তখন আমি কবি ছিলাম না, তবুও নিজেকে কবি ভাবতে ভালো লাগতো। কাঁধে চটের ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে ভালো লাগে না আমার, তাও এভাবেই হাঁটতাম। যাদের খুশকির সমস্যা, তাদের নাকি চুল ছোট রাখতে হয়... আর আমি গ্রীষ্মের দুপুরেও ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল নিয়ে পার্কে বসে থাকতাম।
কবিরা জেনেশুনে ভুল করতে ভালোবাসে। ।
আমি একেকটা ভুল করি, আর নিজেকে বাহবা দেই।
ভুলের শুরু কবে জানি না, তবে একজোড়া ঘুঘু পুষতাম বছর তিনেক আগে। কিভাবে যেন একটা উড়ে গেলো ফাঁক পেয়ে। আর সেইদিনই প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে রাতজেগে মেয়েটার সাথে কথা বলা শুরু করি।
এলোমেলো অদ্ভুত সব কথা বলতাম, দিনের বেলা যেসব মনে করলে অবাক লাগতো রীতিমতো।
মাঝে মাঝে নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হতো আমার সেই ‘একলা পাখির’ সামনে।
তবে এভাবেই, একটা মেয়ে, আরেকটা পাখিকে নিয়ে অদ্ভুত একটা জীবন শুরু করি।
যেসব কথা মেয়েটাকে বলা হতো না, সেসব খাঁচাটার সামনে দাঁড়িয়ে বলতাম। আর হীনম্মন্যতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ভেতরে ভেতরে ছটফট করতাম-
তারপর-
পাখিটা যেদিন ছেড়ে দিলাম, খাঁচার সামনে হাঁটু গেড়ে কিছু কথা বলেছিলাম। অবাক কাণ্ড, এবার মেয়েটাও কিভাবে যেন সেই ‘গোপন কথা’ জেনে গেলো।
।
সঙ্গত কারণেই, ফোনে ওর নাম ‘উড়াল পঙ্খী’ দিয়ে সেভ করি।
আর... ও আমার ক্লাসমেট ছিলো।
গল্পের মত প্রেম আসলে ছিল না কখনোই, তবে ভালো-লাগা ছিল। খাঁটি কিছু আবেগ ছিল।
হাত ধরে না হাঁটলেও, কাঁধে মাথা রাখার নির্ভরতা ছিলো দুজনের। এমনকি চোখের দিকে তাকিয়ে মন পড়ে ফেলতে পারতাম তখন...
তবু আমরা দুজনই জানতাম, এটা কোন সম্পর্ক না। অনেক কারণ ছিলো...
এরপর ২০০ পৃষ্ঠার ডায়েরিটা লেখা শুরু করি। এবং ওর সাথে শেষের শুরুটাও তখনই।
নিজের ভেতরের প্রতিটা শব্দ খুলে প্রায় ২০ দিন ধরে লেখা ডায়েরিটা ওকে গিফট করি।
তার কয়েকদিন পর ও নিজেই আমাকে জানায়, বুয়েটের সেই ভাইয়ার কথা।
আমার গুরু নজরুল সৈনিক-হৃদয়ে কঠিন ভালোবাসা ধারণ করতে পারতেন। আমি তো সৈনিক নই, আমি কিভাবে পারবো? তার উপর আবার আমি হলাম ভণ্ড-কবি, সুকান্তের ‘আঠারো বছর বয়সের’ সদ্য-তরুণ।
বুয়েটে চান্স পাওয়ার নেশায় পড়াশুনা শুরু করলাম। ঠিক করলাম, চান্স না পেলে ওর সামনে দাঁড়াবো না আর।
ও হ্যাঁ, ‘উড়াল পঙ্খী’ তখন আমার কল-লিস্ট থেকে বাদ গেলেও ফোনের ইনবক্সে বেশ নিয়মিত নাম। ।
এরপর...
ক্লান্তিকর কয়েকটা মাস। ক্যালকুলেটর-কাগজ-কলম নিয়ে যান্ত্রিক জীবন পার করলাম, তারপর আবার যথারীতি ভুল। কিন্তু জীবনের অঙ্কে তো অনেকরকম উত্তর থাকে, বুয়েট অ্যাডমিশন টেস্টকে জীবনের সাথেই বোধহয় মিলিয়ে ফেলেছিলাম।
তাই ভয়ঙ্কর সহজ ভুল করে ওয়েটিং লিস্ট থেকে চান্স না পেয়ে সবচেয়ে তীব্র দুঃখটাও এজন্যই ছিলো।
মাস ছয়েক পরের কথা...
‘বর্ষা-রাগিণী’ নামে আমার একটা কবিতা ছাপা হয় পত্রিকায়। ততদিনে আমার ডান-হাতের ষষ্ঠ-আঙ্গুলটার উপর বিশ্বাস চলে এসেছে। ভার্সিটি-ক্যাম্পাসেও খবর ছড়াতে দেরি হয় না।
সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে তখনও নিজের বাধ ভাঙে নি, উড়ে যাওয়া ঘুঘু যে ফিরে এসেছে সেটাও না।
তবে-
লালনের এক অজানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটু বেশিদূর চলে গিয়েছিলাম মনে হয়। পারবেন কেউ বলতে-
“খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়??”
এবার ‘বর্ষা-রাগিণী’র ভেতরের গল্পটা বলি।
ল্যাব শেষ করে ক্যান্টিনে চা খাচ্ছিলাম। দুম করে কোথেকে হাজির হল ভার্সিটির আধা-পাগল মেয়েটা। সবাই বলতো, ওকে বানানোর সময় আল্লাহ নাকি ওর মধ্যে ভুল করে একটা ছেলেমানুষের মন বসিয়ে দিয়েছে!!
-ছেলেমানুষ হয়ে ক্যান্টিনে মেয়েদের মত চা খাস্, লজ্জা লাগে না?
-তুই এতক্ষণ ক্যাম্পাসে কি করিস?
-তুই একটা পাদ।
-বাসায় যা, এতক্ষণ ক্যাম্পাসে কি?
-টং এ চা খাওয়া না, এমন করিস ক্যান?
চায়ের কাপটা ধরে টান দেয়ার পর উঠলাম। উপায় নেই আর।
টং-এর দোকানের লোকগুলো বিশ্রীভাবে তাকায় মেয়েদের দেখলে, ওর তো আর এইসবে খেয়াল থাকে না। ওদিকে আকাশে মেঘ জমছিলো, তাই আরেকটু সামনে এগোলাম রিকশা নিয়ে।
"এই যাহ, দুইদিন আগে জ্বর থেকে উঠলাম, এখন আসলো বৃষ্টি।
তোর সাথে বের হওয়া বিরাট ভুল-"
মেঘের হুংকারে আমার কথা চাপা পড়ে গেলো। পরমুহূর্তেই শুনলাম পাশ থেকে পাগলিটা চিৎকার করছে-
“ও মামা, ঘণ্টার ভাড়া কত??”
আমিই ছিলাম তো তখন, নাকি? ঝুম বৃষ্টির মধ্যে চিৎকার করে গান গাইতে গাইতে, হাসতে হাসতে কতক্ষণ কিভাবে কাটলো জানি না। নিজেকে ‘দি নোটবুক’ সিনেমার নায়ক মনে হচ্ছিল।
তবে এটা বলতে পারবো, পৃথিবীটা ঐ মুহূর্তে থেমে গেলে খারাপ হতো না।
বৃষ্টিবিলাসের পুরো সময়টা শীতে কাঁপছিলাম।
আর একলা বাসায় ফেরার সময় কিভাবে যেন কাঁপছিলো অবাধ্য হৃৎপিণ্ডটা। এভাবে অনেকদিন পর...
গোটা তিনেক প্যারাসিটামল খেয়ে কবিতাটা লিখে শেষ করি বাসায় ফিরে।
আর কবিতাটা ছাপার পর-
অনেক অনেক দিন পর একটা ফোন পাই... উড়াল পঙ্খী-
কয়েকবার হ্যালো বললাম। আর তারপর একটা অদ্ভুত সুন্দর পাখির রূপান্তর অনুভব করলাম, আমার জীবনের প্রথম পড়া, সেই প্রেমের গল্পের নাইটিঙ্গেল পাখির কান্না। ও তো কখনও কাঁদত না কারো সামনে।
‘বর্ষা-রাগিণী’ দুঃখের কবিতা ছিল- তাই ও হয়ত ভেবেছিল.....................
কিন্তু ওকে কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে দিল।
ফিরে যাই কুহেলিকা প্রসঙ্গে-
ও আচ্ছা, বলা হয়নি নামটা সম্পর্কে। কুহেলিকা হলো মায়ার ভ্রান্তি। আধা-পাগলিটাকে আমি কুহেলিকা বলেই ডাকি।
ভয়াবহ পছন্দ করি ওকে।
ঘুরেফিরে ওর সাথেই সময় কাটাই, আড্ডা দেই। বাংলাদেশ আর ওয়েস্ট-ইন্ডিজের শেষ ওয়ানডেতেও ওকে নিয়েই গিয়েছিলাম। এত লাফাতে পারে ও... নর্থ গ্যালারির লোকজন অবাক হয়ে ওর লাফঝাপ দেখছিল।
আর আমি? আমার বুকের কাঁপুনিটা আজকাল স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে। আর নিজের ছোট্ট শেলফটায় কয়েকশ’ পাণ্ডুলিপি জমা হয়ে আছে।
আহ, এখন আর আমার নিজেকে জোর করে কবি ভাবতে হয়না।
খুব ভালো ছবি আঁকে আমার কুহেলিকা। ওর ক্লাসের খাতার পিছনে আমার একটা স্কেচও করেছিল একদিন।
কিন্তু দুনিয়াদারি বুঝে না একদম। যখন-তখন রাস্তাঘাটে যার-তার সাথে গল্প জুড়ে দেয়।
মন খারাপ হলে হঠাৎ একা একা বের হয়ে পড়ে হল থেকে।
উদ্ভট হাস্যকর ইচ্ছা হয় মাঝে মাঝে। মনে হয়, সারাজীবন যদি এভাবে এই অপূর্ব কুহেলিকাকে দেখেশুনে সামলে রাখতে পারতাম।
কিন্তু আমি তো মনেপ্রাণে কবি। ভুলের পাহাড়ের চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হবে আমাকে।
অন্য ধর্মের রক্ষণাত্মক এক পরিবারের মেয়েকে ভালোবাসা তাই আমার জন্য অস্বাভাবিক না নিশ্চয়ই।
“ওদের কান্না চাপা গর্জন হয়ে ওদের বুকেই থেকে যায়,
তাতে ওদের কিছুই আশা যায়না।
ওরা কবিতার পর কবিতা লিখে যায়,
রাত্রি বেলা চোখের কোণে জল, আর বুকের মাঝে পাথর চেপে-
.................. ওরা আসলেই মানুষ নয়”
আমাকে নিখাদ কবি হতে হবে। আমার প্রিয় এই কবিতাটার মতন।
যেদিন পাগলিটার বিয়ে হবে, সেদিন ওর কানে কানে আমার সবচেয়ে সুন্দর কবিতাটার লাইনগুলো বলবো...
ঐ কবিতাটা এখনও লেখা হয় নি।
কালির বদলে চোখের পানিতে যেদিন কবিতা লেখা শিখবো সেদিন ওটা লেখা হবে।
আমার পুরনো বন্ধু সেই ‘একলা পাখি’র কথা বলে কাহিনীটা শেষ করি।
খাঁচা থেকে বের করে বাসার সামনে পাখিটাকে ছেড়ে দেই, কিন্তু কি কারণে জানি না, মুক্ত পাখিটাও যেন ‘একলা’ হয়েই থেকে গেল। আমার বাসার সামনেই ঘুরঘুর করত। বেশিদূর উড়তেও পারতো না।
আমার সেই গোপন কথাগুলোর ভারেই মনে হয় আটকে পড়েছিল বেচারি।
তারপর......
হঠাৎ করে মরে গেলো একদিন।
কে জানে, সেই পাখির অভিশাপেই হয়ত অদৃশ্য একটা খাঁচায় আজ অবধি আটকা পড়ে আছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।