলতে কি, আমরা এ বিষয়ে কিছু জানি না।

তিনিও এমন কোনো কথা বলেছেন তা আমাদের রেকর্ডে নেই। ' প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও এশিয়া এনার্জির সঙ্গে অ্যাকশন এইডের ব্রিটিশ সদর দপ্তরের কোনো প্রত্যক্ষ সংযোগ নেই। এরপরও ওই দপ্তর যে ব্রিটিশ স্বার্থ দেখবে তা সহজেই অনুমেয়। এশিয়া এনার্জি বিপুল লাভের আশায়ই ফুলবাড়ীতে আসত্দানা গেড়েছিল। তারা ফুলবাড়ীর স্থানীয় বাসিন্দাদের নানাভাবে সন'ষ্ট করতে চেয়েছিল।

প্রতিশ্র"তি দিয়েছিল 2 হাজার লোককে চাকরি দেওয়া হবে। 210 কোটি টাকা খরচ করা হবে ফুলবাড়ীতে স্কুল এবং হাসপাতাল নির্মাণে। যারা গৃহহীন হবে তাদেরকে নতুন গ্রাম বানিয়ে সেখানে বসত দেওয়া হবে_এমনই ছিল তাদের প্রতিশ্র"তির বহর। কোম্পানির পরিচালক লেনিগাস জানিয়েছেন, '1970-এর আগে ফুলবাড়ীর অসত্দিত্বই ছিল না। এমন তো নয় যে, শহরটি 3 শ' বছরের পুরোনো।

এখানকার অনেক মানুষই পাতলা টিনের অথবা কাদামাটির ঘরে থাকে। ' কোম্পানিটি প্রকারানত্দরে বোঝাতে চাইছে, ফুলবাড়ী প্রকল্প বাসত্দবায়ন করে তারা এখানকার মানুষের উপকারই করতে চেয়েছে। কোম্পানির এমন ধারণা কিন' বিজ্ঞানীরা সমর্থন করছেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হলে পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। কয়লা ওঠাতে গেলে মাটির গভীর থেকে যে পরিমাণ পানি তুলে ফেলতে হবে তাতে ভূ-সত্দরে সৃষ্টি হবে ভয়াবহ শূন্যতা।

এতে করে যে কোনো বড়ো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। এসব বিষয় বুঝতে পেরেই প্রতিবাদী হয়েছিলেন নাসরিন হক। সেই প্রতিবাদ পিষ্ট হয়েছে তারই গাড়ি বারান্দার দেয়ালে। কিন' ফুলবাড়ীর হাজার হাজার মানুষের প্রতিবাদ বৃথা যায়নি। 6টি প্রাণের বিনিময়ে আদায় হয়েছে দাবি।

না 6টি নয়! ফুলবাড়ীর নিহত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে 24 এপ্রিল মারা যাওয়া নাসরিন হককেও যোগ করে নিতে হবে হয়তো। :::লন্ডন অবজারভার::: :::ভোরের কাগজ::: :::সমকাল :::

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.