ডিসিসি, রাজউক, ওয়াসা ও পরিবেশ অধিদফতরের সমন্বয়হীনতায় দখল আর দূষণে হারিয়ে যেতে বসেছে গুলশানের নয়নাভিরাম লেক।
আর এর জন্য দায়িত্বে থাকা এসব বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চরম উদাসীনতাই দায়ী বলে জানিয়েছে লেকের আশপাশে বসবাসকারীরা। গুলশান নিকেতনের নয়নাভিরাম এই লেক এলাকা এখন অপরাধীদের আখড়াস্থলে পরিণত হয়েছে। লেকপাড়ে দিনের বেলায়ও কেউ চলাফেরা করার সাহস পায় না। লেকের পাশ দিয়ে যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীন পরিবেশে ছিনতাই-রাহাজানির শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
এ ছাড়া আছে মাদকাসক্তদের বখাটেপনা আর ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীদের অবাধ চলাচল। ময়লা, আবর্জনা, নর্দমা ও স্যুয়ারেজের বর্জ্য মিশে লেকের পানিকেও বিষাক্ত করে তুলেছে। এতে পানির রংও পাল্টে গেছে। পানির সাধারণ রং এখন কালো রং ধারণ করেছে। লেকের ময়লার তীব্র দুর্গন্ধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এলাকার জনজীবন।
পরিবেশ অধিদফতর ইতোমধ্যে লেকটিকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' বলে ঘোষণা দিয়েছে। তবে বিপন্নতা রোধে নেওয়া হচ্ছে না কার্যকর পদক্ষেপ, ঠেকানো যাচ্ছে না জবরদখল। গুলশান-নিকেতন-বারিধারা লেক রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকলেও তা অমান্য করে প্রভাবশালী দখলবাজরা চালিয়ে যাচ্ছে মাটি ভরাট ও দখল। লেকের পাড়, ওয়াকওয়ে ও পানির মধ্যেই অবৈধভাবে নির্মিত হয়েছে ৭ থেকে ১৫ তলা পর্যন্ত উঁচু ভবন। লেকের জায়গাজুড়ে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় বস্তি আর হাটবাজার।
লেকটির পূর্বপাশ দিয়ে একটি সড়ক নির্মাণ করার কথা থাকলেও কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। হাতিরঝিল প্রকল্পের সঙ্গে এই সড়কটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লেকের পাড় দিয়ে সড়ক নির্মাণের জন্য যে জায়গাটুকু দরকার তা দখল করে রেখেছে কতিপয় দখলকারী। অপরদিকে হাতিরঝিল প্রকল্পের সঙ্গে সংযোগ হিসেবে একটি ব্রিজ নির্মাণ কার্যক্রম চলছে। কিন্তু তা সময়মতো শেষ না হওয়ায় সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে হাতিরঝিল থেকে গুলশান এলাকায় সহজ যাতায়াত।
রাজধানীর লেকগুলোর অন্যতম নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আর পয়োনিষ্কাশনের দেখভাল করে থাকে ঢাকা ওয়াসা। অন্যদিকে লেক ও সংলগ্ন এলাকার পরিবেশ বিপর্যয় রোধে রয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। লেক এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, এ চারটি সংস্থার কেউই তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না।
এমনকি তাদের মধ্যে সমন্বয় পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের খান জানান, রাজধানীর হৃৎপিণ্ড হিসেবে বিবেচিত লেকগুলো যে কোনো মূল্যে উদ্ধার ও দূষণমুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে গুলশান-নিকেতন লেক সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দখলে-দূষণে এখন নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে গুলশান-নিকেতনের মনোমুঙ্কর লেক। পাশর্্ববর্তী ভবন, বাড়িঘর, অফিসের স্যুয়ারেজ সংযোগ সরাসরি লেকে স্থাপন করা হয়েছে। স্থানীয় কাঁচাবাজারগুলোর ময়লা-আবর্জনাও ফেলা হচ্ছে লেকে।
পাহারা বসিয়েও এসব রোধ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিন এ লেকে ১০-১৫ টন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। তাই প্রতিনিয়ত বাড়ছে দূষণমাত্রা। লেকের পানি পচে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানি বিষাক্ত হয়ে পড়ায় মাছ মরে ভেসে উঠছে প্রায়ই।
লেক ভরাট করে অবৈধ প্লট সৃষ্টি করে নির্মাণ হচ্ছে একাধিক বহুতল ভবন। শাহজাদপুরে লেকের অংশ ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে কয়েকশ টিনশেড। ভরাট জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে একাধিক বস্তি। গুলশান ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর সড়কের পাশে মাটি ফেলে ভরাট হচ্ছে লেক। দখলকারী চক্র কয়েক বছরে গুলশান ও বারিধারা লেকের মহামূল্যবান ৪০ থেকে ৫০ একর জমি দখল করে নিয়েছে।
গুলশান সোসাইটির নেতারা অভিযোগ করে জানান, সবচেয়ে বেশি জবরদখল হয়েছে ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৮, ৫৫, ১০৫, ১১৮, ও ১৩৬ নম্বর সড়ক-সংলগ্ন জায়গা। গুলশান ১০৬ নম্বর সড়কের উত্তরে শাহজাদপুরে লেকের একাংশজুড়ে ১৮টি প্লট তৈরি করা হয়েছে। শাহাজাদপুরের মরিয়ম টাওয়ার থেকে দক্ষিণ দিকে শুটিং ক্লাব ও কূটনৈতিক জোন হয়ে বনানী পর্যন্ত বিস্তৃত গুলশান-বারিধারা লেক আবার অরক্ষিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় পুরনো কনক্রিট ও ময়লা ফেলে ভরাট করা হচ্ছে লেকের জায়গা। দুই শতাধিক একর জায়গাজুড়ে বিদ্যমান গুলশান-বারিধারায় অবস্থিত এ লেকে প্রতিদিন ফেলা হচ্ছে হরেক আবর্জনা।
বারিধারার কূটনৈতিক জোনের পশ্চিম পাশের গেট দিয়ে ঢুকে ২০-২২ গজ এগোতেই চোখে পড়ে লেকপাড়ের সীমানা-বেড়ার কাঁটাতার ও গ্রিলের ঘের চুরি হওয়ার দৃশ্য। ভ্রমণপিয়াসীদের বিশ্রামে নির্মিত সিমেন্টের বেঞ্চগুলো পর্যন্ত ভেঙে ভেতরের রডগুলো কে বা কারা নিয়ে গেছে। নিয়মিত বসছে বখাটেদের আড্ডা ও তাস খেলার আসর। মাদক বেচাকেনা ও সেবন অবাধ হওয়ায় বিকাল পেরোতেই আড্ডা জমছে জম্পেশ। ঘুরতে এসে তরুণীরা শিকার হেচ্ছ ইভ টিজিংয়ের।
নির্জনতার সুযোগে চলছে ছিনতাই-রাহাজানি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম গুলশান লেক দখল ও এর পূর্বপাশ দিয়ে সড়ক নির্মাণের বিষয়টি এড়িয়ে যান। হাতিরঝিল প্রকল্পের প্রকল্প কর্মকর্তা মেজর মো. খিজিল খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, হাতিরঝিল প্রকল্পের সঙ্গে গুলশানে যাওয়ার জন্য একটি সংযোগ সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। তবে অতিবৃষ্টি আর গ্যাসলাইনের জন্য কাজের গতি কম। তবে আগামী বছরের মার্চ মাসের দিকে সেতুর কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।