১. ২০০১ এর নির্বাচনের আগে কওমি মাদরাসাভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো জোট করে বিএনপির সাথে। জোটের উদ্দেশ্য ছিল তাদের নির্দিষ্ট কিছু দাবিদাওয়া। যেমন কওমি মাদরাসার সার্টিফিকেটের সরকারি স্বীকৃতি, স্বতন্ত্র আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করা ইত্যাদি। কিন্তু পুরো পাঁচবছর বিএনপি-জামাত লুটপাটে এতই ব্যস্ত ছিল যে এসব দাবিদাওয়া নিয়ে ভাবার সময় ছিল না তাদের। দুয়েকটা সাংসদের পদ দিয়ে কওমিওয়ালাদেরও অনেকটা চুপ করিয়ে রেখেছিল তারা।
পরে সময় যখন প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল তখন খেলাফত মজলিসের আমির শায়খুল হাদিস আল্লাম আজিজুল হক দাবিদাওয়া নিয়ে খালেদাকে অনেকটাই চেপে ধরেন। ফলে খালেদা তড়িঘড়ি করে কওমি সনদের স্বীকৃতির মৌখিক ঘোষণা (স্বীকৃতি বাস্তবায়ন করেনি) দিলেও বাকি দাবিগুলো মানেননি। কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণার ক্ষেত্রে অজুহাত ছিল 'বাইরের চাপ'। আর আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বিএনপির নির্বাচনী ইশতেহারে থাকলেও ওটা নিয়ে ভাবারই সময় পায়নি তারা। এসব ঘটনা কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠনগুলোর মনে ক্ষোভের জন্ম দেয়।
ফলে খেলাফত মজলিস নিয়ে আল্লামা আজিজুল হক চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যান। পরে আওয়ামি লিগের সাথে নির্বাচনী চুক্তি করলেও ওয়ান-ইলেভেনের পর সেই চুক্তিও ভেস্তে যায়।
২. সম্প্রতি সংসদে স্বতন্ত্র ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস হয়েছে। 'নাস্তিক' আওয়ামি লিগ সরকারই বিএনপির প্রতিশ্রুতি দেয়া আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নপূরণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এই আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলে মাদরাসা শিক্ষার একটা নিজেস্ব ঠিকানা হলো।
এর আগেও আমরা দেখেছি আওয়ামি লিগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কওমি সনদের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উদ্যোগী হয়ে আহমদ শফিসহ কওমি মাদরাসার সকল বড় নেতাকে ডেকে নিয়েছিলেন। কওমি মাদরাসা যেহেতু কয়েকটা বোর্ডে বিভক্ত, তাই উনি বলেছিলেন 'আপনারা যেকোনো একটা বোর্ডের অধীনে একটা রূপরেখা নিয়ে আসুন। আপনাদের রূপরেখা অনুযায়ীই স্বীকৃতি দেয়া হবে'। কিন্তু বিভেদ আর অন্তর্কোন্দলে জর্জরিত কওমি বোর্ডগুলো এখন পর্যন্ত নিজেদের একই প্ল্যাটফর্মেই নিয়ে আসতে পারেনি। এরই মধ্যে উত্থান হলো হেফাজতের।
আবার কওমিওয়ালারা ঘেঁষল খালেদার আঁচলের নিচে। আওয়ামি লিগ ট্যাগ পেল 'নাস্তিক' সরকার। যে খালেদা ও তার দল একবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কওমিওয়ালাদের একটা দাবিও মানতে পারল না সেই কওমিওয়ালারা আবারও স্বেচ্ছায় বাঁশ খেতে বিএনপি-জামাতের সাথে অলিখিত চুক্তি করল।
৩. বিএনপির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তারা কখনোই ইসলামের জন্য কিছুই করেনি। এমনকি বিএনপির সাথে তথাকথিত ইসলামি দল জামাত থাকার পরও তাদের কাছ থেকে এদেশের ইসলাম কিছুই পায়নি।
শুধু গালভরা প্রতিশ্রুতি শুনেছে আর শুনেছে 'আমরা ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী' বলে নাস্তিক ভাষণলেখক শফিক রেহমানের লেখা, হারাম ভ্রু প্লাক করা, পরপুরুষ নিয়ে ওমরায় যাওয়া 'আস্তিক' ম্যাডামের ছেলেভোলানো কিছু কথাবার্তা। অবশ্য আমাদের আলেম-ওলামারা কাজে নয়, কথাতেই বিশ্বাসী। যে কারণে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে, ওআইসির সদস্যপদ লাভ করিয়ে, বিশ্ব ইজতেমার জমি বরাদ্দ করে, বায়তুল মোকাররম ও কাকরাইল মসজিদকে আধুনিকায়ন করে, পবিত্র কুরান নিয়ে বাংলাদেশের প্রথম ওয়েবসাইট তৈরি করে এবং সর্বশেষ আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিল পাস করেও আওয়ামি লিগ 'নাস্তিক'। আর শুধু মদ আর জুয়ার লাইসেন্স দিয়ে যাওয়ার কারণে জিয়াউর রহমানের বিএনপি 'আস্তিক' দল!
৪. অদ্ভুত একটা দেশে বাস করছি আমরা। আরো অদ্ভুত আমাদের দেশের ধর্মীয় নেতারা।
যারা ধর্ম নিয়ে উসকানি দেয়, ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করে, ধর্ষণ, লুটপাট করে, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করে, জঙ্গিবাদের চর্চা করে তাদের নিয়ে আমাদের ধর্মীয় নেতারা সবসময়ই চুপ থাকেন। ধর্মের নামে সরলপ্রাণ মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে যারা মাজারব্যবসা করেন, ইসলামে অবৈধ কবরপুজার রমরমা ব্যবসা দেখেও উনারা চুপ। মাদক, অশ্লীলতা, নগ্নতা এবং আরো অনেক নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয় নিয়েও উনাদের কখনো কথা বলতে দেখিনি। কিন্তু যেই দেশের লাখ লাখ তরুণ ভয়ঙ্কর কিছু অপরাধীর ফাঁসির দাবিতে একত্রিত হলো, তখনই উনাদের টনক নড়ে উঠল। ইসলামের লেবাসধারী কিছু খুনি, লুটেরা আর ধর্ষককে বাঁচানোর জন্য তথাকথিত 'নাস্তিকদের' বিচার দাবিতে নাস্তিক ফরহাদ মজহারকে মঞ্চে বসিয়ে তারা সমাবেশ করল।
নাস্তিক মাও সে তুঙয়ের সৃষ্ট পদ্ধতিতে লংমার্চ করল। আর এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী তরুণদের বিরুদ্ধে ইচ্ছেমত মিথ্যাচার করে নানা অপবাদ দিল!
৫. ভদ্রলোকের সাথে ভদ্রভাবে আর বাস্টার্ডের সাথে খেলতে হয় বলে বঙ্গবন্ধু একটা বাণী দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আজকের আওয়ামি লিগ বাস্টার্ডদের সাথে খেলতে গিয়ে অতিরিক্ত ভদ্রতা দেখাচ্ছে। ধর্ম নিয়ে জামাত-হেফাজত-বিএনপির সাথে খেলতে গিয়ে আওয়ামি লিগ পেরে উঠছে না। এর কারণ হলো আওয়ামি লিগের গঠনতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ।
তাদের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি এদেশের কিছু ধর্মোম্মাদ রাজনৈতিক দলের সাথে টক্কর দেয়ার জন্য যথেষ্ঠ নয়। বঙ্গবুন্ধু যতই বলে যান না কেন যে 'ধর্মনিরপেক্ষতা মানে মুসলমান মুসলামানের ধর্ম, হিন্দু হিন্দুর ধর্ম, খৃষ্টান খৃষ্টধর্ম আর বৌদ্ধ বুদ্ধধর্ম পালন করবে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়', দিনশেষে প্রতিপক্ষরা অপপ্রচার চালাবে যে ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা, নাস্তিকতা! তাই আমার কথা হলো এসব আরবি বিশ্ববিদ্যালয়-টিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস না করে দলীয় গঠনতন্ত্রে শুধু একটা কথা লাগিয়ে দিন যে 'ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, আমরা ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী'। সাথে দু-চারটা ইসলামি দলকে জোটে নিয়ে আসুন। পারলে সংবিধান আরবিতে (আরবিতে সংবিধান হলে মদ, জুয়া, সমকামিতার লাইসেন্স দিলেও সেই সংবিধানের বিপক্ষে কেউ টু শব্দটিও করবে না) লিখে ফেলুন।
হেফাজতের ১৩দফার সাথে শুধু মৌখিক সমর্থন দিন। তারপর ইচ্ছেমত বিএনপি-জামাতের মত ইসলামকে বাঁশ দিন। যদি এসব না পারেন, তাহলে অফ যান। কারণ যতই ইসলামের পক্ষে কাজ করেন না কেন আপনাদের গায়ে ধর্মহীনতার যে লেভেল লেগেছে তা কখনো মুছবে বলে মনে হয় না!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।