মহামতি আকবর তার কিশোর যুবরাজ সেলিমকে বলছিলেন তাদের পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খান ওরফে তিমুজিনের সংগ্রামী জীবনকাহিনী। যাতে পুত্রকে বোঝাতে পারেন রাজপুরুষদের রক্তের ঐতিহ্য, সংগ্রামী জীবন ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে। যুবরাজ সেলিমও তন্ময় হয়ে শুনছিলেন তার পূর্ব-পুরুষ চেঙ্গিস খানের জীবনের বিষাদময় ঘটনা। স্ত্রী বোরতি অপহৃত হওয়ার পর অন্য সাধারণ মানুষের মতো হাউমাউ করে কাঁদলেন না চেঙ্গিস। কিংবা কয়েক দিন দুঃখ প্রকাশ করার পর নতুন স্ত্রীও সংগ্রহ করলেন না।
বরং মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিকল্পনা করতে থাকলেন অপহরণকারী মারফিতের কাছ থেকে স্ত্রীকে উদ্ধার করার জন্য। কিশোর চেঙ্গিস অচিরেই তার বন্ধু জামুখার গোত্রের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করলেন। একইভাবে তার রক্ষাকর্তা হিসেবে পরিচিত কেরিয়াতে গোত্রের প্রধান তুখরল খানের শরণাপন্ন হলেন। এই রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ যুদ্ধের মাধ্যমে স্ত্রীকে উদ্ধার করার পাশাপাশি বিশাল এক ভুখণ্ডের মালিক হলেন চেঙ্গিস। স্ত্রীর কাছে শুনলেন অপহরণকালীন সময়ের বীভৎস অত্যাচার আর অন্যায়ের কাহিনী।
অনেক অপমান ও নির্যাতনের মুখেও বোরতি নিজেকে সমর্পণ করেননি_ অপহরণকারীর কাছে। সব ঘটনা জানার পর স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর মমত্ববোধ বেড়ে গেল বহুগুণে এবং আজীবন তিনি সেটা অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। চেঙ্গিস খানের বহু স্ত্রী এবং শত শত রক্ষিতার গর্ভে হাজার হাজার সন্তান-সন্ততি জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু প্রথমা এবং প্রিয়তমা স্ত্রী বোরতির গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানরাই কেবল রাজত্বের উত্তরাধিকারী লাভ করেছিল। তার গর্ভের তিন সন্তান চাগতাই, ওগতাই এবং তুলি এক সময় সারা পৃথিবীর রাজনীতিতে প্রচণ্ড কম্পন ধরিয়েছিলেন_ মহামতি আকবর যখন চেঙ্গিস খানের জীবন কাহিনীর এই অংশ পর্যন্ত এলেন ঠিক তখনই অনতিদূরে দেখতে পেলেন শত শত মশালের আলো জ্বালিয়ে তার সফরসঙ্গী বাহিনীর সদস্যরা তাদের খোঁজে ঘটনাস্থনে পেঁৗছে গেছে।
পুব আকাশ তখন অনেকটা ফর্সা হয়ে গিয়েছিল আর ভোরের মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল।
নিজের খাস কামরায় বলতে গেলে সারারাত নির্ঘুম কাটাতে কাটাতে সম্রাট জাহাঙ্গীর তার কৈশোরের স্মৃতির রোমন্থন করছিলেন। ফজরের আজান শুনে তিনি বিছানা ছেড়ে উঠলেন এবং গত রাতে ঘটে যাওয়া প্রেমময় স্মৃতিগুলো স্মরণ করার চেষ্টা করলেন। তার মনে পড়ল পারস্য সেনাপতি কিসলু ইবনে ইয়াসারের কথা। অন্যদিকে প্রধান বিচারপতির দরবারে ন্যস্ত আনারকলিকে অপমানকারী ইলিয়াস খানের বিচারের কথা।
কিন্তু হঠাৎ করেই তাকে ভীষণভাবে রোমাঞ্চিত করে তুলল, যখন তিনি ভাবলেন পারস্য কবি ইমরুল কায়েসের প্রেমিকা উনাইযাহ সম্পর্কে। মরুভূমির খোলা প্রান্তরে চাঁদনী রাতে ইমরুল কায়েস একাধিক বাঘের চামড়া বিছিয়ে শয্যা রচনা করতেন তারপর রাজকুমারী উনাইযাহকে নিয়ে মধুর রমণে রত হতেন। তিনি নূরজাহানের মুখ থেকে সেই কাহিনী শোনার সময় তাকে মাঝ-মধ্যে সুড়সুড়ি দিয়ে বিরক্ত করার পাশাপাশি চুম্বনে সিক্ত করার নানা কৌশল নিয়ে ভাবতে ভাবতে কামরার বাইরে এসে ভোরের আকাশ, পাখ-পাখালির ডাকাডাকি এবং বাতাসের অপরূপ গন্ধ অনুভব করার চেষ্টা করলেন।
পরবর্তী সাত দিন সম্রাট অত্যন্ত কর্মব্যস্ত সময় কাটালেন। এরই মধ্যে শুনতে পেলেন ইলিয়াস খানের বিচারের অদ্ভুত রায়।
তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। বিচারপতি আদেশ দিয়েছেন আসামির যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার জন্য। একই সঙ্গে হুকুম জারি করেছেন, তাকে আগ্রানগরীতে থাকার জন্য। অন্যদিকে নগরবাসীকে নির্দেশ দিয়েছেন তাকে কোনো রকম সহযোগিতা না করার জন্য। সম্রাট মনে মনে প্রমোদ গুনলেন লোকটিকে মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও কঠিন ও অবমাননাকর শাস্তি প্রদান করা হয়েছে।
কারণ ইলিয়াস খান এখন অর্ধউন্মাদ অবস্থায় আগ্রার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কেউ তাকে খাবার বা আশ্রয় তো দেয়ই না বরং দেখা হলে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। অনেকে থুথু ছিটায়। রাস্তার পাশের ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া মানুষের উচ্ছিষ্ট সে কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে ভাগাভাগি করে খায়। ছোট ছোট দুষ্টু ছেলেরা তাকে দেখলেই ঢিল ছুড়তে থাকে।
এ জন্য সে বেশির ভাগ সময়ই দুর্গন্ধমুক্ত ভাগাড়ের আশপাশে থাকে। ইদানীং কয়েকটি কুকুরও নাকি তাকে দেখতে পারছে না। তারা বুঝে গেছে, ইলিয়াস খান নিয়মিত তাদের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে। কাজেই কখনো কখনো তারা দলবেঁধে তাকে তাড়া করে। শহরবাসী এই দৃশ্য দেখে বড়ই পুলকিত হয়।
কিন্তু সম্রাটের মন কেন জানি ভারি হয়ে ওঠে। একবার মনে হয় ইলিয়াস খানকে মাফ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। অথবা তাকে রাজ্য থেকে বহিষ্কার করলেও সে বেঁচে যায়। কিন্তু আনার কলির অন্তিম দিনগুলোর করুণ আর্তনাদ এবং ইলিয়াস খানের বেইমানির কথা স্মরণ হতেই সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়।
ইতোমধ্যে সম্রাট পারস্য সেনাপতি কিসলু ইবনে ইয়াসারের বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছেন ঠিক সেভাবেই সেভাবে সম্রাজ্ঞী পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি মূলত আগ্রায় এসেছিলেন কান্দাহার প্রদেশের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য। কিন্তু রাজধানীতে প্রবেশের আগেই জানতে পারেন, একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্ষমতাচ্যুত হতে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় পারস্য রাজের প্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ্য তার দলবলসহ রাজধানীতে ঢুকতে ভয় পাচ্ছিলেন। অন্যদিকে দেশে ফিরে যেতেও পারছিলেন না। ফলে
ব্যবসায়ীর বেশে তিনি এবং তার সঙ্গী-সাথীরা শহরে প্রবেশ করেন এবং শহরতলিতে সুন্দর একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে করতে আগ্রার অধিবাসীদের অদ্ভুত জীবন যাত্রায় কৌতূহলী হয়ে ওঠেন।
তিনি বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে দিনে কিংবা রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে শহরের অলি-গলিতে ঘুরতে থাকলেন। একদিকে ভয়ঙ্কর এবং উত্তেজনাকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি রোজই নানা গুজব, সৈন্যদের নিয়মিত টহল, ছুটাছুটি আর অন্যদিকে শহরবাসীর উচ্ছ্বল-প্রাণবন্ত এবং সচ্ছল জীবনযাপন তাকে হতবাক করে তোলে।
সেনাপতি কিসলু যখন আগ্রায় এলেন তখন বসন্তকাল চলছিল। দিনের বেলায় হালকা গরম থাকলেও সন্ধ্যার পর আবহাওয়া এত চমৎকার হয়ে ওঠে যে, তিনি প্রায়ই উদাস হয়ে পড়েন। জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতে তিনি হাঁটতে হাঁটতে যমুনার তীরে চলে যেতেন।
রাজ দরবারের আমির ওমরাগণের বাগান বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে প্রায়ই সংগীতের মায়াময় সুর-লহরী, সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে ভেসে আসত লালনাদের হাসি-তামশার শব্দ। রাতের সেই পরিবেশে তার মন হু হু করে উঠত নারী সঙ্গের জন্য। তিনি ভাড়া করা বাড়িতে ফিরতেন প্রায় গভীর রাতে এবং বলতে গেলে নির্ঘুম রজনী কাটাতেন ও স্মরণ করতেন পারস্যে তার প্রাসাদের সুন্দরী দাসীদের কথা এবং যমুনার তীরের মায়াবী রীতের মোহময় নারী কণ্ঠের সুর-লহরী এবং কলকল হাসির শব্দ। বাগানবাড়ি থেকে ভেসে আসা সেই হাসির ছন্দের সঙ্গে যোগ হতো আকাশের তারার মিটিমিটি আলো, ঝিরঝিরে বাতাস, জ্যোৎস্না আর যমুনায় বয়ে যাওয়া স্রোতের কলকল-ছলছল শব্দ। একেকবার মনে হতো বাগানবাড়ির ভেতর গিয়ে ললনাদের দেখে আসতে।
কিংবা সুযোগ পেলে তাদের আদর-সোহাগ গ্রহণ করে আসতে। কিন্তু প্রবাস জীবনের একাকীত্ব এবং গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের কারণে কিছুই করতে পারছিলেন না।
একদিন বিকাল বেলায় তিনি গেলেন যমুনা তীরে। লক্ষ্য করলেন একটি বাগানবাড়ি থেকে কয়েকটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ে হাঁটতে হাঁটতে যমুনা তীরে চলে এসেছে। এরা সবাই বাগানবাড়ির ক্রীতদাসী।
একটি ঝোপের পাশে লুকিয়ে তিনি মেয়েগুলোর কথাবার্তা শুনতে চেষ্টা করলেন। তারা প্রথমেই খুব দুষ্টু দুষ্টু কথা বলতে লাগল। তাদের মালিক সুবেদার রহিম খান নাকি মোগল দরবারের বেশ প্রভাবশালী সেনাপতি এবং নিজেকে সব সময় মহাবীর বলে প্রচার করেন। একটি মেয়ে এসব বলে আলোচনা শুরু করল। অন্য মেয়েটি বলল, ঘোড়ার ডিমের বীর।
ওর মতো কাপুরুষ এই আগ্রাতে একটিও নেই। দেখনি গত এক সপ্তাহে ও কেবল সুরাহি ভরে মদপান করেছে এবং মাতাল হয়ে কাপড় চোপড় খুলে ফেলেছে। আমাদেরও বিবস্ত্র হতে বাধ্য করেছে। অনেকক্ষণ ধরে লম্ফঝম্ফ করেছে। কিন্তু আসল জায়গায় কোনো লাফঝাঁপ ছিল না।
একেকবার মনে হয়েছে মাতাল মিনসেটাকে চিৎকরে শুইয়ে অক্ষম অঙ্গটি কেটে ফেলি! একথা শুনে অন্য মেয়েটি বলল, মিনসেটার মুখে যেমন গন্ধ তেমনি সারা শরীরেও ভেড়ার মতো গন্ধ। আরেকজন বলল, আরে না না পচা ঘোড়ার মাংশের গন্ধ। এতসব কথা বলছিল এবং মেয়েগুলো হাসছিল। কথা প্রসঙ্গে একটি মেয়ে রহিম খানের অপরূপ সুন্দরী মেয়ের অদ্ভুত শখের কথা বলল। তার নাম গুলসেফা।
আগ্রাতে নাকি তার মতো সুন্দরী কোনো মেয়ে নেই। বয়স প্রায় ১৮ বছর হতে চলল। বহু রাজপুরুষের বিয়ের প্রস্তাব সে ফিরিয়ে দিয়েছে মনেরমতো পাত্র না পাওয়ার জন্য। তিনি চান যুদ্ধজয়ী বীর প্রকৃতির পুরুষ। সঙ্গে থাকতে হবে কাব্যপ্রতিভা এবং সংগীতপ্রতিভা।
একই সঙ্গে তার দুটি অদ্ভুত আচরণকে মেনে নেওয়ার প্রবৃত্তি। গুলসেফা কেবল অসাধারণ সুন্দরীই নয়, বরং বহুগুণে গুণান্বিত এক প্রতিভাময়ী তরুণী। তার ডাগর ডাগর অাঁখি, লম্বা লম্বা কেশ, দুধে-আলতা গায়ের রং এবং অনিন্দ্য সুন্দর দেহসৌষ্ঠব যেকোনো পুরুষকেই নাকি প্রথম দর্শনে পাগলপারা করে থাকে। তাকে অনেকে সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের সঙ্গেও তুলনা করে থাকেন।
এতসব গুণাবলীর সঙ্গে অদ্ভুত দুটি অভ্যাস রয়েছে গুলসেফার।
কোন জানি শৈশব থেকেই সে লাল রংয়ের বড় কানওয়ালা রাম ছাগল পছন্দ করে আর পছন্দ করে পাগলদের। শহরের নানান কিসিমের বদ্ধ উন্মাদদের সঙ্গে তার রয়েছে বিশেষ খাতির। পাগলাও তাকে পছন্দ করে পাগলের মতো। শহরের প্রায় সব পাগলকে সে নিয়মিত বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়ায় এবং নানারকম উপহার প্রদান করে। সে প্রায়ই নতুন নতুন পাগলের খোঁজে তার লাল রংয়ের রাম ছাগলকে নিয়ে রাস্তায় বের হয়।
ইদানীং আগ্রায় পাগলের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে গুলসেফার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। বিষণ্নতায় ভুগছে। রাস্তায় কোনো পাগর দেখলে গুলসেফা সঙ্গে সঙ্গে তার পালকি থামিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে। নেকাবের কাপড় একটু খুলে মিষ্টি করে হাসে। তারপর অদ্ভুত এক ভালোবাসা আর সহমর্মিতা নিয়ে পাগলদের কাছে এগিয়ে যায়।
পাগলরাও অজানা কারণে গুলসেফার প্রতি অনুরক্ত হয়ে শান্তশিষ্ট ভদ্রলোকের মতো আচরণ করতে থাকে। তার সঙ্গে থাকা প্রহরীদের নির্দেশ দেন পাগলটিকে নিয়ে যমুনার তীরে চলে যাওয়ার জন্য। পাগল বিনা বাক্য ব্যয়ে প্রহরীদের অনুসরণ করতে থাকে। অন্যদিকে গুলসেফার পালকির বহরও সেখানে যায়। এই তামশা দেখার জন্য প্রায়ই শত শত লোক যমুনার তীরে ভিড় করে।
যমুনার তীরে পড়ন্ত বিকালে গুলসেফার এসব কাণ্ড আগ্রাবাসীর অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম। পাগলরা গুলসেফার কথামতো কখনো নাচে আবার কখনো গান গায় কিংবা নানা রকম পাগলামিসুলভ শারীরিক কসরত দেখায়। এ দৃশ্য দেখে গুলসেফা তার মুখের নেকাব একটু উঁচু করে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। উপস্থিত লোকেরা তখন পাগলকে বাদ দিয়ে সেই অপরূপ মিষ্টি হাসির ঝলক উপভোগ করে। একটু পরে আবার নেকাব নামিয়ে মুখমণ্ডল ডেকে দেওয়ার পর উপস্থিত জনতা পাগলের পাগলামি দেখতে থাকে।
এসব মজমায় প্রায়ই শত শত লোক হয়। তবে নতুন এবং ভয়ঙ্কর কোনো পাগল হলে কখনো কখনো হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। আগ্রার ছিন্নমূল শত শত দুরন্ত এবং অর্ধউলঙ্গ কিশোরদের সঙ্গে রয়েছে গুলসেফার ভারি বন্ধুত্ব। এরা সব সময় তার প্রাসাদে যায় এবং শহরে আমদানি হওয়া নতুন পাগল সম্পর্কে খোঁজ-খবর দেয়। পাগলের পাগলামি পছন্দ হলে গুলসেফা কিশোররদের ভালো ভালো মিঠাইমণ্ডা উপহার দেন।
একবার আগ্রায় বিক্রম সিং নামের ভয়ঙ্কর এক পাগলের আমদানি হলো। ৬০/৬১ বছর বয়স। লম্বা এবং পেটানো শরীর। দেখলে যে কোনো লোকই অনুমান করতে পারবে যে বিক্রয় সিং শারীরিক শক্তিতে ৫/৬ জন যুবককে একাই পরাজিত করতে সক্ষম। তার চুল-দাড়ি-মোচ এবং গায়ের সব লোম ধবধবে সাদা।
সারা শরীরে রোমের সংখ্যাধিক্য ও ঘনত্ব দেখে যে কেউ তাকে মানুষ না ভেবে অন্য কিছু ভেবে বসতে পারে। সে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করত আর হাতে থাকত অদ্ভুত আঁকাবাঁকা ভয়ঙ্কর একটি লাঠি। তাকে যে দিন আগ্রার রাস্তায় মানুষ প্রথম দেখল তখন ভাবল হয়তো মস্তবড় কামেল প্রকৃতির মহামানব বা মহা সাধক জাতীয় কিছু একটা হবে। ফলে তার পেছনে পেছনে শত শত লোক হাঁটতে থাকত সিদ্ধিলাভের উদ্দেশ্যে। বিক্রম সিং আস্তে আস্তে হাঁটত এবং মাঝে-মধ্যে বিকটভাবে হা করে হাই তুলত।
আবার হাই তোলা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চাৎদেশ দিয়ে বিকটশব্দে বায়ু ত্যাগ করত। লোকজন তার এই হাই তোলা বিকটশব্দে বায়ুত্যাগের মধ্যেও অলৌকিত্ব খুঁজে বেড়াতে। বায়ু ত্যাগের শব্দ আর মিষ্টি গন্ধ নিয়ে কিছু মানুষ নানারকম কল্প কাহিনী বানিয়ে প্রচার করতে লাগল। ফলে বিক্রম সিংকে অনুসরণকারী জনতার সংখ্যা বাড়তে লাগল।
বিক্রম সিংকে ঘিরে আগ্রায় কল্প কাহিনী এমনভাবে ছড়াল যে, সে রাস্তায় নামলে হাজার হাজার মানুষ মিছিল সহকারে তার পেছনে পেছনে ছুটত।
হঠাৎ করে জনতার মিছিলে দেখা গেল ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। সামনে কি হয়েছে কেউ বলতে পারে না। তবে মারাত্দক কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। কারণ হাজার হাজার মানুষ ওরে বাবাগো ওরে মাগো, খেয়ে ফেলবে গো_ রাক্ষক, রাক্ষস, পালাও, পালাও বলে চিৎকার করছে এবং যে যার মতো পালানো শুরু করল। অনেক লোক আহত হলো এবং অনেক লোক সংজ্ঞা হারিয়ে রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।
যারা পালাতে পারল তারা কোনো মতে সরে পৌঁছে ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। দাঁতের পাটিগুলো একে অপরের সঙ্গে লেগে কটকট আওয়াজ তোলার পাশাপাশি দুই হাঁটুর কাঁপুনি দেখে পরিবারের মেয়েরা শুরু করল আর্ত-চিৎকার। তখন আগ্রায় বেশির ভাগ মানুষই ভূতের ভয়ে দিনরাত তটস্থ থাকত। নানা নামের ছোটবড় নানা কিসিমের ভূতের হাত থেকে বাঁচার জন্য নারী-পুরুষ সবাই কোমরে, গলায় এবং হাতে অসংখ্য তাবিজ ও রুদ্রাক্ষের মালা পরত। মহিলারা সব চেয়ে বেশি ভূতকে ভয় পেত।
কারণ ভূতের যত আকর্ষণ কেবল তাদের নিয়েই। বাড়ির মহিলারা তাদের পুরুষ মানুষদের ভীত-সন্ত্রস্ত চিৎকার এবং দাঁতের পাটি ও হাঁটুর কাঁপুনি দেখে জোরে জোরে আর্ত-চিৎকার শুরু করল। কেউ কেউ হাতের তাবিজ মুখের মধ্যে দিয়ে চুষতে থাকল। ভয়ে তাদের মুখ ও জিহ্বা শুকিয়ে গিয়েছিল। ফলে তাবিজ মুখের মধ্যে পুরার পর পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হলো।
অনেকে পানির কলস এনে সোজা মাথা ওপর ঢেলে দিল। কেউবা কাঁচামরিচ কিংবা শুকনো মরিচ ভেঙে ভয়ার্ত পুরুষের নাকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। তখনো কেউ জানাল না, আসলে কি হয়েছে।
ঘটনা ঘটার ২/৩ ঘণ্টা পর জানা গেল আসল কাহিনী। আগ্রায় তখন পাগলের পাশাপাশি বেওয়ারিশ পাগলা কুকুরের সংখ্যাও বেড়ে গিয়েছিল।
পাশর্্ববর্তী রাজস্থানের মরু অঞ্চল থেকে ইয়া বড় বাঘের আকৃতির অনেকগুলো কুকুরের শহরে আগমন ঘটল। এর মধ্যে কয়েকটি ছিল বেওয়ারিশ এবং শহরের বিরূপ পরিবেশে ৩/৪টা কুকুর পাগল হয়ে গেলে। শহরবাসী সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পাগলা কুকুরটির নাম দিয়েছিল বিক্রম সিং। পাগল বিক্রম সিং শহরে আসার মাসখানক আগে কুকুর বিক্রম সিংয়ের আগমন ঘটেছিল। কুকুরটি যে রাস্তায় হাঁটত সে রাস্তা মুহূর্তের মধ্যে খালি হয়ে যেত।
ইতোমধ্যে সেটি কয়েকশ নিরীহ পথচারীকে কামড়ে জনমনে যথেষ্ট ভীতির সঞ্চার করেছিল। ঘটনার দিন পাগল বিক্রম সিংয়ের বহরের সামনে হঠাৎ করেই কুকুর বিক্রম সিং এসে হাজির। পাগলা কুকুর তার স্বভাব অনুযায়ী শুরু করে ঘেউ ঘেউ। তারপর তেড়ে আসে পাগলের দিকে। চারদিকে শুরু হয় শ্বাস রুদ্ধকর হাউমাউ।
এরই মধ্যে পাগলটি ধীরে সুস্থে এগিয়ে যায় প্রতিপক্ষের দিকে এবং প্রতিপক্ষকে কোনোরূপ সুযোগ না দিয়ে এক হাত দিয়ে সেটির টুঁটি চেপে ধরে এবং অন্য হাত দিয়ে পেছনের দুটি পা। কুকুরটি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এরপর বিক্রম সিং প্রচণ্ড এক কামড়ে কুকুরের গলার দিক থেকে কিছুটা মাংস ছিঁড়ে নিয়ে চিবোতে আরম্ভ করে। এ দৃশ্য দেখার পর বিক্রম সিংয়ের পেছনে থাকা মানুষের মধ্যে শুরু হলো হে-হুল্লোড়, চিৎকার-চেঁচামেচি আর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য অবস্থায় দৌড় প্রতিযোগিতা।
পুরো আগ্রা শহরে বিক্রম সিংয়ের ভয়ঙ্কর পাগলামির খবর বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে পড়ল।
মানুষ ভয়ে রীতিমতো কাঁপাকাঁপি শুরু করল। যে রাস্তায় বিক্রম সিং হাঁটতে বের হয় সে রাস্তা মুহূর্তে জনশূন্য হয়ে যায়। দোকানপাটও সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, রাজপথে টহলরত পুলিশ কিংবা রাজকীয় সেনাবাহিনীর ঘোড়সোয়ারও পালাতে আরম্ভ করল। গুলসেফা তার কিশোর বাহিনীর কাছে আগ্রার নতুন পাগল বিক্রম সিং সম্পর্কে জানল।
এরপর সদলবলে বেরিয়ে পড়ল পাগলের উদ্দেশে। অন্য সব পাগলের মতো বিক্রম সিংয়ের সঙ্গেও গুলসেফার খ্যাতির হয়ে গেল। যে দিন গুলসেফা বিক্রম সিংকে নিয়ে যমুনা তীরে গেল সেদিন পুরো শহরের উৎসাহী মানুষ ভিড় করল নতুন এক আশ্চর্য তামশা দেখার জন্য। এ জনতার মধ্যে সেনাপতি কিসলু ইবনে ইয়াসারও ছিলেন। তার কিন্তু পাগল বিক্রম সিং সম্পর্কে কোনো আগ্রহ ছিল না।
পুরো আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল নেকাবে ঢাকা গুলসেফার মুখমণ্ডল দর্শন।
কিসলু ইবনে ইয়াসার প্রথম দর্শনেই গুলসেফার প্রেমে পড়ে গেলেন। এক অসৈহ্য প্রেমের বেদনা তাকে ঘিরে ধরল। তিনি যে কোনো মূল্যে প্রেয়সীর কাছে যেতে চাইলেন। নেকাবে ঢাকা তার মুখ, হাসি, হাস্যোজ্জ্বল দাঁতের অপরূপ সৌন্দর্য, তুলতুলে নরম গাল, উন্নত ললাট এবং ডাগর ডাগর চোখের বাঁকা-বাঁকা চাহনির দৃশ্য যতই কল্পনা করেন ততই অধীর হয়ে ওঠেন তাকে একান্তভাবে কাছে পাওয়ার জন্য।
তিনি ভুলে যেতে আরম্ভ করলেন তার রাজপদ, পারস্যে রেখে আসা অভিজাত এবং রাজকুমারী স্ত্রী, সন্তানসহ হেরেমের সুন্দরী দাসী-বাঁদীদের কথা। তার সমস্ত চিন্তা-চেতনাজুড়ে কেবল গুলসেফার ঝড় বইতে থাকল। তিনি একবার চিন্তা করলেন প্রেয়সীর পিতা মোগল সেনাপতির সঙ্গে দেখা করে নিজের মনের কথাটি খুলে বলবেন। আবার চিন্তা করতে থাকলেন শাহেনশাহ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে দেখা করে পারস্য সম্রাটের বার্তা পেঁৗছানোর পর গুলসেফার বিষয়টি উত্থাপনের জন্য। ইতিপূর্বে কান্দাহারে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল এবং অনেকদিন একসঙ্গে থাকার কারণে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও রয়েছে।
কাজেই সম্রাটকে বললেই সব সমস্যার সর্বোত্তম সমাধান সম্ভব।
কিসলু ইবনে ইয়াসার যখন গুলসেফার প্রেমে পড়লেন তখন আগ্রার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ, জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছিল। এ অবস্থায় হুট করে রাজদরবারে উপস্থিত হওয়াটাও তার জন্য নিরাপদ ছিল না। ফলে আরও কিছু দিন ভাড়া বাড়িতে আত্দগোপনে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সময় যেন আর কাটছিল না।
গুলসেফাকে দেখার জন্য তিনি উতলা হয়ে উঠলেন। এদিকে গত কয়েকদিনে শহরে কারফিউ থাকার কারণে গুলসেফা ও তার কিশোরবাহিনী শহরের পাগলদের নিয়ে রং তামাশা করার জন্য যমুনার তীর আসছে না। অন্যদিকে বিক্রম সিংকে নিয়ে গতকাল ঘটে গেছে তুলকালাম ঘটনা। নগরের প্রধান কোতোয়াল অর্থাৎ পুলিশ প্রধানের হুকুমে তাকে গ্রেফতার করে সঙ্গে সঙ্গে শিরশ্ছেদের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। কোতায়ালের লোকজনের মাধ্যমে জানা গেল, বিক্রম সিং মূলত একজন দাগী ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি ছিল।
পাঞ্জাবের গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান গ্রামে জন্মগ্রহণকারী বিক্রম সিং সমগ্র পাঞ্জাব অঞ্চলের অত্যন্ত সুপরিচিত ধনাঢ্য ব্যক্তি এবং ধর্মগুরু ছিল। অঢেল ধন-সম্পত্তি, রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি তার ছিল লাখ লাখ অনুসারী। এসব অনুসারী তাদের গচ্ছিত ধন-সম্পত্তির এক বিরাট অংশ বিক্রম সিংয়ের কাছে জমা রাখত।
ভক্ত-অনুরাগীদের অর্থ বিক্রম সিং এক সময় ফেরত দিতে অস্বীকার করে। অন্যদিকে কয়েকটি অভিজাত পরিবারের মেয়েরা বিক্রম সিং কর্তৃক সম্ভমহানির শিকার হয়।
ফলে লোকজন স্থানীয় মোগল সুবেদারের কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ জানালে সুবেদার তাকে গ্রেফতার করে। বিচারে সে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়। প্রাদেশিক কাজীর দরবারে বিচারক কর্তৃক রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রম সিং ভরা মজলিসে কাপড়-চোপড় খুলে শুরু করেন তাণ্ডব। প্রহরীদের কাছ থেকে তলোয়ার, বর্শা কেড়ে নিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করে ফেরারি হয়ে যান। সমগ্র সাম্রাজ্যে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার প্রায় বছর খানেক পর রাজধানী আগ্রা থেকে সৈন্যরা পাগলের ছদ্মবেশে থাকা বিক্রম সিংকে গ্রেফতার এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।
কিসলু ইবনে ইয়াসার একদিকে যেমন দিবারাত্র গুলসেফার কথা ভাবছিলেন অন্যদিকে বারবার কেন জানি বিক্রম সিংয়ের কথাও স্মরণ করছিলেন। হঠাৎ করে তার মনে হলো আচ্ছা বিক্রম সিংয়ের মতো যদি নিখুঁতভাবে পাগলের অভিনয় করতে পারি তবে নিশ্চিতভাবে প্রতিদিন বিকালে গুলসেফার সাক্ষাৎ লাভ করা যাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। অর্থাৎ অনতিবিলম্বে শুরু করলেন পাগলের অভিনয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে আগ্রার অলিতে-গলিতে চুদুরবুদুর পাগলরূপে বেশ খ্যাতি অর্জন করলেন। পাগলরূপে অভিনয় করতে গিয়ে কিসলু ইবনে ইয়াসার একদিকে যেমন প্রতিদিন গুলসেফার সাক্ষাৎ নিতে থাকলেন তদ্রূপ আগ্রার সামগ্রিক রাজনৈতিক, সামাজিক এবং কৌশলগত সামরিক সমস্যা সম্পর্কে নানারকম চাঞ্চল্যকর তথ্য পেতে থাকলেন।
এরই মধ্যে তার মনে হলো সম্রাটের সঙ্গে খুব দ্রুত তার সাক্ষাৎ করা দরকার। জরুরি বিষয় আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি পারস্য সম্রাটের বিশেষ বার্তা হস্তান্তরের জন্য। ঠিক তখনই তিনি পাগলরূপে সম্রাটের সামনে লাফাতে লাগলেন এবং বলতে থাকলেন বলুন দেখি যে দেশে হাতি গু খায়, সেই দেশের কুত্তায় কি খাবে?
সম্রাট সেনাপতি কিসলু ইবনে ইয়াসারের কথাগুলো শুনছিলেন এবং দারুণভাবে রোমাঞ্চিত হচ্ছিলেন। তার দেওয়া গোয়েন্দা অর্থাৎ এবং পারস্য সম্রাটের বন্ধুত্বের পয়গাম এ মুহূর্তে সম্রাটের জন্য এক বিরাট শুভ বার্তা বয়ে নিয়ে এলো। রাজ দরবারে তার প্রতিপক্ষরা যখন জানাল, মহামতি পারস্য রাজ শাহ আব্বাসের বন্ধুত্বের বার্তাসহ তার বিখ্যাত সেনাপতি কিসলু ইবনে ইয়াসার মোগল সম্রাটের কাছে এসেছেন তখন তারা এমনিতেই ভয়ে চুপষে গেল।
আনুষ্ঠানিক আলোচনার শেষপর্যায়ে সম্রাট মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা আমি কি আপনার সঙ্গে গুলসেফা বেগমের শাদির ব্যাপারে তার পিতা খানে খানান আবদুর রহিমের কাছে প্রস্তাব পাঠতে পারি! লজ্জায় রাঙা হয়ে পারস্য সেনাপতি সম্রাটকে কুর্নিশ করে তার সম্মতি ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। সম্রাটের মধ্যস্থাতায় গতকালই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেছে। সম্ভবত কিছু দিনের মধ্যেই প্রেমিকদম্পত্তি পারস্যে রওনা হবেন। সারা দিনের কর্মব্যস্ততা আর নানামুখী চাপের কারণে সম্রাট তার প্রিয়তমা নূরজাহানের কথা তেমন ভাবার সময়ই পাননি। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় নিজ খাস কামরায় প্রবেশ করার পর তার হৃদয় আকুল প্রেমের উথাল ঢেউয়ে নাচানাচি শরু করল।
মনে হলো তখনই ছুটে গিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে কানে কানে বলেন, প্রিয়তমা তোমাকে ভালোবাসি, অনেক অনেক ভালোবাসি। হৃদয়ের কুসুম কুসুম ভালোবাসার ঢেউ বাড়তে বাড়তে শরীরের বাইরে চলে এসেছে। দেহ-মন দুলছে প্রেমের দোলায়। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আর পেশিগুলো উদগ্রীব হয়ে উঠছে প্রেমের দোলাচলে নাচানাচি করার জন্য। সন্ধ্যায় মনোরম পরিবেশে সম্রাট তার খাস কামরার চারদিকে তাকালেন, হঠাৎ করেই বিস্ময়ে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন।
দেয়ালে সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের অসাধারণ একটি পোর্টেট কে যেন টাঙিয়ে রেখেছে। একটি গোলাপের বাগানে সম্রাজ্ঞী দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে বড় একটি রক্ত গোলাপ নিয়ে। আর স্মিতহাস্যে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। শরীরে যৌবনের সবটুকু সৌন্দর্যের অনুপম মহিমার অপরূপ লাবণ্য উপচে পড়ছে। মুখমণ্ডলের মসৃণতা, নাক, অধর কিংবা ললাট বা পেটের কমনীয়তা শিল্পী এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে, সম্রাট অবাক না হয়ে পারলেন না।
বিশেষত চোখের চাহনীর মধ্যে যেমনি রাজসিক অভিব্যক্তি তেমনি নারীত্বের চিরায়ত আবেদন যে কোনো মানুষকে মুগ্ধ না করে পারবে না।
সম্রাট দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করলেন। ব্যক্তিগত সচিবকে এত্তেলা পাঠিয়ে জানিয়ে দিলেন, সন্ধ্যার পর কোনো বৈঠক হবে না। রাতের খাবার সম্রাজ্ঞীর মহলে খাবেন বলে অন্দরমহলে খবর পাঠালেন। সম্রাটের অস্থিরতা ও চিত্ত-চাঞ্চল্যতা দেখে যে কারও মনে হতে পারে, তিনি জীবনে কোনো নারী সম্ভোগ করেননি এবং সংস্পর্শে আসার সুযোগও পাননি।
তাই জীবনের প্রথম বাসরের প্রাক-মুহূর্তের ছটপটানি তাকে পেয়ে বসল। গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। পাশে রাখা শুরার পাত্রের দিকে হাত বাড়ালেন। বহু দিন থেকে তিনি শুরা পানে অভ্যস্ত। মোগল পরিবারের শুরু থেকে অর্থাৎ সম্রাট বাবর থেকে আজ অবধি সব সম্রাট ও রাজপুত্রগণ নিয়মিত শুরাপান করে আসছেন।
নিজেদের হেরেমে রক্ষিত ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম সুন্দরী রমণীদের সংস্পর্শে যাওয়ার আগে তারা আচ্ছামতো শুরাপান করে থাকেন। রমণীদের সঙ্গে রমণের বাইরে আরেকটি শুরাপানের স্থান হলো নাচঘর। হেরেমের নৃত্যপটিয়সী সুন্দরীরা সম্রাট বা রাজকুমারদের চাহিদা মতো নাচ-গান করে থাকে। কখনোবা ভরা মজলিসে আবার কখনোবা একান্ত-নিভৃতে। শুরা এবং সাকীর দ্বিমুখী আকর্ষণের সুধারস উপভোগ করতে করতেই রাজ পুরুষরা যুদ্ধে যান, যুদ্ধে জয়লাভ করেন এবং রাজ্যশাসনের মতো স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ দৈনন্দিন কার্য সম্পাদন করেন।
মোগল খান্দানে আজ অবদি কোনো সম্রাটকে শুরা বা সাকীর প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সাম্রাজ্যবিরোধী একটি কাজও করতে দেখা যায়নি। ফলে সম্রাটদের এসব অভ্যাস জনগণ মেনে নিয়েছে। তারা ন্যায় বিচার, সুশাসন, আর্থিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পেয়েই খুশি। ফলে গত প্রায় ১০০ বছর তামাম হিন্দুস্তানের জনগণ বিদেশি রক্তের ধারক হওয়া সত্ত্বেও এই শাহী খান্দানের আনুগত্য করে আসছে।
শুরার পাত্রে হাত রেখে সম্রাট আনমনে কি যেন ভাবলেন।
তারপর শুরা রেখে পানি পান করলেন। নূরজাহানের সঙ্গে প্রথম বাসরের পর তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এই গৃহে তিনি কখনো শুরা পান করবেন না বা শুরাসক্ত হয়ে
প্রবেশ করবেন না। এই প্রতিজ্ঞার পেছনে সুদীর্ঘ প্রেক্ষাপট ও কারণ ছিল। বহু বছর ধরে সম্রাট শুরা পান করে আসছিলেন। তার জীবনের একাধিক
বিয়োগন্ত ঘটনা, রাষ্ট্রনীতি নিয়ে পিতার সঙ্গে বিরোধ এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকারিত্ব নিয়ে সৃষ্ট বহুমুখী চক্রান্তের কবলে পড়ে সম্রাট অনেকদিন থেকেই মরাত্দক বিষণ্নতায় ভুগছিলেন।
প্রথম যৌবনের দিনগুলোতে কেবল ফুর্তি করার জন্যই তিনি শুরা পান করতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিজের হতাশা ও ব্যর্থতা ভুলে থাকার জন্য তিনি অতিমাত্রায় শুরার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়লেন। এতটাই আসক্ত যে, আজ অবধি কোনো রাজা-বাদশাহ কিংবা শুরাসক্ত সাধারণ মানুষ তার মতো অতিরিক্ত মাত্রার অ্যালকোহল গ্রহণ করতে পারেননি। সাধারণ শুরাতে অ্যালকোহলের মাত্রা শতকরা ৩০ ভাগের বেশি থাকে না। কিন্তু
শাহেনশা যে শুরা পান করেন, তাতে অ্যালকোহলের মাত্রা থাকে শতকরা ৬০ ভাগেরও বেশি।
সাধারণ মানুষ এ ধরনের অ্যালকোহল পান করলে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। [ চলবে ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।