কবরের নম্বর ১৫৫। সাড়ে ছয় মাস ধরে শুধু এই নম্বরটিই ছিল কবরটির পরিচয়। গতকাল এই কবরে শায়িতার পরিচয় জানা গেছে। তিনি রানা প্লাজার হতভাগ্য কর্মী নাসিমা আক্তার। সাড়ে ছয় মাস পর মেয়ের কবর খুঁজে পেয়ে নাসিমার বাবা চা-বিক্রেতা আবুল কালাম আজাদ আর মা রাশিদা বেগম কবর ধরে কেঁদেছেন অঝোরে।
রানা প্লাজা ধসের পর শনাক্ত না হওয়া ১৫৭টি লাশের পরিচয় মিলেছে ডিএনএ পরীক্ষার পরে। তাঁদের মধ্যে ৫০ জনের স্বজন গতকাল বৃহস্পতিবার জুরাইন কবরস্থানে গিয়ে তাঁদের প্রিয়জনের কবরগুলো শনাক্ত করেন। প্রিয়জনদের কান্না আর হাহাকারে নিস্তব্ধ কবরস্থানের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
লাল দেয়ালঘেরা জুরাইন কবরস্থান এখন সবুজ ঘাসে ভরা। সারি সারি অনেকগুলো কবর।
তাতে চিরনিদ্রায় শায়িত একজন করে পোশাককর্মী। রানা প্লাজা ধসের পরে পচে-গলে শনাক্তের অনুপযোগী হয়ে যাওয়া হতভাগ্য ২৯১ জনের লাশ কবর দেওয়া হয় এখানে। এত দিন তাঁদের পরিচয় বলতে ছিল শুধু একটি নম্বর। যে নম্বর অনুসারে লাশ থেকে ডিএনএ নমুনা রাখা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত জাতীয় ফরেনসিক ও ডিএনএ প্রোফাইলিং গবেষণাগারে। পরে নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজন দাবিদার ৫৫৩ জন লাশ শনাক্তের জন্য সেই গবেষণাগারে তাঁদের ডিএনএ নমুনা দেন।
ছয় মাস চেষ্টা চালিয়ে ১৫৭টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে। গত রোববার এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন শ্রম মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। এরপর গতকাল শ্রমিক সংগঠন গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির ব্যবস্থাপনায় কবরের নম্বর ধরে প্রায় ৫০ জন স্বজন জুরাইন কবরস্থানে স্বজনের কবর খুঁজে পান। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন আরও কিছু নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনেরা, ডিএনএ পরীক্ষায় যাঁদের নমুনার সঙ্গে কোনো লাশের নমুনা মেলেনি।
এর মধ্যে কবরগুলোর ওপরে ঘাস গজিয়ে গেছে।
তবে প্রিয় স্বজনদের মনের ক্ষত শুকায়নি। মেয়ে আঁখি আক্তারের লাশ শনাক্ত হয়েছে শুনে এক হাতে মেয়ের ছবিসংবলিত পোস্টার, ডিএনএ নমুনা-সংক্রান্ত কাগজ আর এক হাতে একটি হাতব্যাগ নিয়ে কবরস্থান এলাকায় ঘুরছিলেন মা নাসিমা বেগম। একজন পোশাকশ্রমিক সংগঠক তাঁকে জানিয়েছেন, ১৪৪ নম্বর কবরের সঙ্গে তাঁর ডিএনএ মিলেছে। এরপর ১৪৪ নম্বর কবরটি খুঁজে পেয়েই কবরের ওপর কান্নায় ভেঙে পড়েন নাসিমা। তাঁর সঙ্গে আসা অন্যরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।
কিন্তু নাসিমার কান্না থামে না। চার ছেলেমেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে আঁখি কিশোর বয়সেই পোশাক কারখানায় চাকরি নিয়ে সংসারের হাল ধরেছিলেন। রানা প্লাজা ধসের পরে প্রথম কদিন নাসিমা ভেবেছিলেন, মেয়ে ফিরবেন। পরে ভেবেছিলেন, অন্তত লাশটা পাবেন। মেয়েকে খুঁজে বেরিয়েছেন সাভারের হাসপাতালগুলোতে, ঢাকা মেডিকেলের মর্গে, মিটফোর্ডে।
কিন্তু মেলেনি। অবশেষে পেলেন মেয়ের কবর।
মেয়ের কবর ছুঁয়ে কান্নার ভাগ্যটুকুও হয়নি পঞ্চাশোর্ধ্ব রোহিনি দাসের। তাঁর মেয়ে সমাপ্তি রানী দাস এখনো নিখোঁজ। ডিএনএ নমুনা দিয়ে এসেছেন, কিন্তু মেয়ের লাশের খোঁজ মেলেনি।
মেয়ের ছবি হাতে নিয়ে কাঁদছিলেন তিনি।
একমাত্র ছেলে মো. লিটনের কবরের ওপরে বিলাপ করছিলেন মা খাদিজা বেগম। দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে লিটনই ছিলেন বড়। সংসারের হাল ধরতে চাকরি করতে এসেছিলেন ঢাকায়। কিন্তু রানা প্লাজা সব কেড়ে নিয়েছে।
বিলাপ করতে করতে এসবই বলছিলেন লিটনের মা।
কবর ধরে কান্না আর প্রার্থনার পর স্বজনদের নিয়ে জুরাইন কবরস্থানের সামনেই বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি। সমাবেশে বক্তারা বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হওয়া লাশের হিসাবের গরমিল রয়েছে। মৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের ৫৪০ জনের ডিএনএর নমুনা নেওয়া হলেও ৩২২ জনের শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া নেওয়া হয়। পরে ১৫৭ জন শ্রমিকের ডিএনএ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ না দিতে একটি গোষ্ঠী চক্রান্ত করে যাচ্ছে।
রানা প্লাজা ধসে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা এখন পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণই পাননি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, লাশ শনাক্তের পরই তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।