ভালোবাসার ঊর্বশী বুকে লেখা আছে এক নাম- সে আমার দেশ, আলগ্ন সুন্দর ভূমি- বিমূর্ত অঙ্গনে প্রতিদিন প্রতিরাত জেগে ওঠে তার উদ্ভাসিত মুখ
-পাক তুইলা দিছি। থাক্, খাইয়া নিয়া যাবি।
বড়ো বোন সোহেলীর কথায় বেকায়দায় পড়ে সিরাজ। রান্না হ'তে এখনও অনেক দেরি। সময়টা কাটবে কীভাবে।
বাড়িতে সমবয়সী কেউ নেই। ইচ্ছে থাকা সত্বেও সিরাজ পারতপ েএখানে আসে না। কিন্তু মা খুব ক'রে ধরেছিলো। বছরকার পিঠা ছোটো মেয়েকে না দিয়ে কীভাবে খাবে!
খানিকণ ভেবে উদ্দেশ্যহীনভাবেই সিরাজ বেরিয়ে পড়ে। গ্রামের পাশেই বড়ো রাস্তা।
বরাবর পেঁৗছে গেছে জিলা শহরের দিকে। মূল রাস্তায় উঠার আগে নজরে পড়ে এ গ্রামেরই হাজেরা বুজির বাড়ির দিকে। একবার ভাবে, ও বাড়ি থেকে ঘুরে আসলে কেমন হয়! আবার কি ভেবে যেন মত ঘুরিয়ে ফেলে।
রাস্তায় উঠে সোজা ব্রীজের দিকে হাঁটতে থাকে এক মনে। মাঝে মাঝে রাস্তায় চলা বাস, ট্রাকের জন্য পিচঢালা পথ থেকে পাশের ধূলাময় পথে নামতে হয় তাকে।
একরাশ ধূলা উড়িয়ে বাস-ট্রাক চলতে থাকে। তখন খুব অস্বস্তি লাগে তার।
ব্রীজের পাশে কয়েকটি দোকান। লোকাল বাসগুলো এখানেই থামে। একটু থেমে প্যান্টের পকেট থেকে কিছু পয়সা বের ক'রে আনে সিরাজ।
একটা সিগারেট নেয় দোকান থেকে। তারপর দোকানের কূপির আগুন থেকে এক টুকরা কাগজে সিগারেট ধরায় সে। আবার চলতে শুরু করে সামনের দিকে।
ব্রীজের নিচের শুকনা নদীটাকে কেন যেন বিষন্ন মনে হয় তার। দাঁড়িয়ে পড়ে সে ব্রীজের উপর।
আপন মনে টানতে তাকে সিগারেট। ব্রীজের উপর দিয়ে গাড়ি চলার সাথে নিচের পানিতে মাছের বলকানি খুব ভালো রাগে তার। টানতে টানতে আগুনের তাপ হাতে এসে লাগে হঠাৎ। হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে সে পানির উপর। সিগারেটের জ্বলন্ত আগুন শব্দ ক'রে পানিতে নিভে যাবার দৃশ্য তার খুব ভালো লাগে।
এবার তার চোখ পড়ে পাশের গ্রামের দিকে। বিরানপুর, একটি ছোট্ট গ্রাম, পাশে নদী। গ্রামে একটি গার্লস হাই স্কুল ও একটি প্রাইমারি স্কুল আছে। অর্থ-বিত্তের চেয়ে এ গ্রামের লোকদের শিার প্রতি দুর্বলতা আছে বলতেই হয়। তা না হ'লে এ ছোট্ট গ্রামে দু'টি স্কুল সত্যিই বিস্ময়কর।
সিরাজ আবার হাঁটতে থাকে। হঁ্যা, এ গ্রামের দিকেই। কোনো দিকে ভ্রুপে নেই তার। মাঝে মাঝে শুধু পিচঢালা পথ থেকে নেমে যাচ্ছে গাড়িকে রাস্তা দেবার জন্যে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো সে, বেলা বারোটা।
লুৎফার তো এ সময় স্কুলেই থাকবার কথা। তবু সে হাঁটতে থাকে। এক সময় বড়ো রাস্তা ছেড়ে ইরির েেতর আল ধ'রে হাঁটে সে। কোনো েেত কাদায় মই চাষ, কোনো েেত ইরি লাগানো হচ্ছে। কৃষকদের কেউ কেউ তার চোখের দিকে চোখ রেখে আবার তা ত্বরিত সরিয়ে নিচ্ছে।
লুৎফা এ গ্রামেরই মেয়ে। প্রথম দেখা হাসপাতালে। রোগে কাতর বোনের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাস্যোচ্ছল মেয়েটি। এতোদিনে নিশ্চয়ই অনেকটা বদলে গেছে। সিরাজ আরও একবার এসেছিলো এ বাড়িতে।
লুৎফা তখন বাড়িতে ছিলো না। ছিলো বোনের বাড়িতে, অসুস্থ বোনের পাশে।
হাসপাতালে থাকাকালীন লুৎফা অনেক ধৈর্য্যেরও পরিচয দিয়েছে। কিশোরী চঞ্চলতাও তাকে যে ছুঁয়ে যেতো তা সিরাজ ও তার বন্ধুদের কারুরই চোখ এড়িয়ে যায়নি। মাঝে মাঝে ডাক্তারদের সমপর্কে ইচ্ছেমতো মন্তব্য করতো সে।
এতে সিরাজ অবশ্য বেকায়দায় পড়েনি। কারণ লুৎফার বোন সিরাজের প েছিলো।
সিরাজ মাঝে মধ্যেই রুমমেটদের কাছে কথার খোঁচা খেতো। কারণ, লুৎফাকে হাসপাতাল থেকে তাদের আত্মীয়দের বাসায় পেঁৗছানোর দায়িত্বটাও সিরাজের উপরেই পড়তো। সিরাজ অবশ্য সিরিয়াসলি ব্যাপারটা নিতো না।
বরং অনেকেেত্র হাসি ঠাট্টায় উড়িয়ে দিতো সব। কিন্তু এ একরাশ কথার ঢেউ তাকে কিছুটা আন্দোলিত করতো বৈকি।
ভাবতে ভাবতে বাড়ির পাশের খালের কাছে এসে দাঁড়ায় সিরাজ। একটুও পানি নেই খালে। শুকনো কাদাতে এখনও মাছ ধরার চিহ্ন র'য়ে গেছে।
খালের ওপারে এসেই সে বুঝতে পারে এ বাড়িটা অনেকটা বদলে গেছে। বাড়ি পোড়ার চিহ্ন আর নেই। দু'-দু'টো টিনের ঘর উঠেছে। বাড়িটাকে তার কাছে খুব ব্যস্ত-সমস্ত মনে হলো। পাশের ঘরে শোরগোল।
মনে হলো কারা যেন তাস খেলছে। সিরাজ সোজা ঢুকে গেলো বাড়িতে। তাকে দেখেই লুৎফার মা বললো- এতো দেরি কইরা আইলা যে! সিরাজের উত্তরের আগেই অন্য ঘর থেকে লুৎফার বোন তাকে ডাকলো। আলাপের এক পর্যায়ে সে বললো- কয়দিন ধইরাই আছি। লুৎফার বিয়া অইলো।
তাই এহনও যাই নাই। আসছো যহন ভালোই অইছে। থাকো, খাওয়া-দাওয়া কইরা যাইবা।
এতো তাড়াতাড়ি লুৎফার বিয়ে হবে সিরাজ ভাবতে পারেনি। হতবাক হলেও স্বাভাবিক আলাপ চালালো সে।
খানিক পরে লুৎফা দরজায় এসে বললো- কেমন আছেন?
ভালো- তুমি?- সিরাজের ধারণায় ছিলো না লুৎফা এখনও এ বাড়িতেই আছে। বিয়ের পর তুলে নিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
লুৎফা বললো- আসেন যাই ও ঘরে, পরিচয় করাইয়া দেই।
এক রকম অজান্তেই সিরাজ লুৎফার পিচু পিছু গেলো। সবকিছুই যেন রহস্যাবৃতের মতো মনে হলো তার কাছে।
দু'জনের সাথে আলাপ হলো অনেকণ। দুলা মিয়া তাকে এতো স্বাভাবিকভাবে নেবে সে ভাবতেও পারেনি। বরং সিরাজকে আগে কোথাও দেখেছে, এ রকম একটা গল্পও বললো সে। আলাপের ফাঁকে ফাঁকে এক সময় মিষ্টি এনে দিলো লুৎফা। সিরাজ দেখে, লুৎফার গা থেকে এখনও মেহেদীর দাগ মোছেনি।
ফর্সা শরীরের ভাঁজে ভাঁজে হলুদাভ রং আরও সুন্দর করেছে তাকে।
এবার বিদায়ের পালা। বারবার ব'লেও খাওয়াতে পারেনি সিরাজকে। বোনের কথা ব'লে এড়িয়ে গেছে সেটা। পিছু পিছু লুৎফা ও তার বোন তাকে এগিয়ে দিতে আসে।
এতোণে লুৎফার চোখে-মুখে কিছু একটা পরিবর্তন দেখতে পায় সিরাজ।
সিরাজ বললো- লেখাপড়া চালিয়ে যেও। যুগটাতো জানোই।
লুৎফা বেশ অভিমান ভরেই যেন বললো- লেখাপড়া কইরা কী অইবো? থাকতে তো অইবো চুলার পারে। কইছিলাম আগে লেখাপড়া করমু, তাতো আগেই শেষ কইরা দিলো।
উত্তরে সিরাজ কিছুই বললো না। কথাটা যেন সিরাজকে শুধুই কষ্টের শরে বিদ্ধ করলো।
লুৎফা ও তার বোন খালের পারে এসে দাঁড়ায়। কথার ফাঁকে যে কয়বার সিরাজ লুৎফার দিকে তাকিয়েছিলো ততোবারই সে ত্বরিত চোখ সরিয়ে নিয়েছে। কী ভাবছিলো লুৎফা তখন? ওটা কী ছিলো তার ভালোবাসার দৃষ্টি না কামনার আগুন! সিরাজ জানে তার দৃষ্টির আগুন মানুষকে পোড়াতে পারে।
আর সেটা সে বোঝে অনেক আগে থেকেই।
সিরাজ খালের এপারে এসে নিজের অবস্থান খেয়াল ক'রে আরও একবার তাকালো ওপারে। একবার মনে হ'লো কিছু একটা বলে আসতে। কিন্তু পরণেই ইচ্ছাটাকে দমালো সে। শুকনো খালের উষ্ণতা তাকে ডেকে নিয়ে গেলো বিশাল জলাধারের নিমগ্নতায়।
মনে হলো, নদী থেকে উঠে আসা এ খালেও নদীর গতি পরিবর্তন হ'তে পারে। হ'তে পারে এটাও একটা নদী- যে নদীর এপার থেকে ওপারে দাঁড়ানো লুৎফার মুখ এতোটা সপষ্ট দেখা যাবে না কোনোদিন। তখন লুৎফা হয়তো হবে অন্য জগতের মানুষ। এ কল্পিত নদীর ভালোলাগার আকণ্ঠ জল ভালোবাসায় রূপান্তরিত হবার আগেই সে হাঁটতে থাকে সামনে এক মনে, এক ধ্যানে।
06.03.1986
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।