আরাফাতের ময়দানে পেঁৗছেই বুকটা হাহাকার করে উঠল। হৃদয় চিরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এলো- লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...। অনবরত শুধু বলতে লাগলাম- 'লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননি'মাতা লাকা ওয়ালমুলক; লা শারিকা লাক। ' লাখ লাখ হাজির কণ্ঠ চিরে বার বার একই ধ্বনি চারদিকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির। সবার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। সবার চোখ জাবালে রহমতের দিকে। মনের কোণে উঁকি দিয়ে গেল দেড় হাজার বছর আগে আরাফাতের ময়দানে দেওয়া প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের ভাষণের কথা। হিজরি ১০ সালে (৬৩২ খ্রিস্টাব্দে) এই হজের দিনে আরাফাতের ময়দানে সমবেত হাজিদের উদ্দেশে প্রিয় নবী (সা.) জাবালে রহমত পাহাড়ে দাঁড়িয়ে শেষ খুতবা দিয়েছিলেন।
ঘোষণা করেছিলেন- আজ থেকে ইসলামকে পরিপূর্ণ ধর্ম ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালার কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম। মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবৎকালে শেষ ভাষণ ছিল বলে ইসলামের ইতিহাসে এটা নবীজির বিদায় হজের ভাষণ হিসেবে উল্লেখিত আছে। এ ভাষণে তিনি মুসলমানদের করণীয় সম্পর্কে বিশেষ করে মানুষের মর্যাদা, নারীর অধিকার, পারস্পরিক সম্পর্ক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। ইসলামের সেই বিধান মতে প্রতিবারের মতো গতকালও আরাফাতের ময়দানে হজের খুতবা দেওয়া হয়।
তবে তা দেওয়া হয় মসজিদে নামিরা থেকে। এবারও খুতবা দেন সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি আবদুল আজিজ আল শায়খ। এরপর তিনি বিশ্বের নির্যাতিত মুসলমানদের মুক্তি, মানুষের শান্তি ও কল্যাণ কামনা করে মোনাজাত করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে গতকাল তা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে। হজের খুতবা শোনার পর আমরা আরাফাতের ময়দানে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে আদায় করি।
গতকাল মিনায় ফজরের নামাজ আদায় করে সূর্যোদয়ের পর পরই সবার সঙ্গে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে রওনা হই। মিনা থেকে কেউ যানবাহনে অথবা হেঁটে আরাফাতে যাচ্ছেন। সূর্যাস্ত পর্যন্ত এ আরাফাত ময়দানের অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সারা দিন আরাফাতে অবস্থান শেষে সন্ধ্যার আগে আগে মুজদাফিলার উদ্দেশে রওনা হই। বার বার জাবালে রহমতের দিকে তাকাই।
বুকটা আবার হাহাকার করে ওঠে। নিজের অজান্তে বলতে থাকি_ লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক...। আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য আরাফাতের ময়দানে হাজিরা দেওয়ার মাধ্যমে হজের প্রধান আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেল। এখন বাকি আরও দুটি প্রধান আনুষ্ঠানিকতা। শয়তানকে পাথর মারা এবং কোরবানি করা।
এরপর মাথা মুণ্ডন করে পবিত্র মক্কা নগরে ফিরে গিয়ে মা হাজেরা (আ.)-এর পুণ্য স্মৃতির বরকত পাওয়ার আশায় সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সায়ি করে বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করব। সূর্যাস্তের পর হাজিদের সঙ্গে আমরা মুজদালিফায় যাব। সেখানে মাগরিব ও ইশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করা হবে। এখানে খোলা আকাশের নিচে সারা রাত অবস্থান করার অনুভূতিই আলাদা। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কেউ কোরআন তিলাওয়াত করছেন, কেউ জিকির-আসকার করছেন।
সবার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচার জন্য হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর নির্দেশে ইসমাইল (আ.) যেভাবে পাথর ছুড়ে মেরেছিলেন, তা পালন করার জন্য আমাদের এখান থেকে ৪৯টি ছোট আকারের কঙ্কর সংগ্রহ করে মিনার তাঁবুতে ফিরে যেতে হবে।
আজ সৌদি আরবে ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর জামারাতে আক্কাবায় (বড় শয়তানকে) সাতটি কঙ্কর মারতে যাব। এখানে হাজিদের অনেক ভিড় হয়। তবে এখন পাথর নিক্ষেপের জন্য আধুনিক ব্যবস্থানার কারণে আগের মতো কোনো সমস্যা হয় না বলে শুনেছি।
এরপর ১১ ও ১২ জিলহজ প্রতিদিন ২১টি করে কঙ্কর মারতে যাব তিন শয়তানকে। প্রথমে ছোট, এরপর মাঝারি ও সব শেষে বড় জামারাতে শয়তানের প্রতি পর্যায়ক্রমে কঙ্কর ছোড়ার মাধ্যমে হাজিদের একদিকে সুন্নাত পালন করা হয়, অন্যদিকে শয়তানের প্ররোচনা থেকে বেঁচে থাকার শপথ নেওয়া হয়।
আজ মঙ্গলবার আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য যার যার সাধ্যমতো পশু কোরবানি দেওয়া। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর নিজ সন্তানকে কোরবানি দেওয়ার ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের পশু কোরবানির বিধান দিয়েছে ইসলাম। কোরবানির সময় সবাই উপস্থিত থেকে কোরবানি করতে পারে না।
আমার ইচ্ছা আছে কোরবানির সময় নিজে উপস্থিত থাকার। এরপর সব হাজির সঙ্গে আমরা মক্কায় ফিরে আল্লাহর ঘর বায়তুল্লাহ শরিফ তাওয়াফ করব এবং সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে সাতবার সায়ি করব এবং মিনায় নিজ নিজ তাঁবুতে ফিরে যাব। হজব্রত পালনের আগে বা পরে হাজিরা আল্লাহর প্রিয় হাবিব রসুলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা জিয়ারত করার জন্য মদিনা সফর করে থাকেন। আমি হজ শেষ করেই যাব প্রিয় নবী (সা.)-এর রওজা জিয়ারতে মদিনায়। ১৮ অক্টোবর থেকে শুরু হবে বাংলাদেশের হাজিদের ফিরতি ফ্লাইট।
১৬ নভেম্বর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।