আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রামপাল বিদ্যৎ প্রকল্প: পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে রামপাল উপজেলায় একটি কয়লা ভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (BPDB) এবং ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি লিমিটেড (NTPC) এর এই জয়েন্ট ভেঞ্চারটির নামকরণ করা হয়েছে “বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি”। দেশের বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা চিন্তা করলে এই উদ্যোগটা স্বস্তি এনে দেওয়ার কথা, কিন্তু এটা জন্ম দিচ্ছে নানা রকম বিতর্কের। যদিও বিতর্কের সূত্রপাত প্রকল্পের সুন্দরবনের নিকটবর্তী অবস্থান থেকে, আনুষাঙ্গিক ডালপালা গজিয়ে এখন এটি ডান বনাম বাম, ভারতীয় আগ্রাসন এবং বিচিত্র সব ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মহীরুহে পরিণত হয়েছে। এই লেখাটা মূলত অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিচের বিষয়গুলো নিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছে:
১. অনবায়নযোগ্য সম্পদের ব্যবহার ও বাংলাদেশ: দর্শনগত সমস্যা ২. বিদ্যুতের চাহিদা, যোগান ও বাজার অর্থনীতি ৩. পরিবেশগত ঝুঁকি, দূষণের আর্থিক হিসাব ও EIA রিপোর্টের ব্যর্থতা ৪. বিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎস নির্বাচন: কয়লার বিকল্প ৫. বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য স্থান নির্বাচন: রামপালের বিকল্প
১. অনবায়নযোগ্য সম্পদের ব্যবহার ও বাংলাদেশ: দর্শনগত সমস্যা
বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ সরকার মূলত গ্যাসের উপর নির্ভরশীল ছিল (প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ)।

কিন্তু গ্যাসের সঞ্চয় হিসাবকৃত পরিমাণের চেয়ে কম থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে যায়। বিপর্যয় সামাল দিতে কুইক রেন্টাল পদ্ধতিসহ বিদ্যুৎ আমদানীর আরো নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহের দাম বৃদ্ধি পায়। আর দুইদিক সামাল দিতে গিয়ে সরকার বাধ্য হয় বিরাট অংকের জ্বালানী ভর্তুকি দিতে। বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সরকারী পদক্ষেপগুলো প্রশ্নবিদ্ধ, বিতর্কিত এবং মোটেই ব্যয়সাশ্রয়ী নয়।


রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র আবারো এই অভিযোগগুলোকে উস্কে তুলে। এক্ষেত্রে সরকারের ঘোষিত নীতির সাথে কার্যক্রমের অমিল লক্ষ্যণীয়। ২০০৮ সালে প্রকাশিত Renewable energy policy of Bangladesh এ উল্লেখ করা হয় “Policy sets targets for developing renewable energy resources to meet five percent of the total power demand by 2015 and ten percent by 2020” । অথচ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগ্রাধিকার পায় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষেত্র! তাও যার অবস্থান সুন্দরবনের কাছে! বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছ থেকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানীর বিষয়ে প্রতিশ্রুতি শোনা যায় কিন্তু বিনিয়োগের সময় এই ব্যাপারে তৎপরতা দেখা যায় না।
অনবায়নযোগ্য সম্পদের পরিমাণ সীমিত।

যদিও নতুন প্রযুক্তি শক্তির ব্যবহারযোগ্যতা ও যন্ত্রপাতির কর্মদক্ষতা বাড়ায়, উৎপাদনের উৎস হিসেবে কয়লা ও গ্যাসের উপর অতিনির্ভরশীলতা দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর। বাংলাদেশের Power system master plan 2010 এর লক্ষ্য হল কয়লাভিত্তিক তিনটি মেগা পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন এবং একই সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানো। কিন্তু এই দুইটি ভিন্নমুখী লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা যথারীতি অনুপস্থিত। একইভাবে জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি এবং PSMP তে ২০৩০ নাগাদ মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০ ভাগ উৎস হিসেবে কয়লাকে চিহ্নিত করা সংঘাতপূর্ণ।
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবয়ানযোগ্য সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার করা উচিত, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের আগ্রহ দ্রুত মুনাফা অর্জন ও চলমান সমস্যার স্বল্পমেয়াদী সমাধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিষয়ে সরকারের প্রেসনোটসহ অন্যান্য বক্তব্য মূলত এই ধারণারই প্রতিফলন। নীতিনির্ধারকদের ক্ষীণদৃষ্টি দেশের জ্বালানীশক্তির ভবিষ্যতের জন্য রীতিমত হুমকি স্বরূপ।
২. বিদ্যুতের চাহিদা, যোগান ও বাজার অর্থনীতি
বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা প্রতি বছর প্রায় শতকরা দশভাগ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বৃদ্ধির হার সরলরৈখিক (linear) নয়, বরং এক্সপোনেনশিয়াল। যেখানে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন মাত্র 272 KW (২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের সর্বনিম্ন উৎপাদনক্ষম দেশগুলোর একটি হল বাংলাদেশ)

উৎস: Power system master plan 2010
দেশের বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে এরকম সংকটময় পরিস্থিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির বিকল্প নাই।

কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও সত্যি সরকারের বিনিয়োগ কেবল উৎপাদনমুখী হলে তা দীর্ঘমেয়াদে উদ্ভুত সংকটের সামাল দিতে পারবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা হল সরবরাহসহ নানাবিধ লস ও পাওয়ার গ্রিড ফেইলিওর। ২০১০ ও ২০১১ অর্থবছরে এই লস + ফেইলিওরের তুলনা করলে বোঝা যায় পরিস্থিতির ভয়াবহতা:

উৎস: BPDB annual report 2010-2011
এছাড়াও বিদ্যুৎ বোর্ডের দাপ্তরিক অদক্ষতা, ব্যবস্থাপনার ব্যয়বহুলতা সরকারী রাজস্বের এফিশিয়েন্ট ব্যবহার নয়। বিষয়টা ঠিক অভিযোগ নয় বরং দক্ষতা প্রশ্নে সরকারের চেয়ে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কোম্পানি সমূহ স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে। কিন্তু সরবরাহ প্রশ্নে সরকার economies of scale এর সুবাদে বাড়তি সুবিধা পায়।

এক্ষেত্রে একটি সমাধান হতে পারে উৎপাদন প্রক্রিয়ার কিছু অংশ প্রাইভেটাইজ করা, পাওয়ার বোর্ডকে ডিসেন্ট্রালাইজ করা কিন্তু একই সাথে রেগুলেশান বাড়ানো। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন কোম্পানর সাথে বিল পরিশোধ ও বকেয়া বিল আদায়ের দাপ্তরিক দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া উচিত। এই ধরনের প্রক্রিয়া সাধারণভাবে ছোট মনে হলেও এফিশিয়েন্সি প্রশ্ন দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। কাজেই বর্তমান আর্থিক ক্ষমতার ভিত্তিতে সমাধান কৌশল স্রেফ উৎপাদনে বিনিয়োগ নয়, বরং অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার হওয়া উচিত।

Simplified reference energy system of Bangladesh power sector (Values shown indicate conversion and transmission efficiency and electricity demand in 2010)
Source: Deployment of renewable energy technologies in Bangladesh: Long-term policy implications in power sector by Md. Alam Hossain Mondala, Manfred Denichc, Toufic Mezhera
৩. পরিবেশগত ঝুঁকি, দূষণের আর্থিক হিসাব ও EIA রিপোর্টের ব্যর্থতা
Environment Conservation Rule (1997) অনুযায়ী এই প্রকল্পটি Class D ক্যাটেগরির অন্তর্ভুক্ত।

এই Class D বা রেড জোনের অন্তর্গত হওয়াতে প্রকল্পটির Environmental Clearance Certificate পাওয়া আবশ্যক। Environmental Impact Assesment (EIA) রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে প্রকল্পটি ২০১৩ সালের ১ অগাস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এই ছাড়পত্র পায়। বাংলাদেশের Center for Environmental and Geographic Information Services (CEGIS)তাদের গবেষণা শেষে জানুয়ারি ২০১৩ সালে EIA রিপোর্টটি প্রকাশ করে।
প্রতিবেদনের গবেষণা ক্ষেত্র বাছাই করা হয়েছে প্রকল্পের চারপাশে ১০ কিমি ব্যাসার্ধের কাল্পনিক বৃত্ত এবং সেইসাথে পশুর ও শিবসা নদী তীরের উভয়পাশ মিলিয়ে মোট ২০কিমি অঞ্চল।


তথ্যবহুল EIA রিপোর্ট আলাদা পাঠ-প্রতিক্রিয়া দাবী করে।

কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে এখানে মূল সীমাবদ্ধতাগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরছি:
(ক) প্রকল্পের অর্থায়ন, প্রকৃত ব্যয় ও প্রাপ্তির হিসাব
EIA প্রতিবেদনের ১৪ নম্বর অধ্যায়ে cost-benefit analysis এর বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। মাত্র ১০ পৃষ্ঠার (পৃ ৩৯৯ থেকে ৪০৯) এই অধ্যায়, যা কিনা মূল প্রতিবেদনের মাত্র ২.৫%, মূলত NTPC কর্তৃক ২০১২ সালে প্রকাশিত feasibility study এরই সারাংশ। তাদের হিসাব অনুযায়ী প্রকল্পটির সম্পূর্ণ খরচ (cost) পড়বে ২,৮৬৫,৯৯৬.৬ মিলিয়ন টাকা এবং অনুমিত প্রাপ্তি (benefit) ৩,৩৩৭,৬৭৮.৮ মিলিয়ন টাকা যা কিনা আগামী ২৫ বছর ধরে বন্টন হবে। কাগজে-কলমে প্রাপ্তির অংক নেহাত কম না, কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী বেশ কিছু ক্ষেত্রে হিসাব পরিষ্কার না।
প্রতিবেদনের ৪০২ নং পৃষ্ঠায় Assessment of the externalities এর কথা উল্লেখ করা আছে কিন্তু negative externality এর পরিমাপের কোন হিসাব নেই।

Assessmet এর বদলে Identification শব্দটি ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত হত কারণ পরিবেশের সম্ভাব্য ক্ষতির কোন আর্থিক হিসাব এই অধ্যায়ে একেবারেই অনুপস্থিত।
৪০৪ নং পৃষ্ঠায় এই সীমাবদ্ধতার কথা আংশিক স্বীকার করা হয়েছে এইভাবে – “Monetary valuation is generally difficult for ecosystems, including forest damages. A number of effects including neonatal mortality, morbidity,.. … Moreover valuation of environmental externalities is very difficult considering its multidimensional aspects like determination of statistical life loss, willingness to pay for developing countries etc. Therefore, this report has the limitation in valuation of the intangible variables into monetary terms.”
এই স্বীকারোক্তি প্রশ্ন তুলে – যদি টাকার অংকে হিসাব করা নাই যায়, তাহলে cost-benefit analysis এর ratio কিভাবে গণনা করা হল? এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে উত্থাপিত যুক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল পরিবেশ ও সামাজিক ক্ষতি যা বাদ দেওয়া মানে হল খরচ (cost) কে কম দেখানো (undervaluation) EIA এর রিপোর্টে বিস্তারিত অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ আশা করি না, কিন্তু অর্থনীতির বিভিন্ন টার্মের ভুল ব্যাখ্যা হিসাবগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পরিবেশ অর্থনীতি কোর্সের ১০১ – willingness to pay নয়, এক্ষেত্রে প্রযোজ্য willingness to accept (আলোচনা একটু জার্গন নির্ভর হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ: পরিবেশ অর্থনীতির একটি বিশেষ শাখা আছে – non-market valuation যেখানে মূলত বিভিন্নভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব হিসাব করা হয়। হিসাব করার অনেকগুলো টুল আছে, এর মাঝে একটি হল willingness to accept, যা অনেকটা ক্ষতিপূরণ জাতীয় ধারণা। উইকি এন্ট্রি একে এভাবে সংজ্ঞায়িত করে - Willingness to accept (WTA) is the amount that а person is willing to accept to abandon a good or to put up with something negative, such as pollution.)
আরো কিছু খুঁটিনাটি -
ক্ষয় (depreciation cost): এই প্রকল্পের টেকনিকাল ব্যবস্থাপনার জন্য যে খরচ ধরা হয়েছে, সেখানে যন্ত্রপাতির depreciation বা ক্ষয়ের হার কিভাবে গণনা করা হয়েছে? রামপাল এলাকার জল ও বাতাসের লবণাক্ততা অন্যান্য সমতল এলাকার চেয়ে বেশি।

অনুমান করে নিতে পারি এজন্য depreciation rate এর যে তারতম্য তা কিভাবে হিসাব করা হল? আদৌ হল কি?
Opportunity cost: যেমন – অধিকৃত জমির opportunity cost (value of BEST alternative forgone) হিসাব করতে গেলে তা হারানো কৃষি উৎপাদনের বর্তমান বাজার মূল্য বোঝায় না। ঐ জমিকে যতভাবে ব্যবহার করা যায় তার মাঝে যে ব্যবহারটি সবচেয়ে বেশি আর্থিক বিনিয়োগ লাভ দিবে তার বর্তমান বাজার মূল্য বোঝায়। EIA report এর পৃষ্ঠা ৪০৬ এ সংজ্ঞায় এ স্বীকরোক্তি থাকলেও financial ও economic analysis এ কিভাবে তা হিসাব করা হল এ ব্যাপারে কোন উল্লেখ নেই। বরং অধিকৃত জমির ফসলী ও চিংড়ি চাষের কথা বার বার উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রাপ্তি: বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে নানারকম স্থানীয় শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি ঐসব শিল্প দূষণের মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়।

এছাড়া লোকালয় স্থাপন যে বাফার জোনকে ব্যহত করবে। ফরওয়ার্ড লিংকেজের হিসাবের কথাও টাকার অংকে উল্লেখ করা হয় নি। ৪০৭ নং পৃষ্ঠায় 14.9.2 অনুচ্ছেদে socio-economic benefit এর মাঝে Aesthic Resource এর উল্লেখ এক ধরনের রসিকতা। রিপোর্টে দাবী করা হয়েছে planned industrial area, green belt development ইত্যাদি দৃষ্টিসুখের সুযোগ করে দিবে! আশা করি সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে দেশের প্রাকৃতিক বন উজাড় করে ইউক্যালিপ্টাস, আকাশমণি লাগানোর স্মৃতি মুছে যায় নি।
(খ) EIA রিপোর্ট বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকি ও দূষণের তালিকা তৈরি করেছে কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এগুলোর সম্ভাব্যতা যাচাই করে নাই


অথচ উপকূলবর্তী রামপাল, পশুর নদী বিভিন্ন সময়ে ঘূর্নিঝড় প্রত্যক্ষ করেছে।

এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ে কয়লাবাহী কার্গো ডুবে গেলে তার ক্ষতির দায়ভার কে নেবে তা পরিষ্কার না। আর্থিক ক্ষতিপূরণই বা আদৌ আদায় হবে কিনা তাও প্রশ্নবিদ্ধ (টেংরাটিলা ও মাগুরছড়া দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের কি হাল?)
৪. বিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎস নির্বাচন: কয়লার বিকল্প
BPDB এর ২০১০-১১ অর্থ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের সামগ্রিক চিত্রটি এইরকম:



পরিবেশ রক্ষার্থে অনেকেই কয়লার ব্যবহার সমর্থন করেন না এবং বিকল্প হিসেবে সৌরশক্তি, জলবিদ্যুৎ শক্তি, বায়ুশক্তি এবং জৈব বর্জ্যের কথা উল্লেখ করেন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এগুলোর কোনটাই বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদনের যা খরচ তাতে সরকারকে উল্টো আরো অনেক টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। একটা তুলনামূলক আলোচনা করে দেখি বিদ্যুৎ শক্তির উৎস হিসেবে কয়লার বিকল্প পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিগুলোর কী অবস্থা:
কাপ্তাইয়ের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সর্বোচ্চ উত্পাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি।

এই অংকটি বর্ষা মৌসুমে যখন পাঁচটি ইউনিট কার্যক্ষম থাকে তখনকার হিসেব। পরিবেশ লোকালয়ের ক্ষতি করে বিপুল অর্থব্যয়ে নির্মিত এই প্রকল্প মূলত সরকারী অদক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কিন্তু sunk cost এড়াতে এই প্রকল্প বন্ধ করা সরকারের জন্য লাভজনক নয়। বরং এর টারবাইন মেরামত করা, নতুন ইউনিট বসানো এবং এলিভেশন বিষয়ক গবেষণা করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যায় কিনা তা দেখা দরকার। মাতামুহুরী (140 MW) ও সাঙ্গুতে (75 MW) জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা এখন কোন পর্যায়ে তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

আপাতদৃষ্টিতে এই তিনটি প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলেও তা সম্মিলিতভাবে 500 MW ও উৎপাদন করতে পারছে না। এছাড়া বাঁধ নির্মাণ পরিবেশের উপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
বায়ুশক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বেশ কিছু সম্ভাবনা আছে। বর্তমানে দেশে বায়ু বিদ্যুৎ স্থাপনা সমুহের বিবরণ:

তাত্ত্বিকভাবে বায়ুশক্তির উৎপাদনের জন্য উপকূলবর্তী এলাকাসমূহ পর্যাপ্ত বায়ুপ্রবাহ নিশ্চিত করতে পারে (চিত্র: )

Source: Assessment of renewable energy resources potential for electricity generation in Bangladesh by Md. Alam Hossain Mondal and Manfred Denich
কিন্তু বায়ুশক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পরে যা এই পদ্ধতিকে আরো ব্যয়বহুল করে তোলে। এক্ষেত্রে বিকল্প সমাধান হতে পারে - অফশোর উইন্ড টারবাইন স্থাপন।

ইউরোপের বেশ কিছু দেশ এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। কিন্তু এই পদ্ধতিও অত্যন্ত ব্যয় বহুল। US energy information and Administration অনুযায়ী প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ তুলনা করলে এটি সবচেয়ে ব্যয়বহুল টেকনোলজি। উল্লেখ্য যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অফশোর উইন্ড ফার্ম [url=Source: http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_offshore_wind_farms]লন্ডন অ্যারের উৎপাদন ক্ষমতা 630 MW [/url]
সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য মূলত প্রান্তিক জনপদে গৃহস্থালী পর্যায়ে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০০২ সালে গ্রামীণ এলাকায় সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করত মোটে ৭,০০০ পরিবার যা ২০১২ সাল নাগাদ দাঁড়ায় ১.৪ মিলিয়নে।

অতি সম্প্রতি সৌরশক্তির প্রসারে বিশ্বব্যাংকের আরো ১০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান লাভ করে বাংলাদেশ। কিন্তু এসবই মূলত গৃহস্থালী পর্যায়ে যার পরিমাণ 20.75 MW (অনুমিত)। শিল্পক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের পরিমাণ অতি অতি নগণ্য।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা একটি সাশ্রয়ী সমাধান, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদী লাভের জন্য সরকারের উচিৎ সমন্বিত শক্তির একটি পরিকল্পনা করা। প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার খরচ (পরিবেশ ও সামাজিক ক্ষতি হিসাব করে) যদি অন্যান্য উৎসের চেয়ে কম হয় কেবল মাত্র তখনি কয়লার ব্যবহার অর্থনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে।

এক্ষেত্রে সমস্যা হল পরিবেশ দূষণের আর্থিক ক্ষতি হিসাব করা।
৫. বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য স্থান নির্বাচন: রামপালের বিকল্প
রামপাল প্রকল্পের পক্ষ সমর্থন করে অনেকেই একটা প্রশ্ন করেন, “বিদ্যুৎ প্রকল্পের মত গুরুত্বপূর্ণ একটা স্থাপনা কোথাও না কোথাও তো হতে হবে। রাম্পালে না হলে আর কোথায় হতে পারে সেটা?” তাৎক্ষণিকভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা সম্ভব না, উচিৎ ও না।
প্রথমত, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটা যারা রামপাল প্রকল্পের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরছেন তাদের জন্য আবশ্যিক না। এরকম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে Take it or leave it জাতীয় অপশান ছেলেমানুষী ধরনের যুক্তি।


দ্বিতীয়ত, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন যা মূলত সরকারের বা এ জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের গবেষণার বিষয় হওয়া উচিত। দেশের এনার্জি বোর্ডের উচিত একটা Baseline GIS Archive তৈরি করা যেখানে প্রয়োজনীয় ভ্যারিয়েবলগুলোর তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা যায়। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ ধরনের প্রকল্পের সম্ভাব্য অবস্থান নির্বাচন করা উচিত। মূল ধাপগুলো এরকম হতে পারে
ধাপ ১ অঞ্চলভিত্তিক ভৌগোলিক ডেটাবেইজ তৈরি (দেশে GIS data এর বিশাল আর্কাইভ বর্তমানে আছে, সমন্বয়ের মাধ্যমে সামগ্রিক ও তুলনামূলক চিত্রগুলো বিশ্লেষণের উপযোগী করে তুলতে হবে)।
ধাপ ২ ডেমোগ্রাফিক ডেটা (জনসংখ্যার ঘনত্ব, বসতি, জীবিকা ও শ্রমের ধরন), জীববৈচিত্র, প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের উপস্থিতি/সম্ভাবনা, ঐতিহাসিক স্থাপনা, প্রাকৃতিক পরিবেশ বিষয়ক ইনডেক্স (বায়ু, পানি, ভূমির গুণ (quality), আবহাওয়া, বাতাসের গতি-প্রকৃতি) ইত্যাদি ডেটাগুলোকে GIS ডেটার সাথে সংযোগ স্থাপন (link) করতে হবে।


ধাপ ৩ বিদ্যুতের আঞ্চলিক চাহিদা ও গ্রিডভিত্তিক বিতড়নের সম্ভাব্য উপায় সমূহ বিশ্লেষণ। দেখতে হবে প্রকল্পের অবস্থান কিভাবে বিদ্যুৎ বিতড়নের খরচকে প্রভাবিত করে (যাতে কম খরচের সুযোগ, least cost option, গ্রহণ করা যায়)। উৎপাদনের কাঁচামালের উৎসের দূরত্ব (আমদানী করা হলে নিকটবর্তী বন্দর/ঘাঁটির দূরত্ব) জাতীয় চলকগুলো এ পর্যায়ে বিবেচনায় আনতে হবে।
ধাপ ৪ সম্ভাব্য ঝুঁকি নিরূপণ এখানে এসে বিশ্লেষণগুলো একটু সাবজেক্টিভ হয়ে যায়। হিস্টোরিকাল ডেটার অভাবে অনেক প্রকল্পের সত্যিকারের ঝুঁকি সম্পর্কে খুব কম আন্দাজ পাওয়া যায়।

অন্তত সিমুলেশান রান করে দূষণের মাত্রা যাচাই করা উচিত।
ধাপ ৫ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য অবস্থানগুলোকে চিহ্নিত করা। পরিবেশ ও জনসাধারনের উপর প্রকল্পের প্রভাব (Environmental Impact Assessment, Social Impact Assessment) জাতীয় স্টাডিগুলো এইধাপে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রক্কল্পের অবস্থান যাচাই তো আসলে একটা ফাংশান যা নির্ভর করছে প্রাকৃতিক চলকগুলোর উপর। এই ফাংশানের সীমাবদ্ধতাগুলোর মাঝে একটি হল সম্পদের অপ্রতুলতা।

প্রকল্পের অবশ্যই একটা বাজেট এবং সময়সীমা আছে। এই বাজেট ও সময়সীমার ভিত্তিতে ফাংশানকে অপ্টিমাইজ করলে তবেই পাওয়া যাবে রামপালের সম্ভাব্য বিকল্প অবস্থান। আগ্রহীরা Geographically weighted regression (GWR) টুল জাতীয় এন্ট্রিগুলো দেখতে পারেন। এই এক্সেরসাইজটা শুধু রামপাল না, সব ধরনের খনি, ইপিজেড ইত্যাদি স্থাপনার ক্ষেত্রে করা উচিত। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এগুলো খুব তাত্ত্বিক-কঠিন কাজ কিন্তু এনার্জি সেক্টরে এ ধরনের প্রাক-প্রকল্প গবেষণা প্রায় ফরজ।

চট করে বলুন তো দেখি – রামপালে না হলে আর কোথায় হতে পারে এমন প্রশ্ন হাস্যকর।
রাষ্ট্র ও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক লক্ষ্য এক নয়, হওয়া উচিতও নয়। রাষ্ট্রের ভূমিকা হওয়া উচিত কল্যাণমুখী। সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণকে অবহেলা করা মূলত দীর্ঘ মেয়াদে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থানকে স্থানচ্যুত করার নামান্তর। রামপাল প্রকল্পে প্রাপ্তিযোগের হাতছানি আশাব্যঞ্জক, কিন্তু ঝুঁকি ও দূষণের বিনিময়ে এই উন্নয়ন সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রকে কতটুকু লাভবান করবে তা প্রশ্নবিদ্ধ।

সুন্দরবন সংরক্ষণের কথা চিন্তা করলে এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অবস্থান ঝুঁকি-বিমুখ হওয়া উচিত।
রেফারেন্স:
National Energy Policy 2004
Power system master plan 2010
Renewable energy policy of Bangladesh(2008)

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।