আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরিবর্তনের আশা ও স্বপ্নই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে



যদিও এ-ই বাস্তব যে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক বিশৃংখলা, রাষ্ট্রীয় অর্থ-ব্যবস্থার চরম বিপর্যয়, সামাজিক অবক্ষয়, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও শত্রুতা, শাসন-শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভিশাপ, মানব-সম্প্রদায়ের জীবন ও অনুভূতির ক্রমাগত মৃত্যু প্রভৃতি বিষয়গুলো পৃথিবীতে মানব জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে, তবুও আমরা আশা করি, স্বপ্ন দেখি, একদিন উন্নতির শিখরে আরোহণ করব। আমাদের এই লাল-সবুজের দেশ একদিন বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। পরিবর্তনের এই আশা, এই স্বপ্নই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু তা বেশি দিনের জন্যে নয়। যদি না এই আশা ও স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার সামান্যতম মিল থাকে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, যারা আমাদের স্বপ্ন দেখান, তাদের কাছ থেকে আমরা স্বপ্নের যথার্থতা বা ব্যাখ্যা দাবি করি না। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করি না। বরং সুবোধ বালকের মতো মাথা ঝুঁকে মেনে নিই। স্বাধীনতার আগে ও পরে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন অনেকেই। 'সোনার বাংলাদেশের', বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির, দিনবদলের, 'ডিজিটাল বাংলাদেশের', মাইক্রোক্রেডিট ফর্মুলায় 'দারিদ্রমুক্তির'।

কিন্তু কেউ তাদের জিজ্ঞেস করেনি- কিভাবে? তারপর কিভাবে?? তারপর কিভাবে??? জিজ্ঞেস করেনি, কারণ জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হয়নি। আমরা এমনিতেই বুঝেছি ও মেনে নিয়েছি যে, তা সম্ভব ও বাস্তব। দেশি-বিদেশি 'স্বপ্নবাজরা' গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখায়। আর তাদের মগজ-উদ্গীরিত থিওরি-আক্রান্ত এক শ্রেণীর 'বুদ্ধিবাজ' ক্ষমতালিপ্সু, সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরাচারী শাসকদের প্রতি উপদেশ বর্ষায় গণতন্ত্রের চর্চা ও বাস্তবায়নের জন্য। তারা বুলি আওড়ায়, 'জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস', নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি।

কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা বিশ্বের কোথাও পরিপূর্ণ গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন দেখাতে পারেনি। তাদের স্ববিরোধী বক্তব্য-ব্যাখ্যা অন্ধকূপে ডিগবাজি খায়, কানাগলিতে ঘুরপাক খায়। অথচ বিষয়গুলো আমরা তলিয়ে দেখতে রাজি না। আমেরিকার 'গণতন্ত্র' বিশ্বের অন্যান্য দেশ শোষণের উপর নির্ভরশীল। ব্রিটিশদের তৎকালীন গণতন্ত্র নির্ভর করত ভারত মহাদেশের শোষণের ওপর।

আর আজকের তথাকথিত 'গণতান্ত্রিক বিশ্ব' নিজ দেশ ও পরদেশের কোটি কোটি দুর্বলের বুকে পাড়া দিয়ে প্রতিষ্ঠিত। আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, পাশ্চাত্য-উদ্ভাবিত তথাকথিত গণতন্ত্র বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। এর কারণ অনেক। আমাদের দেশের শাসন-কাঠামো, নির্বাচন-পদ্ধতি, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ইত্যাদির কলা-কৌশল আমরাই উদ্ভাবন করব। যারা বিশ্বব্যাপী মানবতাবিরোধী অপরাধ করে বেড়াচ্ছে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস করছে, নারীকে ভোগের পণ্য বানিয়েছে, বস্তুবাদ ও ভোগবাদের তালিম দিচ্ছে, পরিবার-ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়েছে, তারা আমাদের মডেল হতে পারে না।

মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, লিঙ্কনবাদ আমাদের আদর্শ হতে পারে না। আমি বলছি না যে, পরিবর্তন সম্ভব নয়। বরং আমিও পরিবর্তনে বিশ্বাস করি, দিনবদলের স্বপ্ন দেখি। তবে অন্যরা যেভাবে স্বপ্ন দেখেন ও দেখান, হয়তো আমি সেভাবে দেখি না, দেখাই না। অন্যরা যেভাবে বিশ্বাস করেন, হয়তো আমি সেভাবে করি না।

অনেকেই মনে করেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছাড়া প্রকৃত পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাহলে প্রশ্ন, যারা এ পর্যন্ত ক্ষমতা পেয়েছেন তারা পারেননি কেন? এই মনোভাব নতুন কিছু সমস্যারও উদ্ভব ঘটায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর কয়টা নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে, অদ্যাবধি এসব দল-সংগঠনের মোট সংখ্যা কত এবং ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে দৈনিক কি পরিমাণ দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ঘৃণ্য কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে তা হিসেব করলেই বিষয়টা সুস্পষ্ট হবে। অন্যদিকে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সংঘ-সংগঠন প্রভৃতি স্বাধীনতার পর থেকেই নিজ নিজ উদ্যোগ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছে দেশ ও জাতিকে একটি সুন্দর সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ উপহার দেয়ার জন্য। কিন্তু কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে সাফল্য অর্জিত হলেও সামগ্রিকভাবে আমাদের মৌলিক সমস্যাসমূহ হু হু করে বাড়ছে বৈ কমছে না।

এতে অনেক মেধাবী ও প্রাজ্ঞজন ধৈর্য হারিয়ে শেষ পর্যন্ত সরাসরি রাজনীতির ময়দানে অবতীর্ণ হন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও উস্কানীমূলক কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এরপর তারাও এক অদৃশ্য সুতোর টানে পূর্ববর্তী রাজনীতিকদের পথই অনুসরণ করেন। আবার অনেকে চূড়ান্তভাবে হতাশ হয়ে ঘরে বসে গেছেন। তাহলে আমরা কি দেখছি? পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপরিহার্য মনে করা যেমন সমস্যাপূর্ণ, তেমনই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বা চিন্তা-চেতনা ছাড়া বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত সাফল্যও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। আমি যতদূর বুঝি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বা রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছাড়া আরও একটি পথ আছে, যার মাধ্যমে আমাদের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ও সুখী-সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণ সম্ভব।

বরং প্রাথমিক পর্যায়ে এটিই একমাত্র পথ। আর তা হল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দেশের যে কোনও প্রান্তে সর্বজনীন ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় খুব ছোট্ট একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও একটি চরিত্রবান, আদর্শিক ও সুশিক্ষিত দল এবং এই সুশিক্ষিত দলের মাধ্যমে একটি সুশিক্ষিত, স্বনির্ভর ও নিয়মিত আত্মসমালোচনায় অংশগ্রহণকারী জাতি গঠন সম্ভব। যতক্ষণ রাষ্ট্র পরিচালনার মত যোগ্য, আদর্শিক, সচ্চরিত্রবান ও মহান আত্মত্যাগী একদল দক্ষ লোক তৈরি না হবেন ততক্ষণ রাষ্ট্রের হাল সঠিকভাবে কেউ ধরতে পারবে না। আর দেশ-জাতির এই আদর্শিক, সুদক্ষ ও মহান নেতাগণ সংসদের ভেতর তৈরি হবেন না।

পার্টি অফিসেও না। এসবখানে তো আগেই তৈরি হয়ে যেতে হয়। তাহলে এঁরা তৈরি হবেন কোথায়? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। অবশ্যই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সুতরাং শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। প্রয়োজনে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক স্বাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। সারাদেশে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। বিপুল জনগণকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তুলতে হবে। এ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব নয়।

আর এই কাজটি সরকার করবে না। করতে হবে আমার, আপনার। পরিবর্তন কোনও সরকার আনবে না। আনব কোনও আমি বা আপনি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।