অনেকদিন পর দেশে গিয়েছিলাম। উত্তরায় বোনের শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে দেখা করে বনানীতে ফিরছি নর্থ সাউথ পড়ুয়া ছোটবেলার বন্ধু ইকবালের সাথে দেখা করতে। বাসে উঠেই দেখি সামনের দিকে কয়েকটা সিট খালি! ঢাকা শহরে পাবলিক বাসে বসে যাতায়াত করার ভাগ্য নিতান্তই গুটিকতক মানুষের হয়। নিজেকে সেই সৌভাগ্যবানদের অন্তর্গত দেখে খুবই পুলকিত হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ আগের একটা রিকশাওয়ালার বেয়াদবি নিঃশর্তে ক্ষমা করে দিলাম।
জানালার পাশের সিট খালি। সেখানে যেতে হলে একটা লোককে টপকে যেতে হবে। আমি সাইড চাইতেই তিনি দিয়ে দিলেন। জানালার পাশে বসলাম। জানালা খুলে দিলাম।
তার নিজের দিককার জানালা সামান্য বন্ধ হয়েছে বলে পিছনের যাত্রী খ্যাচ খ্যাচ করে উঠলেন না। বাস এয়ারপোর্ট রোডের প্রায় ফাঁকা রাস্তায় চলতে লাগলো। খোলা জানালা দিয়ে ফুরফুর করে বাতাস ঢুকছে। কি ভাল লাগছে! আমি বাসের টিকেট কাউন্টারের কর্মচারীর দুর্ব্যবহারও নিঃশর্তে ক্ষমা করে দিলাম।
"হ্যালো! মাই নেম ইজ আজমল।
অ্যান্ড ইয়োর্স?"
আমি চমকে পাশে ফিরলাম। খাইছে! আমার পাশের ভদ্রলোক আমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলছে কেন? উচ্চারন শুনেই বোঝা যায় ইনি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়া ছাত্র নন, আমার মতই ভেতো বাঙ্গালি।
"রাজীব। "
"নাইস টু মিট ইউ। "
"নাইস টু মিট ইউ টু।
"
"হোয়াট ডু ইউ ডু মিস্টার রাজীব?"
"স্টুডেন্ট। "
"নাইস! নাইস!! ভেরি নাইস!!! আই এম অলসো এ স্টুডেন্ট। "
লোকটা তার প্রতিষ্ঠানের নাম বললেন। অনেক আগের ঘটনা, মনে করতে পারছি না।
"হোয়ার ডু ইউ স্টাডি মিস্টার রাজীব?"
"ইউ.টি.ডি।
"
"ওকে!"
লোকটা এমনভাবে 'ওকে' বলল যেন সে সহজেই বুঝে ফেলেছে আমি ঠিক কোথায় পড়ি। হয়তো ইউ.টি.ডি বলতে বুঝেছে, "ইউনিভার্সিটি অফ তেজকুনিপাড়া, ঢাকা!"
"হোয়াট আর ইউ স্টাডিয়িং?"
"একাউন্টিং। "
"গুড! আই এম স্টাডিয়িং বিবিএ, ফোর্থ সেমিস্টার। "
"গুড!"
বেচারার সাথে খাজুরে আলাপ করতে ইচ্ছা করছে না। আমি জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখায় মন দিলাম।
"আই এম অলসো স্টাডিয়িং আইয়েল্টস। আই এম ট্রায়িং টু গো টু এব্রড ফর হায়ার স্টাডিজ!"
এতক্ষনে ওনার ইংরেজি বচনের শানেনযুল জানা হলো! স্পোকেন ইংলিশ ঝালিয়ে নিচ্ছেন।
"গুড লাক অন দ্যাট!"
"হয়্যার ডু ইউ লিভ মিস্টার রাজীব?"
ভাল প্রশ্ন। আমি কোথায় থাকি? ঢাকায় আসলে নানুর বাসায়, ইকবালের মেসে, নয়তো রাতিবের বাসায় রাতে আড্ডা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়ি। ঢাকায় আমার এখন নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই।
সিলেটে গেলেও, সেটা কি আমার বাসা? সেখানেও বাবার বাসায় আমি যে মাত্র কয়েকদিনের মেহমান! তাই আমি সরলভাবে নিজের স্থায়ী ঠিকানার নাম বললাম।
"ইন ডালাস, ইউএসএ। "
লোকটা এমনভাবে তাকালো যেন আমি রসিকতা করছি। যেন মনে মনে বলছে, "দ্যাখছি তোর মতন অনেক আমেরিকান! শালা, অফ যা!"
হয়তোবা মুখেও সেকথা বলতেন, কিন্তু ইংরেজিতে কথা গুছিয়ে ট্রান্সলেট করতে পারেননি। 'শালা'র আভিধানিক ইংরেজিটাও যুৎসই না।
"ব্রাদার ইন ল, গো অফ!" ঠিক গালির মত শোনাবে না।
পরের স্টপে বাস থামলো। বেশ কয়েকজন যাত্রীর সাথে একজন মহিলা উঠে এলেন। তিনি বাসে উঠেই আমার দিকে তেড়ে এলেন, "আপনি এখানে বসে আছেন কোন আক্কেলে? লজ্জা শরম নাই? বেয়াদবের মত সিট দখল করে আছেন?"
আমার পাশের ভদ্রলোক বিনা প্রতিবাদে উঠে পেছনের দিকের সিটে চলে গেল। আমি তখনও নিজের সিটে বসা।
প্রথমত আমি বুঝতেই পারলাম না আমার প্রতি মহিলার হঠাৎ এত রাগ কেন? দ্বিতীয়ত আমি যতদূর জানি আমি ছিপছিপে শরীরের ছেলে। আমি একটা সিটে বসলে অর্ধেকটা খালি পড়ে থাকে, এই মহিলা কিসের হিসেবে বলছেন যে আমি কারো সিট দখল করে আছি? আমি চুপচাপ বসে আছি, বেয়াদবি করলাম কার সাথে? বাসে জানালার পাশে সিট পেয়েছি, বসেছি। এতে লজ্জা পাবার কী আছে? সবচেয়ে বড় ব্যপার, একজন অচেনা মহিলা আমার দিকে এইভাবে তেড়ে আসেন কোন অধিকারে?
আমারও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, যেটা অতি দ্রুতই হয়। তবে নারীদের সাথে মেজাজ যতটুকু সম্ভব ঠান্ডা রেখে কথা বলার চেষ্টা করি।
আমি বিনীত ভাবে বললাম, "আপনি যদি প্লিজ ভদ্রভাবে আমাকে বুঝিয়ে বলতেন যে আমি ঠিক কী করেছি, তাহলে খুবই উপকার হত।
"
মহিলা ভদ্রতার ধার ধারলেন না। অথবা উনার কাছে হয়তো সেটাই ভদ্রতা, আমিই বুঝতে পারিনি। "আবার মুখে মুখে কথা? উঠেন! উঠেন এখুনি!"
এবার মেজাজ আরও খারাপ হলো। দাঁতে দাঁত পিষতে লাগলাম। মহিলার দিকে ভালভাবে তাকালাম।
বয়স খুব বেশি নয়। রোগা পাতলা শরীর। সাধারন বাঙ্গালি চেহারা। গায়ের রং ফর্সার দিকে। বাংলাদেশে অবশ্য ফর্সা গায়ের রংই সুন্দরী হবার প্রথম শর্ত।
এই মহিলাও হয়তো সে কারনে নিজেকে সুন্দরী ভেবে বসে আছেন। হয়তো মনে মনে এই ভেবে সুখী হন যে দেশের সব ছেলেই উনাকে প্রথম দেখাতেই ভালবেসে ফেলে। শয়নে স্বপনে জাগরণে শুধুই তার ছবিই কল্পনা করে। নিজের হাত কেটে রক্ত দিয়ে প্রেম পত্র লিখে। নাহলে আমার প্রতি উনার এ ধরনের আচরণের অর্থ কি?
আমাকে যেহেতু উনি রাগিয়েছেন, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমিও বদলা নিব।
তাই পুরো বাস ভর্তি লোকের সামনে আমি অতি অমায়িক স্বরে বললাম, "আন্টি! আমি এখনও বুঝতে পারছি না ঘটনা কী। আপনি যদি প্লিজ আমাকে বুঝিয়ে বলেন, তাহলে খুব উপকার হতো। "
হিরোসিমায় বোমা ফেটে গেছে। জাপান সরকার কোণঠাসা হয়ে গেল। মহিলার প্রায় সমবয়েসী একটি ছেলে উনাকে 'আন্টি' ডাকছে এটা উনি হজম করতে সময় নিলেন।
তারপর বিদ্ধস্ত কন্ঠে বললেন,
"উপরে কী লেখা আছে, সেটা পড়তে পারছেন না?"
আমি সাথে সাথে উপরে তাকালাম। একজায়গায় লেখা, ব্যবহারে বংশের পরিচয়। এই লেখা যে তিনি পড়েননি, সেটা বুঝতে পারছি। তার পাশে অবশ্য লেখা, "মহিলা, নারী ও প্রতিবন্ধিদের জন্য বরাদ্দকৃত সংরক্ষিত ছয়টি আসন। "
আমি যে সময়ে দেশ ছেড়েছিলাম, সে সময়ে শুধু মাত্র ড্রাইভারের পাশের কয়েকটা সিট ছিল মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত।
ড্রাইভার যেন নারী যাত্রী দেখতে পেছনে তাকাতে গিয়ে এক্সিডেন্ট না করে বসে সে জন্য চমত্কার ব্যবস্থা। এরপর সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বাড়ানোর খবর আমি পাইনি। সাথে সাথে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। খালি সিটের রহস্য এতক্ষনে ঘুচলো। পাশের ভদ্রলোক কেন কোন কথা না বলেই পেছনে চলে গিয়েছেন, সেটাও বুঝতে পারলাম।
আমি লাফ দিয়ে সিট ছেড়ে দিলাম।
মুখে খুবই লজ্জিত হাসি এনে বললাম, "সরি!"
মহিলা এখনও আগের বোমা হামলায় বিদ্ধস্ত ভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, "ইংরেজীতো শুধু এই একটাই শিখছেন। কথায় কথায় সরি!"
মহিলা হয়তো এ কথা দিয়ে বাসের অন্যান্য যাত্রীদের বোঝাতে চাইলেন যে আমার ইংরেজি জ্ঞান খুবই নিম্ন পর্যায়ের। 'আন্টি' শব্দটির মানে আমি না জেনেই উনাকে সম্বোধন করেছি।
আমি আর মহিলার সাথে কোন কথায় জড়াবার চেষ্টা করলাম না। চুপচাপ বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বনানী পর্যন্ত আসলাম। মাঝে একটা সিট খালি হয়েছিল। আমার পাশেই আরেকজন মহিলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে বসার সুযোগ করে দিতে গিয়ে আমি সেখানে বসলাম না।
ভিড় ঠেলে মহিলা সিটে বসার আগেই একজন মধ্যবয়স্ক 'সুখী' (স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল হলে লোকটার পেটের সাইজ বলে দেয় উনি কতটা সুখী!) ভদ্রলোক নির্বিকারভাবে সিটে বসে জানালা দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে নগর দেখতে লাগলেন। আমার বা মহিলার দিকে ফিরেও তাকালেন না।
ভদ্রলোকের(!?) এমন আচরনে আমি আন্টির সব দুর্ব্যবহার নিঃশর্তে ক্ষমা করে দিলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।