মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রীর মধ্যকার বহু প্রতীক্ষিত ফোনালাপের পর সংলাপ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু দুই নেত্রীই এখনো সংলাপ ও সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকার-সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের কথা বলছেন। এমনকি কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন। আমরা তাঁদের বিশ্বাস করতে চাই এবং আশা করি যে তাঁরা অবিলম্বে শর্তহীন সংলাপের আয়োজন করবেন। কারণ, শর্ত সাপেক্ষে সংলাপ হয় না, সংলাপ হলেও তা থেকে কোনো ইতিবাচক ফল আসে না।
কিন্তু মনে হয় যেন নাগরিকদের জন্য অতি কাঙ্ক্ষিত হলেও বর্তমানে সংলাপ শর্তের বেড়াজালে আটকে গেছে। প্রধানমন্ত্রী গত ১৮ অক্টোবর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য একটি সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সকল দলকে সঙ্গে নিয়েই জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চাই। বিরোধী দলের কাছে আমার প্রস্তাব, নির্বাচনকালীন সময়ে আমরা সকল দলের সমন্বয়ে সরকার গঠন করতে পারি... বিরোধী দলের সাংসদদের মধ্যে থেকেও আপনারা নাম দিতে পারেন, যাঁদের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মন্ত্রিসভায় সদস্য করে সর্বদলীয় সরকার গঠন করতে পারি। ’ প্রসঙ্গত, গত বছর বিবিসির ‘হার্ডটক’ অনুষ্ঠানে তিনি প্রায় একই ভাষায় একই ধরনের প্রস্তাব দেন।
কিন্তু দুটি প্রস্তাবেই অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। যেমন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্ব কি গত সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে, না সংসদে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে, না সমান সমান হবে। তবে মনে হয় যেন তাঁর প্রস্তাব বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ তিনি তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব করেছেন, যাতে তাঁর অতীতের সংবিধান সমুন্নত রাখার ঘোষণারই প্রতিফলন ঘটেছে। সামপ্রতিক সময়েও তিনি নিজে এবং তাঁর সহকর্মীরা সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সমাধানের ওপরই জোর দিয়ে আসছেন।
প্রসঙ্গত, কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতিনিধি হিসেবে মধ্যস্থতাকারী স্যার নিনিয়ান স্টিফেনস ১৯৯৫ সালের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকারি ও বিরোধী দল থেকে পাঁচজন করে সাংসদ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। দুর্ভাগ্যবশত এবারও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার-সম্পর্কিত প্রস্তাব বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়া গ্রহণ করেননি।
প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের বিপরীতে বিরোধীদলীয় নেত্রী ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্য থেকে ১১ জনকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই সময়কার দুই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন এখন বেঁচে নেই, কয়েকজন অসুস্থ এবং দুজন ইতিমধ্যে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।
তাই অনেকেই বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা প্রদর্শন না করার অভিযোগ তুলেছেন। সর্বোপরি তাদের এ প্রস্তাব সরকারি দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
দুই দলের কাছে একে অপরের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হয়নি বলে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিরোধের অবসানের লক্ষ্যে বিকল্প প্রস্তাবের কথা ভাবা আবশ্যক। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিবেচনার জন্য আমরা ‘সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর পক্ষ থেকে দুটি বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করছি। আমরা মনে করি যে আমাদের প্রস্তাব দুটি উভয় পক্ষের জন্যই ‘উইন-উইন’ বা বিজয়ী অবস্থার সৃষ্টি করবে।
আর দুটি বিকল্পই বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই বাস্তবায়ন সম্ভব।
প্রথম বিকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, ১১ জন ব্যক্তিকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে, যার মধ্যে পাঁচজন হবেন সরকারি দলের ও পাঁচজন হবেন বিরোধী দলের নির্বাচিত সাংসদ এবং বাকি একজন হবেন নির্দলীয় ব্যক্তি, যিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। ইচ্ছা করলে নির্দলীয় ব্যক্তিটিকে উপনির্বাচনের মাধ্যমে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত করে আনাও সম্ভব। আর নির্দলীয় ব্যক্তিটি নারী হলে তাঁকে সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত করে আনা যেতে পারে।
কীভাবে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নির্ধারিত করা হবে? সরকার ও বিরোধী দল তাদের নির্বাচিত সাংসদদের নির্ধারিত করে দিলে তাঁরা দলান্ধ ব্যক্তি হওয়াই স্বাভাবিক।
এমন ব্যক্তিদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে সে সরকার হবে অত্যন্ত অকার্যকর। আর যে নির্দলীয় ব্যক্তি এমন সরকারের প্রধান হবেন, তাঁর পক্ষেও কার্যকারিতা প্রদর্শন অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাই কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তির পরিবর্তে একটি পদ্ধতির মাধ্যমে—যে পদ্ধতি হবে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য—এসব ব্যক্তিকে নির্ধারিত ও নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়া প্রয়োজন। তাই অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভার ১১ জন সদস্যের নাম প্রস্তাব করার জন্য আমরা আমাদের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাব করছি, সর্বাধিক জ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, যার সভাপতি হবেন। এসব ব্যক্তি জ্যেষ্ঠ নাগরিক ও অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি, তাই তাঁদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ বিবেচনা শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের নামের সুপারিশ আশা করা যায়।
অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হবে, তাঁরা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবং এ সংসদের মেয়াদকালে কোনো উপনির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তাঁরা অবশ্যই কোনো নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায়ও অংশ নেবেন না।
দ্বিতীয় বিকল্প প্রস্তাব অনুযায়ীও ১১ জন ব্যক্তিকে নিয়েই অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দল থেকে পাঁচজনের পরিবর্তে তিনজন করে সাংসদ নেওয়া হবে। এর কারণ হলো, সরকারি ও বিরোধী দলের বর্তমান সাংসদদের মধ্য থেকে পাঁচজন, যাঁরা সম্মানিত কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেবেন না, পাওয়া দুরূহ হতে পারে।
এ বিকল্পের ক্ষেত্রে বাকি পাঁচজন হবেন নির্দলীয় ব্যক্তি, যাঁদের মধ্য থেকে একজন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন।
অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভার মেয়াদ হবে ৯০ দিন। এ মেয়াদকালে তাঁদের দায়িত্ব হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা এবং সরকারের রুটিন কার্যক্রমে নিজেদের নিয়োজিত রাখা। ৯০ দিনের সময়সীমার মধ্যে দৈব-দুর্বিপাকের কারণ ছাড়া নির্বাচন না হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আপনাআপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় বিকল্পের ক্ষেত্রে সরকারি দলের পাঁচজন সাংসদ, বিরোধী দলের পাঁচজন সাংসদ এবং দলনিরপেক্ষ পাঁচজন ব্যক্তির সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে।
এ মন্ত্রিসভায়ও নির্দলীয় ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রেও অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভার ১৫ জন সদস্য নির্ধারিত হবেন। এ মন্ত্রিসভার মেয়াদও ৯০ দিন হবে এবং তাঁরা সরকারের রুটিন কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ থাকবেন। তাঁরাও আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এবং নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না।
আমরা মনে করি যে উক্ত দুটি প্রস্তাবের যেকোনোটি গ্রহণ করলেই আমাদের নির্বাচনকালীন সরকারসংক্রান্ত বিরাজমান সমস্যার সমাধান হতে পারে।
এ দুটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে কাউকেই এমন ছাড় দিতে হবে না যে, সে পক্ষ পরাজিত হয়েছে বলে মনে করবে। সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ছাড় দেওয়া না-দেওয়া অবশ্য নির্ভর করবে আমাদের দুই নেত্রীর সদিচ্ছা, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও সাহসিকতা প্রদর্শনের ওপর। তাঁরা তা প্রদর্শন করতে না পারলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আবারও খাদে পড়ে যেতে পারে এবং আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হতে পারে, যা হবে জাতির জন্য ‘সম্মিলিত আত্মহত্যার’ শামিল।
অন্য একটি বিবেচনায়ও বিরাজমান সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার-সম্পর্কিত সমস্যা আমাদের দুটি রাজনৈতিক দলেরই সৃষ্টি।
নাগরিকদের এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকাই ছিল না বা নেই। বরং নাগরিকেরা দলগুলোর সিদ্ধান্তের শিকার বা ভুক্তভোগী। তাই নাগরিক হিসেবে আমাদের দাবি, দলগুলো যেন দ্রুততার সঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকার-সম্পর্কিত সমস্যাটির সমাধান করে নাগরিকদের স্বস্তি দেয়। একই সঙ্গে এ দাবিতে আমরা নাগরিকদেরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাই। কারণ, নাগরিকেরা সক্রিয়, সোচ্চার ও প্রতিবাদী না হলে রাজনীতিবিদেরা এ দাবির প্রতি ভ্রুক্ষেপও করবেন না।
আমাদের দুই নেত্রী—শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া—অন্তত দু-দুবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তাই তাঁদের কাছে আমাদের বিনীত নিবেদন, তাঁরা যেন নিজেদের প্রশ্ন করেন: কী ‘লিগেসি’ বা উত্তরাধিকার তাঁরা রেখে যেতে চান? তাঁরা কি চান মানুষ ভবিষ্যতে তাঁদের মনে রাখুক? চাইলে কী জন্য মনে রাখবে? কোন অবদানের জন্য তাঁরা জনগণের স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকতে চান?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।