হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা নরেন্দ্র মোদি যত দিন বেঁচে থাকবেন, ভারতের গুজরাট রাজ্যের সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায় তত দিন তাঁর পিছু ধাওয়া করবে। এমনকি ‘স্বর্গলোকেও’ যে তিনি এ দায় বহন করে নিয়ে যাবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা এ কথাটা সহজেই বুঝি। আমাদের চেয়ে অনেক গুণ ‘বিচক্ষণ’ নরেন্দ্র মোদি এই সত্যটা আরও ভালো বোঝেন। কিন্তু এসবের কোনোই পরোয়া তিনি করেন না।
কেননা, তাঁর হিসাব হলো ভোট ও ক্ষমতার। এবং তিনি একজন অত্যন্ত দক্ষ হিসাবি। বারবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর হিসাবের প্রায়োগিক সাফল্য প্রমাণ করে দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদিদের হিসাব আর আমাদের মতো মানুষের ব্যক্তিগত নিকাশকে এক প্রান্তে মেলানোর তত্ত্ব এ সমাজে কাজ করে বলেই কদিন আগে আমরা দেখলাম, সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরও মোদির প্রতি সমর্থন জানালেন। এর কয়েক বছর আগে অপর সুরস্রষ্টা ভূপেন হাজারিকার বিজেপিতে যোগদানের ক্ষেত্রেও বোধ করি এই ব্যক্তিগত হিসাবনিকাশ-তত্ত্বই কাজ করেছিল।
দেশ পৃথক হলেও উপমহাদেশের ভূমি তো অবিচ্ছিন্ন। এ দেশে মোদির মতো হিসাবি মানুষ যেমন আছেন, তেমনই লতা-ভূপেনের মতো নিকাশি লোকও আছেন। সুতরাং কক্সবাজারের রামুর পর পাবনার সাঁথিয়ার মতো ঘটনা ঘটবে না—এ নিশ্চয়তা যেমন কেউ দিতে পারেনি, ঘটনাও তেমন থেমে থাকেনি। এভাবে ২ নভেম্বর সাঁথিয়ার বনগ্রাম বাজারের ঘটনার মাত্র দুই দিনের মাথায় ৪ নভেম্বর লালমনিরহাট সদরের সাতপাটকী মাঝিপাড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এবং এভাবে হয়তো ঘটতেই থাকবে।
সংখ্যালঘু এক যুবক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করেছে—এই গুজব ছড়িয়ে
রামুতে নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। এর এক বছর পর সাঁথিয়ার বনগ্রামের বাবলু সাহার ছেলে রাজীব সাহা ফেসবুকে মহানবী (সা.) সম্পর্কে কটূক্তি করেছে—এই গুজব ছড়িয়ে আবার তাণ্ডব চালানো হলো। গুজব ছড়ানোর কৌশলটা ছিল একই।
ফেসবুকের ব্যাপারস্যাপার সাধারণ মানুষ কমই বোঝে। সাম্প্রতিক সময়ে এই মাধ্যমটিকে মতলববাজেরা বেশ সাফল্যের সঙ্গে নেতিবাচক কাজে ব্যবহার করছে।
তাই বলে মনোযোগটাকে ফেসবুকে আটকে রাখার কোনো কারণ নেই। যখন ফেসবুক ছিল না তখনো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানোর জন্য কৌশল ও অজুহাতের অভাব হয়নি। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে পথের ধুলো ভিজে কাদা হয়েছে সংখ্যালঘুদের চোখের জলে। কখনো কম, কখনো বেশি। সাতচল্লিশের দেশ বিভাগে সব থেকে বেশি মূল্য দিয়েছে পাঞ্জাব আর বাংলার সংখ্যালঘুরা।
স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার লালেও মিশে রয়েছে সংখ্যাগুরুর পাশাপাশি অসংখ্য সংখ্যালঘুর রক্ত। তার পরও থেমে থাকেনি। ফুটবলকে যেমন একবার বাঁ পা একবার ডান পা করে এগিয়ে নেওয়া হয়, তেমনই ক্ষমতায় টিকে থাকা অথবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য সংখ্যালঘু নির্যাতনের ‘খেলাটি’ খেলে যাওয়া হচ্ছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসার মুখে আরেক দফা নতুন মাত্রায় সংখ্যালঘু-নিপীড়নের সূত্রপাত ঘটে। সাম্প্রদায়িক উসকানির মাধ্যমে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করা, অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে বিচার-প্রক্রিয়াকে প্রলম্বিত করা বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমতাসীনদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলা—এমন সব বিষয়ে নতুন মাত্রার এই সংখ্যালঘু নির্যাতনের পেছনের কারণ সন্দেহ নেই।
তবে এটাই সবটা নয়। এ দেশে সংখ্যালঘু-পীড়নের ক্ষেত্র তৈরি এবং যুগ যুগ ধরে সেই ক্ষেত্র অবিকৃত থাকার পেছনের কারণটিও এর সঙ্গে যুক্ত।
সংখ্যালঘু, বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা পৃথিবীর অনেক দেশে এমনিতেই নানা সামাজিক-রাজনৈতিক চাপ ও বৈষম্যের শিকার। তাদের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হতে পারে, যদি এর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিটা যুক্ত হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল দলিল সংবিধান একসময় ধর্মকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
এরপর এতে মতলববাজদের হাত পড়ে। অনেক কাটাছেঁড়ার পরও শেষ পর্যন্ত যখন তাতে রাষ্ট্রধর্ম রয়ে যায় এবং তা সংখ্যাগুরুর দিকেই ঝুঁকে পড়ে, তখন সেই সংবিধানে আর যা কিছুই লেখা থাক না কেন, সংখ্যালঘুরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারে না।
রাষ্ট্রীয় এই দৃষ্টিভঙ্গি সংখ্যালঘুদের দেহমনে হীনম্মন্যতা ও হীনবলের রসায়ন তৈরি করে। অন্যদিকে সাধারণ সংখ্যাগুরুর মনোজগতে কাজ করে এর উল্টো প্রতিক্রিয়া। এবং এই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে নানামুখী স্বার্থ যুক্ত হয়ে তা চেপে বসে সংখ্যালঘুর ঘাড়ে।
কক্সবাজারের রামু, উখিয়া, টেকনাফ, সাঁথিয়ার বনগ্রাম বা দেশের অন্যান্য স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের খবরের পাশাপাশি এ খবরও আসে যে কেবল ধর্মীয় দল নয়, কমবেশি অন্য বড় দলগুলোর নেতা-কর্মীরাও এর সঙ্গে যুক্ত। অর্থাৎ এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় দাগের পরিকল্পনার নায়কদের স্বার্থের সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের স্বার্থও একই পথ ধরে এগিয়ে যায়।
গত শতকের পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের হার বেড়ে গেছে। এ ধরনের দেশত্যাগের ঘটনায় কারও লাভ ভোটের, আর কারও লাভ সম্পত্তির। ধর্মের লাভের ভাগ পড়ে থাকে খালিই।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধ্বজাটিও পড়ে মুখ থুবড়ে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষকেরা সাম্প্রতিক সংখ্যালঘু নির্যাতনের পেছনের কারণ তুলে ধরতে গিয়ে একটা ব্যাখ্যা বেশ জোরের সঙ্গেই দিচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের সংখ্যালঘুরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে, এমন একটি বড় দলের দিকে ঝুঁকে আছে। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছে, এ রকম একটি দল নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে ঝুঁকেছে আর একটি বড় দলের দিকে। দেশে সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা এবং মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দলটির সমর্থকসংখ্যা প্রায় সমান।
বিশ্লেষকদের বক্তব্য হলো, এ অবস্থায় সংখ্যালঘুরা যতই দেশত্যাগ করবে, ততই তাদের সমর্থক বড় দলটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অন্য বড় দলটি লাভবান হবে।
সংখ্যালঘু-নির্যাতনের নেপথ্য কারণ হিসেবে এই ব্যাখ্যা হয়তো ফেলনা নয়। কিন্তু এই হিসাবের মধ্যে তাহলে গোঁজামিলটা থেকে যাচ্ছে কেন? সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাদের তো তাহলে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কথা নয়; বরং প্রতিরোধ করতে মাঠে নামার কথা।
রামুর ঘটনায় একদল যুবক রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। শেষরক্ষা হয়নি।
সাঁথিয়ায়ও বাবলু সাহাকে কিছু মানুষ লুকিয়ে রেখেছিলেন হামলাকারীদের হাত থেকে রক্ষার জন্য। কিন্তু এতে সংখ্যালঘুদের মনে স্বস্তি আসেনি। দেশের অন্যত্র এটুকু প্রতিরোধও হয়নি। কোথাও
কোথাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হয়তো কঠোর হয়েছে। কিন্তু সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া কোনো দিনই সংখ্যালঘুর মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক উসকানির বিরুদ্ধে অনেকে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। আবার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেকে ব্যাপক সহিংসতার বিপক্ষে দাঁড়ানোর জন্য তেমন লোক খুঁজে না পেয়ে মনঃকষ্টে আছেন। এসব মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কিছুটা সক্রিয় হলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো। কিন্তু জনপ্রতিনিধিরা যথেষ্ট সক্রিয় নন কেন, এ প্রশ্নের কিন্তু যুক্তিগ্রাহ্য জবাব মেলে না। তাহলে কি নরেন্দ্র মোদির হিসাব-তত্ত্বটা এখানেও এসে গেল?
অনেকেই মনে করেন, গুজরাটে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি মোদির সহানুভূতি থাকলেও থাকতে পারে।
কিন্তু ভোটের বৈতরণি পার হওয়ার জন্য তিনি সংখ্যাগুরুর ভাবাবেগের বাইরে পা রাখাকে যথাযথ মনে করেননি। শাসক হিসেবে সংখ্যালঘুদের রক্ষার দায় তাঁর ওপর বর্তালেও পিছে সংখ্যালঘুর প্রতি ‘দরদ’ দেখাতে গিয়ে সংখ্যাগুরুর সমর্থন হারিয়ে বসেন—এই বিবেচনায় তিনি সংখ্যাগুরুর অযৌক্তিক ভাবাবেগের কাছে নতিস্বীকার করেছেন।
দেশে নির্বাচন আসন্ন। এখন সব ঘটনাকেই ভোটের হিসাবের নিরিখে দেখা হবে। সংখ্যালঘু পীড়নের ঘটনাকেও পদপ্রার্থীরা হয়তো এই হিসাবেই দেখবেন।
দেখবেন কিসে লাভ, কিসে লোকসান। শঙ্কায়-সংকটে যারা থাকে, তাদের ভোট আদায় হয়তো কঠিন নয়, বরং যারা তুলনায় সংকটে নেই, যারা সংখ্যাগুরু, তাদের সঙ্গে চলাটাই বেশি বুদ্ধিমানের কাজ—এমন ভাবনাও জননেতাদের কারও কারও বিবেচনায় আসতে পারে। আবার শুধু আসন্ন নির্বাচন নয়, দীর্ঘ মেয়াদের চিন্তাতেও নরেন্দ্র মোদির মতো ‘দূরদর্শী’ অনেকে হয় উঠতে পারেন।
আসলে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু নির্বিশেষে মানুষকে যখন মানুষ হিসেবে না দেখে ভোটার হিসেবে দেখা হয়, তখনই ঘটে বিপত্তি। জনপ্রতিনিধিরা মানুষকে যদি কেবল ভোটার হিসেবেই বিবেচনা করতে থাকেন, তাহলে আজ সংখ্যালঘুরা যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, কাল সংখ্যাগুরুও সেভাবেই নির্যাতিত হবে।
কাল কেন, আজও তো হীনবল মানুষ ধর্মীয় দিক থেকে সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনসহ নানা দিক থেকে নির্যাতনের শিকার।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য রামুর সাহসী সেই সব যুবক আর সাঁথিয়ায় বাবলু সাহাকে যাঁরা রক্ষা করেছিলেন, তাঁদের মতো মানুষের জন্যই হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষার সে সময় দীর্ঘও হতে পারে।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।