আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাহসী মানুষের গল্প

জুলাই সংখ্যা'06

সাহসের নিত্য সহচর কায়েস মাহমুদ খুব কম বয়স। একেবারেই কিশোর। কিন্তু শরীরে যেমন স্বাস্থ্য, তেমনি শক্তি। তাজি ঘোড়ার মত টগবগ করে ছুটে বেড়ান তিনি। কাউকে পরওয়া করেন না।

সাহসের তেজ ঠিকরে বের হয়ে আসে তার দেহ থেকে। সমবয়সী তো দূরে থাক, অনেক বড় পাহলোয়ানও হার মানে তার সাথে মলস্নযুদ্ধে। সে এক অবাক করার মত দুঃসাহসী শক্তিশালী কিশোর! নাম যুবাইর ইবনুল আওয়াম। রাসূলের (সা) দাওয়াতে তখন মুখরিত চারদিক। নবীজীর ডাকে সাড়া দিতে দলে দলে লোক ছুটে আসছে তাঁর কাফেলার কাতারে।

পুরো মক্কায় তখন ইসলামের দাওয়াতী আওয়াজ। ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে তার মৌ মৌ গন্ধ। শানত্দির সৌরভে ক্রমশ ভরে উঠছে বিশ্বাসীদের হৃদয়ের চাতাল। যুবাইরও দেখছেন। দেখছেন আর শুনছেন ফিসফিস মধুর গুঞ্জন।

তারও কানে বেজে উঠছে রাসূলের (সা) কণ্ঠনি:সৃত সেই মধুর এবং শাশ্বত শিৰা। _ এসো আলোর পথে। এসো সুন্দরের পথে। এসো আলস্নাহর পথে। এসো রাসূলের পথে।

যুবাইরের বয়স তখন মাত্র ষোল। বয়সে কিশোর। কিন্তু তার শরীরে বইছে যৌবনের জোয়ার। যে কোনো যুবকের চেয়েও তিনি অনেক বেশি সবল এবং সাহসী। কানখাড়া করে যুবাইর শুনলেন রাসূলের (সা) আহ্বান।

আর দেরি নয়। সাথে সাথে তিনি কবুল করলেন ইসলাম। দয়ার নবীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন এক পরম প্রশানত্দির ছায়ায়। রাসূলও তাকে স্থান দিলেন স্নেহের বাহুডোরে। রাসূলের (সা) প্রতি যুবাইরের ভালোবাসা ছিল অপরিসীম।

সেই ভালোবাসার কোনো তুলনায় চলে না। একবার কে যেন রটিয়ে ছিল, মুশরিকরা বন্দি অথবা হত্যা করেছে প্রাণপ্রিয় নবীকে। _ এ কথা শুনার সাথে সাথেই বারম্নদের মত জ্বলে উঠলেন যুবাইর। অসম্ভব! অসম্ভব এ দুঃসাহস! তিনি একটানে কোষমুক্ত করলেন তার তরবারি। তারপর যাবতীয় ভিড় ঠেলে, ঊর্ধশ্বাসে ছুটে গেলেন নবীজীর কাছে।

রাসূল তাকালেন যুবাইরের দিকে। তিনি বুঝে গেলেন যুবাইরের হৃদয়ের ভাষা। তিনি হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে যুবাইর? যুবাইরের ভেতর তখনও বয়ে যাচ্ছে ক্রোধের কম্পন। তিনি বললেন, হে রাসূল! খবর পেলাম, আপনি বন্দি অথবা নিহত হয়েছেন! রাসূল খুশি হলেন যুবাইরের আত্মত্যাগ আর ভালোবাসার নজির দেখে।

তিনি দোয়া করলেন খুশি হয়ে তার জন্য। এটাই ছিল প্রথম তরবারি, যা জীবন উৎসর্গের জন্য প্রথম একজন কিশোর কোষমুক্ত করেছিলেন। ইসলাম গ্রহণের কারণে যুবাইরের ওপরও নেমে এসেছিল অকথ্য নির্যাতন। তার চাচা, যে চাচাকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন প্রাণ দিয়ে, সেও মুহূর্তে শত্রম্ন হয়ে গেল কেবল সত্য গ্রহণের কারণে। পাপিষ্ঠ চাচা! নিষ্ঠুর চাচা! হিংস্র পশুকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

গরম, উত্তপ্ত পাথর! যে পাথরের ওপর ধান ছিটিয়ে দিলেও খই হয়ে যায়। _ এমন গরম পাথরের ওপর চিৎ করে শুইয়ে দিত ভাতিজা যুবাইরকে। আর বলতো ইসলাম ত্যাগ করার জন্য। কিন্তু একবার যে পেয়ে গেছে সত্যের পরশ, সে কি আর বিভ্রানত্দ হতে পারে কোনো অত্যাচার আর নির্যাতনে? না! যুবাইরও চুল পরিমাণ সরে আসেননি তার বিশ্বাস থেকে। তার সত্য থেকে।

বরং নির্যাতন যত বেড়ে যেত, ততোই বেড়ে যেত তার আত্মবিশ্রাস আর সাহসের মাত্রা। তিনি কঠিন সময়েও পরীৰা দিতেন ঈমান আর ধৈর্যের। তিনি ছিলেন হরিণের চেয়েও ৰিপ্রগতির আর বাঘের চেয়েও দুঃসাহসী! বদর যুদ্ধে দেখা গেল যুবাইরের সেই ভয়ঙ্কর চেহারা। মুশরিকদের জন্য সেদিন তিনি ছিলেন বিভীষিকার চেয়েও ভয়ানক! সেদিন মুশরিকদের সুদৃঢ় প্রতিরোধ প্রাচীর ভেঙে তছনছ করে দেন তিনি। একজন মুশরিক সৈনিক কৌশলে উঠে গেছে একটি টিলার ওপর।

সেখান থেকে সেই ধূর্ত চিৎকার করে যুবাইরকে আহ্বান জানালো দ্বন্দ্ব যুদ্ধের। ইচ্ছা ছিল যুবাইরকে পরাসত্দ করা। তার আহ্বানে সাড়া দিলেন যুবাইর। উঠে গেলেন টিলার ওপর। তারপর তাকে জাপটে ধরলেন আচ্ছা করে।

দু'জনই টিলা থেকে গড়িয়ে পড়ছেন নিচে। রাসূল দেখছেন সবই। বললেন, এদের মধ্যে যে প্রথম ভূমিতে পড়বে, নিহত হবে সেই। কী আশ্চর্য! রাসূলের কথা শেষ হতেই ভূমিতে প্রথম পড়লো সেই মুশরিকটি। আর সাথে সাথেই তরবারিটির একটি মাত্র আঘাতে দ্বি-খণ্ডিত করে ফেললেন যুবাইর।

এবার মুখোমুখি হলেন আর একজন_ উবাইদা ইবন সাঈদের। সে এমনভাবে বর্মাচ্ছাদিত ছিল যে তার চোখ দু'টো ছাড়া আর কি দেখা যাচ্ছিল না। কুশলী এবং সতর্ক যুবাইর। তিনি উবাইদার চোখ নিশানা করে তীর ছুঁড়লেন। অব্যর্থ নিশানা! বিদু্যৎগতিতে তীরটি বিঁধে গেল উবাইদার চোখে।

এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে তীরটি গেঁথে আছে তার চোখের ওপর। যুবাইর ছুটে গেলেন উবাইদার কাছে। তারপর তার লাশের ওপর বসে তীরটি টেনে বের করে আনলেন। কিছুটা বেঁকে গেছে। সেই বাঁকা তীরটি রাসূল (সা) নিয়ে রেখেছিলেন স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে।

রাসূলের ইনত্দেকালের পর খলিফাদের কাছেও রৰিত ছিল এই ঐতিহাসিক তীরটি। হযরত উসমানের শাহাদাতের পর নিজের কাছেই আবার তীরটি নিয়ে নেন যুবাইর! বদর যুদ্ধে তিনি জীবনবাজি রেখে এমনভাবে যুদ্ধ করেছিলেন যে ভোতা হয়ে গিয়েছিল তার তরবারিটি। তিনিও আহত হয়েছিলেন মারাত্মকভাবে। শরীরে একটি গর্ত হয়ে গিয়েছিল বিশাল। তার ছেলে উরওয়া বলতেন, আমরা আব্বার শরীরের সেই গর্তে আঙ্গুল ঢুকিয়ে খেলা করতাম।

বদর যুদ্ধে যুবাইয়ের মাথায় ছিল হলুদ পাগড়ি। রাসূল (সা) হেসে বলেছিলেন, 'আজ ফেরেশতারাও এই বেশে এসেছে। ' উহুদ যুদ্ধ! সত্য এবং মিথ্যার যুদ্ধ। রাসূল কোষমুক্ত করলেন তার তরবারি। তারপর বললেন, আজ কে এই তরবারির হক আদায় করতে পারবে?' রাসূলের (সা) আহ্বানে সকল সাহাবীই অত্যনত্দ আনন্দের সাথে চিৎকার করে বললেন, আমি! আমিই পারবো এই তরবারির হক আদায় করতে।

সেখানে উপস্থিত ছিলেন যুবাইর। তিনি তিন তিনবার বললেন, হে রাসূল! আমাকে দিন। আমিই এই তরবারির হক আদায় করবো। কিন্তু সেই সৌভাগ্য অর্জন করেন আর এক দুঃসাহসী সৈনিক- আবু দু'জানা। খন্দকের যুদ্ধেও ছিল যুবাইয়ের অসাধারণ ভূমিকা।

যুদ্ধের সময় মদিনার ইহুদি গোত্র বনু কোরাইজা ভঙ্গ করলো মুসলিমদের সাথে সম্পদিত মৈত্রী চুক্তি। তাদের অবস্থান জানা দরকার রাসূলের (সা)। তাদের সম্পর্ক খোঁজ-খবর নেয়া জরম্নরি। কিন্তু কাজটা ছিল না সহজ কিছু। রাসূল (সা) তাকালেন তার সাহাবীদের দিকে।

জিজ্ঞেস করলেন, কে পারবে তাদের থেকে সংবাদ সংগ্রহ করে আমাকে জানাতে? তিনি তিনবার জিজ্ঞেস করলেন। আর তিনবারই হাত উঁচু করে দাঁড়ালেন যুবাইর। বললেন, হে রাসূল! আমি, আমিই পারবো সেখানে যেতে এবং প্রয়োজনীয় সংবাদ সংগ্রহ করে আপনার কাছে পেঁৗছে দিতে। দয়া করে আমাকে অনুমতি দিন হে রাহমাতুলিস্নল আলামিন! যুবাইরের কথায় ভীষণ খুশি হলেন রাসূল। তিনি বললেন, 'প্রত্যেক নবীরই থাকে হাওয়ারি।

আমার হাওয়ারি হলো_ যুবাইর। হযরত যুবাইর! তিনি ছিলেন রাসূলের (সা) হাওয়ারি এবং নিত্য সহচর। সাহস, সততা, আমানতদারী, দয়া, কোমলতা,_ এ সবই ছিল তার আচ্ছাদিত পোশাকের মত অনিবার্য ভূষণ। আলস্নাহ, রাসূল (সা) এবং ইসলামের প্রতি ছিল তার দৃষ্টানত্দমূলক ভালোবাসা এবং আত্মত্যাগ। সোনার মানুষ ছিলেন তিনি।

যে দশজন সাহাবীর বেহেশতের আগাম সুসংবাদ দিয়েছিলেন দয়ার নবীজী, যুবাইর ছিলেন তাদেরই একজন, অন্যতম। হযরত যুবাইর! কী অসাধারণ তার চরিত্র এবং ব্যক্তিত্ব! এখনও যেন হাওয়ায় দুলছে তার সেই দুঃসাহসী মসত্দকের হলুদ পাগড়ির দুর্বিনীত শিষ। আর জেগে আছেন আমাদের মাঝে সাহসের নিত্য সহচর 2য় হযরত যুবাইর! তাকে ভোলা যায় কখনো?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।