আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাথমিক শিক্ষকের চাকুরির পদমর্যাদা ও শিক্ষার মাঠ-প্রশাসন : কয়েকটি নৈতিক অসামঞ্জস্য

প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকুরীর পদমর্যাদা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার এমন খবর নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের চাকুরী দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত হচ্ছে, বাড়ছে শিক্ষকদের বেতনও। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন স্কেলও স্বতন্ত্র হচ্ছে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এসবই আশার কথা, আনন্দের কথা। আমাদের জাতীয় জীবনে আনন্দের সংবাদ আসে খুবই কম, যা আসে তা-ও পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পেতে লড়াই করতে করতে আসে।

প্রায় চার লক্ষ প্রাথমিক শিক্ষক সারাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড বলা যায়। সেদিক থেকে বিচার করলে এটি দেশময় এক আনন্দবার্তা। কিন্তু এর সাথে খানিকটা আশাহত হবার মত কারণও আছে। জানা যাচ্ছে, একই সাথে উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার (এটিইও) পদমর্যাদা বাড়িয়ে প্রধান শিক্ষকের ওপর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে (আগেও তা-ই ছিল) । এই একটি সিদ্ধান্ত থেকেই বোঝা যায় সরকারের বিবেচনায় শিক্ষকদের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

অবশ্য সরকারের এসব সিদ্ধান্ত-যে আমলাতন্ত্রের মস্তিষ্কপ্রসূত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশাসনিক পদকে সকল সময় সকল বিবেচনায় কর্তৃত্বের ছড়ি ঘুরাতে হবে- এমন বিবেচনা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বহুকাল ধরেই টেনে রেখেছে পেছন দিকে। কোনো রাজনৈতিক সরকারই এই রাহু থেকে মুক্ত নয়, হতে পারে নি, কবে হতে পারবে তাও আমাদের অজানা। সে ভিন্ন কথা।
সরকারের প্রাথমিক শিক্ষায় বিগত ১০ বছরে লক্ষণীয় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চমান বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, অন্তত বাংলাদেশের বাস্তবতায় যতটা সুচারুভাবে সম্ভব। এ পেশায় যোগ্যতাসম্পন্ন, মেধাবী ও কর্মঠ তরুণ-তরুণীদের আগ্রহও তৈরি হয়েছে ব্যাপক। তাই এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রার্থিত শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক প্রায়শই পাওয়া যায়। এটি একদিকে যেমন আশাব্যঞ্জক অন্যদিকে সতর্কতাসংকেতও। যোগ্যতার মূল্যায়ণ না হলে তা হতাশার সৃষ্টি করে এবং তা সংক্রমিত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

সহকারী থানা শিক্ষা কর্মকর্তা পদটি নিয়োগ শর্ত অনুযায়ী স্নাতক সনদধারী প্রার্থীদের। কেবল এই একটি কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের পদটিকে তার চেয়ে একধাপ নিচে রাখা কতটা যৌক্তিক? শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রধান বিবেচ্য হলে যেসব প্রাথমিক শিক্ষক স্নাতকোত্তর পাশ তাদের বেতন স্কেল এটিইওর উপর নির্ধারণ করা কী অযৌক্তিক হবে? বস্তুত ভারতের মত বাংলাদেশেও প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতনস্কেল শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে হতে পারে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে একটি দপ্তরের প্রধান করেও এটিইওর হাতের পুতুল বানিয়ে রাখার কারণ কী হতে পারে? ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভূত যে কতটা নাছোড়বান্দা এ থেকেই বোঝা যায়। সেকালে পরিদর্শকের কুকুরের এক পা-এর জন্য যে খরচ রাষ্ট্র সেই শিক্ষককে সারা মাসে তা-ও দিত না। আর্থিক অবস্থার এখন হয়তো লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির উন্নতি কি হয়েছে কোথাও ? প্রাথমিক শিক্ষার মাঠ পর্যায়ে এটিইওদের দৌরাত্ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতি প্রকাশ্য বিষয়।

যার অধিকাংশ আসে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শোষণ করে। এটিইও পদে চাকুরীর জন্য পুলিশের মত লক্ষ-লক্ষ টাকার লেনদেন বহু আগ থেকেই চলছে। ব্যাপক দুর্নীতির সুযোগ যেখানে আছে সেখানে নিয়োগবাণিজ্যে টাকার অঙ্কটাও অনেক। এসব কথা সরকারের অজানা তাও নয়। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার এই জাগরণের কালে সেই এটিইও পদটিকে আবারও প্রধান শিক্ষকের ওপর স্থান দেয়া শিক্ষাব্যবস্থার জন্য মঙ্গলজনক নয়।

যে শিক্ষার্থী শ্রেণিশিক্ষক বা প্রধান শিক্ষককে জীবনের আদর্শ ধরে নিয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করে তার সেই লক্ষ্য দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফিকে হতে থাকে শ্রদ্ধার্হ শিক্ষাগুরুর ওপর মটরসাইকেল থেকে নেমে আসা এটিইওর খবরদারি দেখে। তাই আজও, সেই ব্রিটিশ আমলের মত, বিদ্যালয় পরিদর্শক বা শিক্ষা কর্মকর্তার আগমন সংবাদে বিচলিত হন শিক্ষক। অন্য কোনো কারণে নয়, ছাত্রদের সামনে অপমান-অপদস্ত হওয়ার ভয়ে; বেতন বন্ধ বা জরিমানার শাস্তির আশঙ্কায়। সেইকাল থেকেই বিদ্যালয় পরিদর্শনে প্রশাসনের উদ্দেশ্য, ছাত্রদের মাঝে একটা হিরোইজম তৈরি করে শিক্ষককে ক্ষুদ্রজ্ঞান করা। আমরাও তাই দেখেছি।

এ অবস্থার এখনো খুব একটা উন্নতি হয়েছে বলে শুনিনি।
সরকারের প্রাথমিক শিক্ষকদেরকে তার শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের দায়িত্ব ছাড়াও অনেকরকম দায়িত্ব পালন করতে হয়। বস্তুত অন্যান্য দায়িত্ব এতটাই বেশি যে, শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর মূল কাজটা বলতে গেলে গৌণই থেকে যায়। তারপরও যদি তাকে বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে ছুটি-ছাটা বা চাকুরীর নানা প্রয়োজনে, আবেদন-নিবেদনে এটিইওর কলম বা দয়ার মুখাপেক্ষী হতে হয় তবে তো তার যন্ত্রণার আগুনে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে সেই আগুন কেউ দেখবে না, যখন দেখবে তখন সব শেষ।

বর্তমান বাস্তবতাও তাই বলে। তাই যে বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া উচিত তা হলো- (১) এটিইওর মত প্রধান শিক্ষকের পদকেও প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করা। (২) এটিইওর দায়িত্ব যাতে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বকে চ্যালেঞ্জ না করে তেমন সুরক্ষা-ব্যবস্থা রাখা। অর্থাৎ উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য সুনির্ধারিত ও সুসমন্বিত রাখা। (৩) প্রাথমিক শিক্ষকের চাকুরীর এসিআর থেকে শুরু করে কোনকিছুই এটিইওর কর্তৃত্বে বা তত্ত্বাবধানে না রাখা।

(৪) শিক্ষক ও এটিইওর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরির ব্যবস্থা করা।
বহু কষ্টে, কিছু ত্যাগী ও উদ্যমী লোকের শ্রমে-ঘামে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় যে সোনালি আভা দেখা যাচ্ছে তা যদি আবার অন্ধকার গুহায় চলে যায় তাহলে সবচেয়ে লাভবান হবে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা এতিমখানা-মাদ্রাসা ব্যবসায়। এটি যে কোনোভাবেই জাতি ও রাষ্ট্রের আদর্শের অনুগত, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নাগরিক, মুক্তচিন্তার মানুষ তৈরি করে না তা আমরা হাড়ে হাড়ে অনুধাবন করছি। প্রাথমিক শিক্ষক একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে নিবিড় ও প্রত্যন্ত কর্মী। তাকে যথাযথ ও সঠিকভাবে কাজে লাগালে সমাজবিপ্লব ঘটানো কঠিন নয়।

টলস্টয়ের এ চিন্তা অমূলক নয়, দুনিয়ার অনেক দেশই তা করে দেখিয়েছে। আমরাও তা পারবো।

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.