কামারশালায় কৃষি যন্ত্রাংশ সারাইয়ের কাজ করতে যাওয়া হাতে গোনা কয়েকজন কারিগরের হাত ধরে ছোট ছোট যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন ও তৈরির মধ্য দিয়ে বগুড়ায় ছোট্ট পরিসরে একটি শিল্পের সূচনা হয়েছিল। ছয় দশকের ব্যবধানে সেই শিল্পই এখন দেশের অন্যতম বড় রপ্তানি খাতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে ঘটে গেছে কৃষি ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের এক অভাবনীয় বিপ্লব। ছোট-বড় প্রায় এক হাজার কলকারখানাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার কৃষি যন্ত্রাংশ এবং হালকা শিল্পের বাজার। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েছে প্রায় দেড় লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা।
কর্মসংস্থান হয়েছে লাখো শ্রমিকের। কৃষি যন্ত্রপাতির জাতীয় চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ হচ্ছে বগুড়া থেকে।
বগুড়ার কৃষি ও হালকা প্রকৌশল শিল্প বিদেশেও বাজার সৃষ্টি করছে। এখানকার তৈরি কৃষি যন্ত্রপাতি, হালকা প্রকৌশল পণ্য ও ফাউন্ড্রি শিল্প বিদেশের বাজারে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। স্থানীয় হিসাবে বগুড়ায় ছোট-বড় প্রায় এক হাজার কৃষি ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের কারখানা রয়েছে।
এর মধ্যে ৫০০টি কৃষি যন্ত্রাংশ, ৪৫০টি হালকা প্রকৌশল এবং ৪২টি ফাউন্ড্রি শিল্প।
ঢালাই কারখানাগুলোয় পুরোনো লোহা গলানোর পর তৈরি করা হয় নানা ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি ও হালকা প্রকৌশল পণ্য। লোহা ও ফাউন্ড্রির সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে পানির পাম্প। লেদ মেশিনে লোহা কেটে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি। পুরোনো লোহালক্কড় (ভাংরি লোহা), জাহাজভাঙার ও ঢালাই লোহা (পিগ আয়রন), সিলিকন পাত, কয়লা (হার্ডকোক) ও ফার্নেস তেল ফাউন্ড্রি শিল্পের প্রধান কাঁচামাল।
বাংলাদেশ ফাউন্ড্রি শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আইনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সব ধরনের কাঁচামালের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি ও বিদ্যুৎ-সংকটে সম্ভাবনাময় এ শিল্প হুমকির মুখে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে ফার্নেস তেলের মতো কাঁচামাল আমদানি কর মওকুফ করা দরকার।
বগুড়া শহর ও শহরতলির আশপাশে রয়েছে অসংখ্য ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ বা কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা। শহরের সূত্রাপুর, ফুলবাড়ী, গোহাইল সড়ক, রেলওয়ে মার্কেট, শাপলা মার্কেট, বিআরটিসি শপিং কমপ্লেক্স, ঠনঠনিয়া, চারমাথা, ভবেরবাজার, চেলোপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বড় কারখানার পাশাপাশি ছোট ছোট লেদ ওয়ার্কশপে দিনে-রাতে যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ করছেন কারিগরেরা। কারখানাগুলো ঘিরে শহরের গোহাইল সড়ক ও স্টেশন সড়কে গড়ে উঠেছে কৃষি যন্ত্রাংশ ব্যবসার এক বিশাল বাজার।
বিসিক শিল্পনগরে বর্তমানে চালু ৮৭টি শিল্পপ্লটের মধ্যে ৭১টিই কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশল শিল্পকারখানা। এর মধ্যে নয়টি ফাউন্ড্রি কারখানায় তৈরি হচ্ছে সেচ পাম্প ও টিউবওয়েলের মতো পণ্য। আর ৬২টি কারখানায় তৈরি হয় কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশল পণ্য।
এখানকার সবচেয়ে বড় কারখানা মিলটন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আজিজার রহমান বলেন, দেশে-বিদেশে বগুড়ায় উৎপাদিত কৃষি যন্ত্রাংশের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এখানকার উৎপাদিত টিউবওয়েল সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের নামিদামি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানে, যাচ্ছে বিদেশেও।
১৯৯৫ সালে ভারতে নিচ থেকে পানি ওপরে তোলার সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প রপ্তানির মধ্য দিয়ে বিদেশের বাজারে প্রবেশ করে বগুড়ার কৃষিশিল্প। এরপর ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ও ভুটানে টিউবওয়েল রপ্তানি হয় কয়েক বছর ধরে।
সম্প্রতি নেপালে টিউবওয়েল রপ্তানির জন্য চুক্তি করে ফিরেছেন আইনুল হক। বেলারুশের একটি বিনিয়োগকারী দল বগুড়া ঘুরে গেছে। বেলারুশ বগুড়ায় ট্রাক্টর, কম্বাইন্ড হারভেস্টর, পাওয়ার টিলারসহ বিশ্বমানের কৃষিযন্ত্র উৎপাদন করতে আগ্রহী।
তুরস্কের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল এখানকার শিল্প উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিদর্শনে এসে যৌথ বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। ভুটানের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল এসে এখানকার শিল্পবিপ্লব দেখে অভিভূত হয়েছে। নেপালের সচিব ও ব্যবসায়ী পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল ফিরে গিয়ে টিউবওয়েল কেনার চুক্তি করেছে।
বগুড়ার ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টিভিএস আমিরের উদ্ভাবিত জ্বালানিবিহীন গাড়ি বাজারজাতকরণের প্রস্তাব দিয়েছে। পাহক নামে একটি প্রতিষ্ঠান জৈব সার তৈরির যন্ত্র বাজারজাত করার আগ্রহ দেখিয়েছে।
ইতালিও জ্বালানিবিহীন গাড়ি বাজারজাত ও সে দেশের নাগরিকত্বের প্রস্তাব দিয়েছে। একই প্রস্তাব দিয়েছে সুইজারল্যান্ডও। মালয়েশিয়া আমিরের উদ্ভাবিত পাম তেলের যন্ত্র বাজারজাতের আগ্রহ দেখিয়েছে।
ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন, বগুড়ায় পরিকল্পিতভাবে এ শিল্প গড়ে না ওঠায় একসময় এর অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে। বর্তমানে শহরের আবাসিক এলাকাসহ যত্রতত্র ছোট ছোট শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে।
ফোরাম অব এগ্রিকালচারাল মেশিনারিজ ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড প্রসেসিং জোনের সভাপতি গোলাম আজম বলেন, শহরতলির ভারী শিল্পের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় ‘কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদন অঞ্চল (এপিজেড)’ ঘোষণা এবং সেই সঙ্গে পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত ও রাস্তাঘাট উন্নয়ন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ, মান নিয়ন্ত্রণের জন্য পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করে একটি শিল্পবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছি আমরা। ’
বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল মেশিনারিজ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সরকার বাদল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের ১০ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের উদ্যোগ নিলেও সেটি এখন প্রায় বন্ধের পথে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।