আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চট্টগ্রামে আসামিদের জন্য ‘অবাধ সুযোগ’

চট্টগ্রাম আদালত ভবনের নিচের তলা। চুরির মামলার দুই আসামি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মহানগর পুলিশ কনস্টেবল তাজুল ইসলাম। আসামিদের হাতকড়ার রশি তাঁর বাঁ হাতে ধরা। এক আসামি মুঠোফোনে কথা বলছেন।
গত বৃহস্পতিবার বেলা দেড়টায় এ দৃশ্য ধরা পড়ে।

ছবি তুলতে গেলেই কনস্টেবল তাজুল ফোনটি কেড়ে নিয়ে আসামিদের গালিগালাজ শুরু করেন।
চারতলায় উঠে পাওয়া গেল অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি তসলিম উদ্দিন ওরফে মন্টুকে। চারতলায় পশ্চিম পাশের সিঁড়ির কোণে বসে বাসা থেকে আসা খাবার খাচ্ছেন তিনি। পাশে তাঁর বোন। তসলিম বিচারাধীন আরও ২২ মামলার আসামি।

দুর্ধর্ষ আসামিকে এমন বেআইনি সুযোগ দিয়ে সামনেই নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত জেলা পুলিশের সদস্য ইউসুফ আলী।

শুধু এই তিনজনই নন, অন্য আসামিরাও চট্টগ্রাম কারাগার থেকে আদালত চত্বরে এসে এমন ‘অবাধ সুযোগ’ পাচ্ছেন। এঁদের কেউ অবাধে ল্যাপটপ বা আধুনিক ট্যাব ব্যবহার করেন, কেউ মুঠোফোন হাতে নিয়ে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। এভাবে তাঁরা প্রতিপক্ষকে হুমকি দিচ্ছেন, চাঁদাবাজিও করছেন। কেউ কেউ আদালত চত্বরে আড্ডা জমিয়ে ফেলেন সবার চোখের সামনে।

মাদক সেবনের অভিযোগ তো আছেই। চট্টগ্রাম কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক ছগির মিয়া এসব অভিযোগের কথা স্বীকার করে বলেন, ‘আদালত থেকে বন্দীরা কারাগারে ফেরত আসার পর কখনো কখনো কাউকে কাউকে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দেখা যায়। এটি খুবই ব্রিবতকর। এ নিয়ে আমরা অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু কাজ হয়নি।

’খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, মহানগর ও জেলার বিভিন্ন থানা থেকে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। নিয়ম অনুসারে এঁদের হাজতখানার ভেতরে তালাবদ্ধ করে রাখার কথা। কিন্তু দুই দিন আদালত এলাকা ঘুরে দেখা গেল, কিছু আসামি হাজতের ভেতরে থাকলেও অনেকেই আছেন হাজতের বাইরে। হাজতের পেছনের একটি বড় বারান্দায় অবাধে বসে-দাঁড়িয়ে গল্প করছেন তাঁরা।

হাজতের আসামি এভাবে বাইরে রাখা হয় কেন? জানতে চাই পুলিশের এক সদস্যের কাছে।

তিনি জবাব দেওয়ার আগেই পাশে দাঁড়ানো আদালতের এক কর্মচারী তাঁর মুখের কথা কেড়ে নেন। বলেন, সরোয়ার ও ম্যাক্সন থাকলে দেখতেন তাঁরা কী করেন! তাঁর মুখে শোনা গেল, এই দুই দুর্ধর্ষ আসামি ভারতের কারাগারে আটক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সাজ্জাত আলী খানের প্রধান সহযোগী। দুজনের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি, অস্ত্র, অপহরণের ২০টি করে ৪০টি মামলা আছে। এসব মামলায় তাঁরা প্রতি সপ্তাহে একবার করে আদালতে হাজিরা দিতে আসেন। সকালে কারাগার থেকে এসে দুপুরের মধ্যে মামলার শুনানি শেষ হলেও বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরোলেও কারাগারে নেওয়া হয় না।

কারাগার থেকে সরাসরি হাজতখানায় আসার নিয়ম হলেও তাঁরা হাজতখানায় না গিয়ে আদালতের বারান্দায় বসে মুঠোফোনে কথোপকথনে মেতে ওঠেন।

আরেক যুবক অভিযোগ করেন, এই দুই সন্ত্রাসী আদালত চত্বরে বসেই মুঠোফোনে চাঁদাবাজি করেন আর সহযোগীদের নির্দেশ দেন। এ ছাড়া তাঁরা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। তাঁরা প্রকাশ্যে মাদকও সেবন করেন আদালত চত্বরে বসেই। কথোপকথন শুনে এগিয়ে আসেন এক তরুণ আইনজীবী।

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি বলেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজিরা দিতে এসেছিলেন চট্টগ্রামের শীর্ষ সন্ত্রাসী বিধান বড়ুয়া। সকালে কারাগার থেকে আসার পর প্রথমে বারান্দায় বসে মুঠোফোনে কথা বলেন। আদালতে হাজিরা দিয়ে হাজতখানায় না গিয়ে চলে যান পেছনের বারান্দায়। সেখানে আগে থেকেই এক তরুণী বসে ছিলেন। তাঁরা বেশ ঘনিষ্ঠ সময় কাটান।

এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন শাহ আলম নামের পুলিশের এক কনস্টেবল ও এক আইনজীবীর সহযোগী সুমন। এভাবে বন্দীদের বেআইনি সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা কোর্ট পরিদর্শক উনু মং প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যতটুকু পারি দেখি, দিনে দু-তিনবার চেক করি। তবে পেছনের বারান্দা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। ’সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী শিবিরের ক্যাডার নাছির, তছলিম উদ্দিন মন্টু এবং বিএনপির নেতা জামাল উদ্দিন অপহরণ ও হত্যা মামলার আসামি শহীদ চেয়ারম্যান, আলম ডাকাত, সন্ত্রাসী কানা মান্নান, ছাত্রলীগের ক্যাডার শামীম, দীপক দত্ত ভোলাসহ শতাধিক সন্ত্রাসী আদালতে হাজিরা দিতে এলেই বেপরোয়া আচরণ করেন। তাঁরা সকালে আদালত চত্বরে আসেন, ফিরে যান সন্ধ্যায়।


কারাধ্যক্ষ রফিকুল কাদের বলেন, সকালে আসামিকে হাজিরা দিতে পাঠালে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলেও ফিরে আসেন না। বন্দীরা বাইরে থাকায় কারাগারে লকআপ করতে সমস্যা হয়। অথচ আদালত থেকে কারাগারের দূরত্ব খুব বেশি নয়।
আদালতে আসা হাজতি ও কয়েদিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক কয়েদি কিছুদিন আগে গাঁজা সেবন করে কারাগারে যান। বেশি মাত্রায় সেবনের কারণে কারাগারের ফটকে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

প্রথম আলোর কাছে কারা কর্তৃপক্ষ এ ঘটনা স্বীকার করে কারা হাসপাতালের চিকিৎসক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হাজিরা দিতে গিয়ে বন্দীরা পুলিশের সাহায্যে নেশা করেন। অনেক সময় বন্দীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ওয়ার্ডে পাঠাতে হয়।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (প্রসিকিউশন) এস এম নুরুল হুদা বলেন, ‘এসব যাতে না হয়, সে জন্য পুলিশকে সতর্ক করা হয়েছে। আমরা আরও কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। ’

গত মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বন্দীদের এসব অবৈধ সুযোগ দেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্ধারিত টাকা দিতে হয়।

যেমন খাওয়ার জন্য দিতে হয় ৫০০ টাকা, মুঠোফোনে কথা বলার জন্য জনপ্রতি এক হাজার, হাজতের বাইরে বসার জন্য দুই হাজার টাকা, সারা দিন বারান্দায় বসার জন্য দিতে হয় দুই থেকে আট হাজার টাকা। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি সাধারণ আসামিরাও এ সুযোগ নিয়ে থাকেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা হাজতখানার পেছনে দেখা গেল, একটি বিশাল বারান্দায় চারটি চৌকি বসানো আছে। চাইলে সেখান থেকে লাফ দিয়ে যেকোনো বন্দী পালিয়ে যেতে পারেন। এক বছর আগে নগরের ডবলমুরিং থানার আসামি নুরুল আবছার এই পথ দিয়েই পালিয়ে যান।

সপ্তাহখানেক পর পুলিশ তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করে।
আদালতে আসার পর একজন বন্দী কী কী সুবিধা পান, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে হাজতখানায় আনা আসামির স্বজন ও সহযোগীদের সঙ্গে দেখা করার কোনো বিধান নেই। বাইরের খাবার খাওয়ার নিয়ম নেই। বাইরের খাবার খেয়ে কোনো আসামির মৃত্যু কিংবা অসুস্থ হয়ে পড়লে পুলিশই দায়ী থাকবে। কিন্তু কারাবিধি লঙ্ঘন করে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে পুলিশ এ অবৈধ সুযোগ দিচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সমিতির গত সভায় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখছি না। ’

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.