একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে নিয়ে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিতে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। এ ইস্যুতে বিক্ষোভ কর্মসূচি ও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিব্রত দলের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া নেতারা। সাকা চৌধুরীর দায় নিতে নারাজ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের যুব নেতারাও। শুধু দলীয় নেতারাই নন, বিএনপি সমর্থক তরুণ প্রজন্মের বড় একটি অংশ সাকার পক্ষে কর্মসূচিতে ক্ষুব্ধ। সে কারণে গতকাল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-সমাবেশ ছিল অনেকটাই প্রাণহীন।
তবে কিছু নেতা মনে করেন, এ ইস্যুতে বিএনপির হরতাল বা কঠোর কর্মসূচি দেওয়া উচিত ছিল। শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের মতামত বিবেচনায় নিয়ে কৌশলী ভূমিকা নেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। দলের সিনিয়র এক নেতার ভাষায়, 'সাকা চৌধুরী ইস্যুতে দলের অবস্থান হলো- ধরি মাছ না ছুঁই পানি। কারণ, বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। ' বিএনপির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'সাকা চৌধুরীর ফাঁসির আদেশের পর সাদামাটা একটি বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়ায় বুঝতে হবে, তাকে নিয়ে দলের অবস্থান কী? তাছাড়া এ ইস্যুতে দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় বক্তব্যের ধরন, চট্টগ্রামে দায়সারা হরতাল পালনেও বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার হওয়ার কথা।
কারণ, সাকা চৌধুরী দলের খাঁটি লোক নন। বিভিন্ন সময়ে দলে তিনি বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের পরিবার সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিও নেতিবাচক। তাই সাকার ফাঁসির রায়ে বিএনপির পূর্ণ সহানূভুতি পাওয়া কঠিন। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা শহীদ জিয়ার দল বিএনপি ও নতুন প্রজন্ম তার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না।
এসব বিবেচনায় হরতাল বা কঠোর কর্মসূচি দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে বিএনপি। ' সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর ওই দিন রাতে স্থায়ী কমিটিসহ সিনিয়র নেতা ও আইনজীবীদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। সেখানে সাকার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত আসে। ফাঁসির রায়ের বিরুদ্ধে দলের কয়েকজন নেতা দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকতে বেগম জিয়ার ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। বৈঠকে ওই নেতারা বলেন, 'সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং দুঃসময়ে একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
তার বিষয়ে নীরব থাকা কোনো বিবেচনায়ই ঠিক হবে না। ' ভোটের রাজনীতিতেও দলের ক্ষতি হবে বলে তারা জোরালো যুক্তি দেখান। কিন্তু অন্য অংশের নেতাদের মত, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে দেশে যে জনমত গড়ে উঠেছে, তা বিবেচনায় রাখতে হবে। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এ ইস্যুতে বিতর্কে জড়ানো যাবে না। তাছাড়া তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা এটাকে ইতিবাচকভাবে নেবে না।
তাই কৌশলী ভূমিকা নেওয়া উচিত। একই সঙ্গে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ চলমান ইস্যুতে আন্দোলন করে সরকার হটাতে পারলে পরবর্তীতে সাকা চৌধুরীর পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব হবে। জানা গেছে, সাকা চৌধুরীর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে হরতাল দেওয়ার ব্যাপারে একটি অংশ চাপ দিলেও শেষ পর্যন্ত কঠোর কর্মসূচি দেওয়া থেকে বিরত থাকেন বিএনপির নীতি নির্ধারকরা। তারা ২৪ অক্টোবরের পর নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচিতে না যাওয়ার পক্ষে। তাদের মতে, চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে হামলা-মামলায় জড়ানো ঠিক হবে না।
তাছাড়া সিলেটে জনসভা ও ঈদুল আজহার আগে এ ধরনের কর্মসূচি দিলে দলের জন্যই ক্ষতি হবে। এসব বিবেচনায় সাকা চৌধুরী ইস্যুতে বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিক্ষোভ সমাবেশে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। অন্যদিকে, চট্টগ্রামেও কর্মসূচিতে বিএনপির উল্লেখযোগ্য অনেক নেতাকেই দেখা যায়নি। শীর্ষস্থানীয় চার নেতা এম মোর্শেদ খান, আবদুল্লাহ আল নোমান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন এবং তাদের অনুসারীদের রায়ের পূর্বাপর মাঠে দেখা যায়নি।
মহানগর ও উত্তর-দক্ষিণ জেলা বিএনপির দায়িত্বশীল বেশ কয়েকজন নেতাও কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ দু-একটি বাক্য বিনিময় করলেও বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন। মোট কথা সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায়ে তার নিজ জেলা চট্টগ্রামে তেমন প্রতিক্রিয়াই দেখা যায়নি। মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন তার কিছু অনুসারী নিয়ে মঙ্গলবার চট্টগ্রামে হরতাল আহ্বান করলেও এতে স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল না।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, 'একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার আমরাও চাই।
কারণ, আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা নিজেই রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। তবে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের বক্তব্য হলো, যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তারা যেন ন্যায়বিচার পান। বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন। কিন্তু এই বিচার ব্যবস্থা নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে। রায়ের আগে এর অনুলিপি প্রকাশ হওয়ার বিষয়টি ট্রাইব্যুনাল নিজেই স্বীকার করেছেন।
সুতরাং ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক। ' স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, 'সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী আমাদের দলের একজন নেতা। তার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে রায় ঘোষণার আগেই রায়ের কপি আইন মন্ত্রণালয়ে পাওয়া যায়। এতে কি বোঝা যায় না, বিচারপতির রায় আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম লিখে দিয়েছেন।
এসব কারণে আমরা বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। তবে ২৪ অক্টোবরের পর টানা আন্দোলনে যাব। তাই এর আগে বড় কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে না। 'সাকা চৌধুরীর রায় ইস্যুতে ডাকা বিক্ষোভ-সমাবেশে যোগ দেননি ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধার দল হিসেবে বিএনপির উচিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া।
আর এটা এই প্রজন্মের কাছে আরও পরিষ্কার করা উচিত। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাকা চৌধুরীর মুত্যুদণ্ড হয়েছে। এ নিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তাছাড়া যে সময়ের ঘটনা নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তখন তিনি বিএনপিতে ছিলেন না। তাই বিএনপিরও তার অপকর্মের দায় নেওয়া ঠিক হবে না।
'
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।