তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা সভ্যতার এ আধুনিক সময়েও আজকাল পত্রিকার পাতায় গৃহকর্মীর প্রতি অকথ্য ও অসহনীয় নির্যাতনের খবর দেখা যায়। শহুরে শিক্ষিত হয়েও আমরা সামান্য অপরাধে কাজের মেয়েটিকে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশু) কঠিন শাস্তি দিয়ে স্বস্তি অনুভব করছি- কারণে অকারণে তার মা-বাবা তুলে গালিগালাজ করছি।
আমরা কি ভুলে বসে আছি, একজন শক্তিমান আল্লাহ সবকিছু দেখছেন এবং শুনছেন, আমাদের প্রতিটি শব্দ ও কর্ম সব লিপিবদ্ধ হচ্ছে পাপ-পূণ্যের খাতায়। নিজেকেই না হয় প্রশ্ন করি, ঘরের অসহায় কাজের মানুষটিকে পড়ালেখা শেখানো তো দূরের কথা, শেষ কবে ওদের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলেছি?
............................................
নিজেদের দৈনন্দিন জীবনযাপনে আমরা একে অপরের সাহায্য ও ভালোবাসা নিয়েই তো বেঁচে আছি। সবল-দুর্বল এবং ধনী-গরিবের এ অপূর্ব সমন্বয়ে টিকে আছে পৃথিবী।
জীবনমানের এ ব্যবধানের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে রহস্য। এমন কম-বেশি রয়েছে বলেই পৃথিবী আজ কর্মময়।
স্বয়ং আল্লাহপাক বিষয়টি জানাচ্ছেন সূরা যুখরুফের ৪৩ নম্বর আয়াতে, ‘আমিই তো পৃথিবীতে তাদের মধ্যে জীবনযাপনের মান ভাগ করে দিয়েছি এবং কাউকে অন্যের ওপর সম্মান দিয়েছি। ’ তবে তিনি এও বলে দিয়েছেন- এ ব্যবধান আমার কাছে তোমাদের শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়, বরং যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খোদাভীরু- সে-ই আল্লাহর কাছে বেশি সম্মানীত।
কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী তো বটেই, নিজেদের ঘরের টুকটাক কাজের প্রয়োজনে আমরা কাজের মানুষ (গৃহকর্মী) রাখি।
কাজের ছেলে কিংবা মেয়ে- ঘরের পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে রান্নাবান্না এবং পরিবেশনের কষ্টকর কাজ তারা করছে দিনের পর দিন। মাস শেষে বেতনের আশায় তারা মুখ বুঁজে সয়ে যান গৃহকর্তার বকুনী ও অত্যাচার। কিংবা সামান্য ভুলের জন্য অনেক জঘন্য গালিগালাজ, কখনো বা শারীরিক নির্যাতন।
আজ চৌদ্দশ’ বছর পেরিয়ে এসেও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মাথা নুয়ে আসে আমাদের প্রিয়তম রাসুলের (সা.) উদারতা ও দূরদর্শিতা দেখে। সুদূর মদীনার এ নবী শুধু নামাজ কিংবা রোজার ইবাদত নয়- ঘরের অসহায় কাজের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে তাও বলে গিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘এ কাজের লোকগুলো তো তোমাদেরই ভাই। আল্লাহপাক এদের তোমাদে অধীন করেছেন। তোমরা যে খাবার খাও, তাদেরও তেমন খাদ্য দিও। আর তোমাদের কাপড় চোপড়ের মতো ওদেরও পোশাক পরতে দিও। তাদের সাধ্যের বাইরে কোনো কাজ দিওনা।
যদি দিয়ে ফেল, তবে তোমরাও তাদের সাহায্য করো। ’’ (মুসলিম-৩১৩৯)
শুধু মৌখিক নির্দেশনা নয়, তিনি তা বাস্তবেও করে দেখিয়েছেন। এক-দু কিংবা পাঁচ-ছয় বছর নয়, একাধারে দশটি বছর রাসুল (সা.) এর সেবা করেছেন হযরত আনাস (রা.)। রাসুলের (সা.) ঘরে বাইরের কাজগুলো তিনিই করতেন। কখনো তার ভুল হতো, কখনো তিনি ভুলে যেতেন, ইচ্ছা অনিচ্ছায় ত্রুটি হয়ে যেতো।
কিন্তু এমন হয়েছে কেন? অমন করেছো কেন? বকাঝকা বা চড় থাপ্পড় তো দূরের কথা রাসুল (সা.) তার উদ্দেশে কোনোদিন উফ শব্দটুকুও উচ্চারণ করেননি।
রান্নাঘরে চুলার পাশে আগুনের তাপ ও গরম ধোয়া সহ্য করে দিনভর যে মানুষগুলো তৈরি করে চলেছে আমাদের আহার- তাদের কথা ভুলে থাকেননি প্রিয়নবী (সা.)। তাইতো তিনি বলেছেন, তোমাদের খাদেম (কাজের মানুষরা) যখন খাবার রান্না করে তোমাদের সামনে নিয়ে আসে- অথচ সে এতোক্ষণ এর ধোয়া ও উত্তাপসহ্য করেছে- তোমরাতাকে ডেকে তোমাদের সাথে বসতে দাও, তাকে খেতে দাও। খাবার যদি অল্প হয়, যা তাকে পেট ভরে দেওয়ার মত যথেষ্ট নয় তবে অন্তত তার হাতে এক-দু লোকমা উঠিয়ে দাও। (বুখারী)
তিনি ছিলেন মানবতার নবী।
ধনী-গরীব এবং সুখী-অসহায় সবার জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন সব সময়। মৃত্যুশয্যায়ও তিনি ভুলে থাকেননি এ অসহায় গরীব গোলাম-খাদেম কিংবা চাকর-বাকরদের কথা। তার মৃত্যুর পর যেন তারা অবহেলিত না হয়- সেজন্য তিনি বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন তাদের অধিকারের কথা। হাদীসের গ্রন্থসমূহে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা থেকে জানা যায়, রাসুলের (সা.) মুখে সর্বশেষ উচ্চারিত শব্দগুলোর মধ্যে তিনি বারবার শুধু নামাজ এবং চাকর ও দাসদাসীদের কথা বলে গেছেন। নামাজের মাধ্যমে তিনি আল্লাহপাকের সব ইবাদত ও হক আদায়ের ইঙ্গিত করেছেন, তেমনিভাবে চাকর ও দাসদের কথা বলে মানুষে মানুষের পারস্পরিক অধিকার ও কর্তব্য পুরণের প্রতি জোর দিয়ে গেছেন।
একদিন রাসুল (সা.) দেখলেন, তারই এক সাহবী আবু মাসউদ এক চাকরকে মারধর করছেন। তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন, শোনো হে আবু মাসউদ! মনে রেখো, তুমি এ গোলামটির সঙ্গে যে অধিকার দেখাচ্ছো, মহান আল্লাহ এর চেয়েও বেশি তোমার ব্যাপারে শক্তিশালী ও অধিকারী। ’ এমন কথা শুনে অনুতপ্ত সাহাবী তখনই তাকে মুক্ত করে দিলেন। রাসুল (সা.) তাকে বললেন, এটি যদি তুমি না করতে তবে অবশ্যই তোমাকে আগুনে জ্বলতে হতো। ’ (মুসলিম, আবু দাঊদ, তিরমিযী)
লক্ষ করবেন, নিজের কেনা গোলামের গায়ে হাত তোলার কারণে রাসুল (সা.) এ সাহাবীকে কেমন সতর্ক করলেন।
কেনা গোলামের ব্যাপারে যদি এই হয়, তবে আজকাল যারা ঘরে কাজের মানুষ- তাদের নির্যাতন করা কতো ভয়ংকর গুনাহের কাজ। সে তো আর আপনার কেনা গোলাম নয়। সে একজন পূর্ণ স্বাধীন মানুষ- তারও রয়েছে পূর্ণ সম্মান ও অধিকার?
এক লোক এসে রাসুলকে (সা.) জিজ্ঞেস করছিল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আমার গোলাম বা খাদেমকে কয়বার মাফ করবো? রাসুল (সা.) চুপ থাকলেন। লোকটি তৃতীয় বার একই প্রশ্ন করলে উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, প্রতিদিন ৭০ বার। (তিরমিযী)
রাসুল (সা.) প্রায়ই তার ঘরে কিংবা বাইরে খাদেমকে দেখলে জিজ্ঞেস করতেন, তোমার কি কিছু লাগবে? একদিন তার এমনই প্রশ্নের উত্তরে এক খাদেম বলে ফেললেন, জ্বী ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার লাগবে।
রাসুল (সা.) বললেন, বলো, তোমার প্রয়োজন খুলে বলো। খাদেম বলতে লাগলো, আমার একটিই দাবি, আপনি আমার জন্য কিয়ামতের মাঠে সুপারিশ করবেন। আরেক খাদেমের কাছে গিয়ে তিনি খোঁজ নিতেন, তুমি বিয়ে করছোনা কেন?’ তেমনিভাবে এক ইহুদি ছেলে তাঁর কিছু কাজ করে দিত। রাসুল (সা.) তার অসুস্থতার সংবাদে তিনি নিজে ওই ছেলেটির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। নিজের খাদেমদের কাছে ডেকে তাদের শিক্ষা-দীক্ষা ও আমলের খবর নিয়েছেন।
রাসুল (সা.) এও বলেছেন, তোমার গোলামের ওপর যেটুকু কাজ তুমি হালকা করে দিলে, তা অবশ্যই তোমার নেকীর পাল্লায় যোগ হবে। (ইবনেহিব্বান)
একটি বিষয়ে এখানে দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি। কারণে-অকারণে কিংবা নিজের ছেলে-মেয়ে হোক অথবা চাকর-বাকর, কাউকে শাসনের নামে মারধর করা যাবেনা। বিশেষ করে চেহারায় (মুখমণ্ডলে) আঘাত করা যাবেনা। শিক্ষা দেওয়া কিংবা শাস্তিমূলক- যে কারণেই হোক- মুসলিম শরীফের ২৬১২ নং হাদিসসহ কয়েকটি হাদীসেও রাসুল (সা.) স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করেছেন, কেউ যেন অন্যের চেহারায় কখনো আঘাত না করে।
’
চেহারা একজন মানুষের সবচেয়ে সম্মানিত অঙ্গ, এটিই তার পরিচয়- তাই কখনো কোনো মানুষের চেহারায় হাত তোলা নয়। চাই সে নিজের সন্তান কিংবা ঘরের কাজের মানুষ হোক না কেন, ছোট কিংবা বড়।
শ্রমিকের বেতন ঠিক সময়ে পূর্ণভাবে আদায় করা নিয়ে অসংখ্য তাগিদ ও এর অনাদায়ে ধমক বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে। যে তার শ্রমিকের পাওনা আদায়ে গড়িমসি করছে স্বয়ং আল্লাহপাক তার প্রতিপক্ষ। রাসুল (সা.) শ্রমিকের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগেই তার বেতন শোধ করতে বলেছেন।
মোহ কিংবা অবহেলায় যেন এসব পাপে আমরা জড়িয়ে না পড়ি, বরং একজন সচেতন মুমিন হিসেবে সবার অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হবো- এটাই তো আমার ঈমানের পরিচয়।
সভ্যতার এ আধুনিক সময়েও আজকাল পত্রিকার পাতায় গৃহকর্মীর প্রতি অকথ্য ও অসহনীয় নির্যাতনের খবর দেখা যায়। শহুরে শিক্ষিত হয়েও আমরা সামান্য অপরাধে কাজের মেয়েটিকে (বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশু) কঠিন শাস্তি দিয়ে স্বস্তি অনুভব করছি- কারণে অকারণে তার মা-বাবা তুলে গালিগালাজ করছি। আমরা কি ভুলে বসে আছি, একজন শক্তিমান আল্লাহ সবকিছু দেখছেন এবং শুনছেন, আমাদের প্রতিটি শব্দ ও কর্ম সব লিপিবদ্ধ হচ্ছে পাপ-পূণ্যের খাতায়। নিজেকেই না হয় প্রশ্ন করি, ঘরের অসহায় কাজের মানুষটিকে পড়ালেখা শেখানো তো দূরের কথা, শেষ কবে ওদের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলেছি?
আমার এ লেখাটি বাংলানিউজে প্রকাশিত-http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=2fa3efee8d24ce769d0fd4cf4919c143&nttl=20130109081622164832 ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।