প্রধান বিরোধী দল বিএনপির আগামী নির্বাচনী ইশতেহারের মূল প্রতিপাদ্য হবে 'সর্বক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন। ' শাসন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমাজ জীবনের সর্বত্রই থাকবে সংস্কারের ছোঁয়া। বিশেষ করে তরুণদের কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণয়ন করা হবে উন্নয়নের রূপরেখা। একুশ শতকের উপযোগী আধুনিক সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে গ্রহণ করা হবে বিশদ পরিকল্পনা। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের আদলে প্রশাসনিক সংস্কারের দিকনির্দেশনাও সনি্নবেশ করার চিন্তাভাবনাও চলছে।
রূপরেখায় বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ধাঁচে দেশের বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠারও ঘোষণা থাকতে পারে।
আসন্ন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহার প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের এমনই দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে। সে আলোকে ইতোমধ্যেই ইশতেহার প্রণয়নের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছেন তারা। আগামী ঈদের পর ইশতেহারের খসড়া রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। ইতোমধ্যে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি সময়োপযোগী নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বিএনপির এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকছে, যুবসমাজের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থান আর যে কোনো মূল্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার। সেই সঙ্গে আগামী সরকারের উন্নয়ন ও নতুন ধারার শাসন ব্যবস্থার রূপরেখা। এরই অংশ হিসেবে পরিবর্তনের স্লোগানে তরুণ ও নারীদের এক প্লাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ করা হবে। ক্ষমতায় গেলে বিরোধী দলের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি বন্ধের সুস্পষ্ট ঘোষণাও থাকবে এতে। এ ছাড়া সরকারের মেয়াদ শেষে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থার অঙ্গীকারও থাকবে ইশতেহারে।
এদিকে লন্ডনে চিকিৎসাধীন তারেক রহমান অতি সম্প্রতি সেখানে এক কর্মী সমাবেশে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য একটি উন্নয়ন রূপরেখা উপস্থাপন করেন। এতে বাংলাদেশের কৃষি, শিক্ষা, শিল্প, প্রযুক্তি, পরিবেশ ও পর্যটন, রাজধানীর যানজট, পানি, বিদ্যুৎসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে করণীয় স্পষ্ট করে তিনি বলেন, অতীতমুখিতা নয়, দৃষ্টি দিতে হবে ভবিষ্যতের দিকে। জানা গেছে, নতুন ধারার শাসন ব্যবস্থার রূপরেখায় আইন সংশোধনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের আদলে প্রশাসনিক সংস্কারের পরিকল্পনা নেওয়ার ঘোষণা রাখা হতে পারে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে দলীয়ভাবে যোগ্য, দক্ষ, সৎ ব্যক্তিদের নিয়োগের বিধান করা হবে। তাদের পাশাপাশি আমলারাও থাকবেন এবং দলীয়ভাবে পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত এসব কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবেন।
পাঁচ বছর পর পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এলে তারাও এসব গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজেদের লোকদের নিয়োগ দিয়ে নিজেদের মতো কাজ করতে পারবেন। মার্কিন প্রশাসন এবং ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশের প্রশাসনে বর্তমানে এ ব্যবস্থা চালু রয়েছে বলে জানান বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান। আগামী নির্বাচন ও সরকার নিয়ে বিএনপির রূপরেখার সম্ভাব্য পরিবর্তন সম্পর্কে শফিক রেহমান বলেন, সরকারের শুরুতেই দলীয় লোকদের যোগ্যতা অনুসারে ভালো ভালো পদে চাকরির ব্যবস্থা করতে পারলে দুর্নীতি কিংবা টেন্ডারবাজির অপবাদ ঘোচানোর পাশাপাশি দল ও দেশ দুটোর জন্যই কাজ করা যাবে। জানা গেছে, রূপরেখায় সংসদকে কার্যকর করতে বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকারসহ জিয়া সরকারের আদলে বিরোধী দল থেকে জাতীয় সংসদে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির প্রধান নিয়োগের প্রস্তাব রাখার চিন্তাভাবনা চলছে। সমাজের বিশিষ্টজন ও বিশেষজ্ঞদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিয়োগ দেওয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে।
মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব, যুবসমাজের ব্যাপক কর্মসংস্থান, দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতিও থাকবে অঙ্গীকারনামায়। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা, শেয়ারবাজার, হলমার্ক, ডেসটিনিসহ বিভিন্ন সেক্টরে কেলেঙ্কারির ঘটনায়ও জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশনাও থাকছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে। সূত্র জানায়, বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে ইতোমধ্যে ইশতেহার প্রণয়নের কাজও শুরু হয়েছে। ঈদুল ফিতরের পরপরই 'নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৩' চূড়ান্ত হবে। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্ব স্থায়ী কমিটির সদস্য, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সাবেক আমলা ও বুদ্ধিজীবীদর সমন্বয়ে একটি কমিটি এই ইশতেহার তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছেন।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের বিগত সময়ের ইশতেহারও চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে বিএনপি। তরুণ ও নারী সমাজের বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের একটি অংশকেও এবার ইশতেহার প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সূত্র মতে, সর্বশেষ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে দেওয়া বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্যও ইশতেহার প্রণয়ন কমিটি বিশ্লেষণ করছে। বেগম জিয়ার ওই বক্তব্যে দেওয়া বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও আগামী ইশতেহারে সনি্নবেশিত হবে। এ ছাড়া বিগত সাড়ে চার বছরে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বেগম জিয়ার প্রতিশ্রুতিও ইশতেহারে যুক্ত হবে।
এ ব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইশতেহার প্রণয়ন প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একটি সময়োপযোগী নির্বাচনী ইশতেহারের কাজ প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছে। ঈদের পর এটা চূড়ান্ত করা হবে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, যে কোনো মূল্যে সর্বক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠাই হবে বিএনপির আগামী দিনের নতুন ধারার সরকার। যার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা পাবে আইনের শাসন, বিচার বিভাগ ও বিচারকদের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা।
আর এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে দুর্নীতি রোধ করা। অর্থাৎ দুর্নীতির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স থাকতে হবে নতুন সরকারের। আর এর জন্য কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য যা কিছু করার দরকার তার সব কিছুই করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, জনগণের কল্যাণ ও দেশের উন্নয়নে সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞগণের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ-খনিজ সম্পদ, পানি সম্পদ, আইন ও বিচার, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, প্রতিরক্ষা, নারী উন্নয়ন, শিশুকল্যাণ, যোগাযোগ ও গণপরিবহন, পরিবেশ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান, শ্রমকল্যাণ, সমবায়, মানবাধিকার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, সন্ত্রাস দমনসহ বিভিন্ন বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে 'পরামর্শ কমিটি' গঠন করা হবে। এসব বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
তবে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান জানান অন্য কথা। তিনি বলেন, আগামীতে ক্ষমতায় এলে একুশ শতকের উপযোগী 'নতুন ধারার' আধুনিক সরকার গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিএনপি। তখন জনগণ চাইলে বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর আদলে দেশের সংসদীয় ব্যবস্থাকে সংস্কার করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে 'দ্বিকক্ষ'বিশিষ্ট জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করা হবে। দেশের খ্যাতিমান আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানীয় জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের নিয়ে সংসদের 'উচ্চ কক্ষ' গঠন করারও পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'জ্ঞানভিত্তিক' দেশ গড়ার লক্ষ্যে 'সৎ ও মেধাবী' লোকদের কাজে লাগাতেই মূলত নতুন পরিকল্পনা নিতে হবে।
একই সঙ্গে প্রতিহিংসার রাজনীতি চিরতরে দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণসহ ব্যাপক সংস্কারমূলক কার্যক্রম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ব্যাপারে 'ম্যাডামের' সঙ্গে আমার পরিষ্কারভাবে কথাবার্তা হয়েছে। তিনিও (খালেদা জিয়া) বলেছেন, দল এবং দেশের ক্ষেত্রে সবার অবস্থানকেই মূল্যায়ন করতে হবে যথাযথভাবে। আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাল্টে দিতে হবে পুরো দেশের রাজনৈতিক কালচার।
দূরের মানুষকে দরজা খুলে দিয়ে আমন্ত্রণ না জানিয়ে পাশের বাড়ির মানুষটাকে আগে কাছে টানার নীতি গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে সহযোগিতা ও আন্তরিকার মনোভাব তৈরি করতে হবে। তবে সবক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠাই হবে এই নতুন ধারার সরকারের মূল লক্ষ্য।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।