আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেমন আছেন সেকুলার ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুসলমানরা

সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চাইনা

গত ২৬ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার ঢাকার বাংলা দৈনিক ‘সমকাল’ বিবিসির বরাত দিয়ে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার ছবি তুলে ধরে তার কারণ খোঁজার চেষ্টা চালানো হয়েছিল, এরকম একটি তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়ার কারণে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। সরকারি চলচ্চিত্র কেন্দ্র নন্দনে ওই ছবিটি দেখানোর কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে পুলিশের আপত্তিতে তথ্যচিত্রটি দেখানো হচ্ছে না। ‘মুসলমানের কথা’ নামের এই তথ্যচিত্রটি নির্মিত হয় স্বাধীনতার ছয় দশক পর পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কেমন আছেন- তার খোঁজ নিতে। সম্প্রতি ভারতসহ সারা বিশ্বেই প্রতিপালিত হয়ে গেছে বিশ্ব তথ্য অধিকার দিবস। এই দিবস উদযাপনের লক্ষ্যই ছিল বিশ্বের যেকোনো দেশ ও জনগোষ্ঠীর প্রকৃত অবস্থা জানার জাতিসংঘ স্বীকৃত অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান।

ভারতেও এ দিবস উদযাপিত হয়েছে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু দায়সারা আনুষ্ঠানিকতা এক কথা, আর বাস্তব ক্ষেত্রে দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য নিশ্চিত করা অন্য কথা। বাস্তবক্ষেত্রে যদি দিবস পালনের মূল লক্ষ্যই এড়িয়ে যাওয়া হয়, তবে ঘটা করে দিবস উদযাপন করা হয়ে পড়ে শুধু অর্থহীন ও প্রতারণার শামিল। বিশেষ করে ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার দাবিদার দেশের জন্য এটা যে কত বড় স্ববিরোধিতার পরিচায়ক, তা নতুন করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের সমান মর্যাদা ও সমান অধিকার পাওয়ার কথা।

এই মর্যাদা ও এই অধিকার থেকে কোনো কারণে কোনো জনগোষ্ঠী যদি বঞ্চিত হয়, সে বঞ্চনার কারণ খুঁজে বের করে তার প্রতিকারের আন্তরিক চেষ্টা চালানো সেই রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য। স্বাধীনতার ছয় দশক পরও যদি ভারতের একটি রাজ্যের (পশ্চিমবঙ্গ) সংখ্যালঘু মুসলমানরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকেন, তার খোঁজ নিয়ে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব বিবেচিত হওয়ায়ই সে রকম উদ্যাগ নেয়া হয়ে থাকবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এ করতে গেলে যে তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন তারই নিশ্চয়তা ছিল ওই তথ্যচিত্রের মধ্যে। অথচ এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হতে পারেনি পুলিশি হস্তক্ষেপের কারণে। ভারত শুধু বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রই নয়, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হতেই ভারত বিশেষ আগ্রহী।

কিন্তু তার এই আগ্রহের সাথে যদি বাস্তবতার সামঞ্জস্য না থাকে, তার চাইতে দুঃখের কথা কী হতে পারে? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের যে সমান মর্যাদা ও সমান অধিকার থাকার কথা, বাস্তবে যদি তার প্রমাণ না থাকে, তা যেমন দুঃখজনক তেমনি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীর বাস্তব অবস্থার তথ্যচিত্র জানার অধিকার থেকেও যদি জনগণকে বঞ্চিত থাকতে হয়, এ ধরনের রাষ্ট্রের মান সভ্যতার মাপকাঠিতেও অনেক নিচে নেমে যেতে বাধ্য। প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছবিটিতে যেমন গ্রামের সাধারণ মুসলমানদের কথা ও তাদের জীবন চর্চার ছবি ছিল তেমনি ছিল মুসলমান বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক ও বিশ্লেষকদের কথাও। ছবিটি কলকাতা সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্র ও সরকারি চলচ্চিত্র কেন্দ্র নন্দনে দেখানোর আয়োজন করেছিল কেন্দ্রীয় তথ্য ও ফিল্মস ডিভিশন এবং সিনে সেন্ট্রাল সংগঠন। পরিচালক সৌমিত্র দস্তিদার বলেছেন, শেষ মুহূর্তে তাকে জানানো হয়েছে, তথ্যচিত্রটি দেখানো যাচ্ছে না। প্রদর্শনীর অন্যতম আয়োজক কেন্দ্রীয় সরকারের ফিল্মস ডিভিশনের পূর্বাঞ্চলীয় এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘ছবিটির প্রদর্শনী আমরা বন্ধ করিনি।

সেন্সর সার্টিফিকেট না থাকার কারণে পুলিশের পক্ষ থেকে আপত্তি করা হয়েছে। সেজন্যই দেখাতে পারছি না। ’ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ফিল্মস ডিভিশনের পূর্বাঞ্চলীয় এই কর্মকর্তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন জাগে, তবে কি সেন্সর বোর্ডের অনুমতি প্রার্থনা না করেই ছবিটি দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, না সেন্সর বোর্ড এ ছবি দেখানোর অনুমতি না দেয়াতেই এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্রটি প্রদর্শন করা হয়নি? যদি শেষোক্ত বক্তব্য সত্য হয় তা হলে সেন্সর বোর্ড তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। ঘটনা যাই হোক, আসল ব্যাপার সম্ভবত এটাই যে, পশ্চিম বঙ্গে মুসলমানদের অবস্থা স্বাধীনতার ছয় দশক পরও উন্নত তো হয়ইনি বরং বহু ক্ষেত্রে অতীতের তুলনায় আরও খারাপ হয়ে পড়েছে এবং কাক্সিক্ষত তথ্যচিত্রে তার খানিকটা প্রকাশ হয়ে পড়ায় পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ও ফিল্ম সেন্সর বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ এ তথ্যচিত্রটি প্রদর্শিত হওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। কারণ তারা সবাই ভেতরে ভেতর মুসলিম বিদ্বেষী সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা রোগে আক্রান্ত হলেও নিজেদের গণতান্ত্রিক ও উদার ভাবমূর্তি প্রকাশ্যে কলুষিত হতে দিতে চান না।

কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এভাবে তারা আর কতদিন নিজেদের এ কদর্য মানসিকতা লুকিয়ে রাখবেন? পৃথিবীর যে কোনো দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভালোমন্দ অনেকটাই নির্ভর করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মন-মানসিকতার ওপর। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মন-মানসিকতা উদার ও মানবিক গুণসম্পন্ন হলে সংশ্লিষ্ট দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত থাকে। উপমহাদেশের জনসাধারণের দুর্ভাগ্য এই যে, ভারতীয় উপমহাদেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যে সে গুণটার মারাত্মক অভাব হওয়ার ফলে ব্রিটিশ শাসনের অবসানে তারা এক অভিন্ন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারেনি। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব এই প্রেক্ষাপটেই এদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের বাস্তব মাইল ফলক হিসেবে প্রমাণিত হয়। তবে এই লাহোর প্রস্তাবে শুধু উপমহাদেশকে হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত একাধিক অঞ্চলে বিভক্ত করার ব্যবস্থাই ছিল না, প্রতিটি রাষ্ট্রীয় ইউনিটে সংখ্যালঘুদের জীবন-জীবিকাসহ যাবতীয় মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথাও জোর দিয়ে বলা হয়েছিল।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পরবর্তী মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাসমূহ নিয়ে গঠিত পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার মোটামুটি নিশ্চিত করা হলেও হিন্দু অধ্যুষিত ভারতে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার বহুতর ক্ষেত্রেই অপূরিত থেকে যায়। স্বাধীনতার ছয় দশক পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে প্রণীত ‘মুসলমানের কথা’ এর সর্বশেষ দলিল। এই তথ্যচিত্রটি যারা তৈরি করেন, তাদের লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার ছয় দশক পর ভারতীয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে খোঁজ নিয়ে সেই অবস্থা থেকে তাদের উত্তরণের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু এই তথ্যচিত্র প্রকাশের ব্যাপারে পুলিশ, সেন্সর বোর্ড প্রভৃতি সরকারি সংস্থার আচরণ দেখে মনে হয়, সংখ্যালঘু মুসলানদের দুরবস্থার প্রতিকার তো দূরের কথা, তারা স্বাধীনতার ছয় দশক পরও যে বৈষম্য ও অবিচারের শিকার হয়ে আছে সেই তথ্যটুকুও ধামাচাপা দিয়ে চায়। মজার ব্যাপার এই যে, ভারতীয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের যে সব নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তারা সবাই আমাদের মতো বাংলাভাষী এবং বাঙালি হিসেবে ওপার বাংলার হয়ে এপার বাংলার বাঙালিদের প্রায় প্রায়ই বাঙালিয়ানার সবক দিতে কসুর করেন না।

এ ব্যাপারে তাদের অতি উৎসাহের একটা বড় কারণ এই যে, এপার বাংলার কিছু হীনমন্যতাগ্রস্ত বাঙালির মধ্যেও পশ্চিমবঙ্গের ওই সব বাঙালিকে বাঙালিত্বের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ বিবেচনার ভূত ঘাড়ে চেপে আছে বহু দিন থেকেই। বিশেষ করে উনিশশ’ একাত্তরে আমাদের জনগণ যখন পিন্ডির শাসন ছিন্ন করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, তখন প্রতিবেশী দেশের বেতার থেকে জনৈক দেবদুলালের কণ্ঠে এপার বাংলার সে সংগ্রামের প্রতি যেভাবে আবেগমথিত সমর্থন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে পড়ছিল, তাতে এদেশের অনেকের মনেই একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল যে, পিন্ডির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমরা যেমন স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করতে চাই, তারাও সম্ভবত দিল্লির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে পশ্চিমবঙ্গকে একটি স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্রে পরিণত করতে উৎসাহী। এই ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা উত্তর দেয়- ভাষা হিসেবে তারা বাঙালি হলেও রাষ্ট্র হিসেবে তারা ভারতীয় নাগরিক এবং তারা ভারতীয় থাকতেই অধিক পছন্দ করে । অর্থাৎ তারা ভাষার নিরিখে বাঙালি হলেও অহিন্দু বাঙ্গালীদের সাথে মিলে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অবাঙ্গালী হিন্দুদের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হতেই বেশী পছন্দ করেন। বাঙালি হিন্দুদের সিংহভাগ কখনও শুধু বাঙালিদের নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেনি।

বাঙালি মুসলমান তরুণরাই শুধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রাণ দেয়নি, তাদের নিজেদের হাতে গড়া পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও প্রতিষ্ঠা করেছে। এরপরও যদি ওপার বাংলার হিন্দুদের মানসিকতা সম্পর্কে আমাদের দেশের এক শ্রেণীর হীনমন্যতাগ্রস্ত বাঙালিদের মোহভঙ্গ না হয় তবে তাদের মোহভঙ্গের জন্য সম্ভবত আরও বড় ধরনের বিপর্যয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। - Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.