আমি একজন পর্যটন কর্মী। বেড়াতে, বেড়ানোর উৎসাহ দিতে এবং বেড়ানোর আয়োজন করতে ভালোবাসি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দেড় দশক পূর্তি আজ। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সে সময়কার আওয়ামী লীগ সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন জনসংহতি সমিতির সাথে সমঝোতা চুক্তি করে, যাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। চুক্তির পর থেকে সরকার পর্যায়ক্রমে এর বিভিন্ন অনুচ্ছেদ বাস্তবায়ন করতে শুরু করে।
তবে চুক্তিটির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি বলে অভিযোগ করছে জনসংহতি সমিতি।
তবে সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হবে। এমনকি ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও এটি উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই চুক্তির বিরোধিতা করে আসছে বাঙালি জনগোষ্ঠী। এ চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিকরাও দ্বিধাবিভক্ত।
সরকারের সাথে কোনো আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের চুক্তি হতে পারে কি না তা নিয়েও রয়েছে মতপার্থক্য। আদালত পাড়ায় রয়েছে এ চুক্তি নিয়ে ভিন্ন মত। বলা হচ্ছে, এ চুক্তি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বলে আসছেন তার সরকার চুক্তিটি বাস্তবায়ন করবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও তার সরকার নিয়েছে।
চুক্তিতে পাহাড়িদের পক্ষে নিজেদের ‘উপজাতি’ হিসেবে স্বীকার করে সই করা জনসংহতি সমিতি বলছে, এসব আশ্বাসে কোনো আস্থা নেই। সমিতির কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার সম্পাদক মঙ্গল কুমার চাকমা নয়া দিগন্তকে বলেন, চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের গাফিলতি রয়েছে। এটি আমাদের কাছে খুবই আশ্চর্য ও দুঃখজনকও বটে। যে সরকারের সাথে আমরা চুক্তি করেছি তাদের ক্ষমতার মেয়াদ শেষের দিকে, কিন্তু চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি।
জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমার সমালোচক ও জনসংহতির একাংশের নেতা সুধাসিন্ধু খীসা বলছেন, সন্তু লারমার কারণেই চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি।
তার মতে, সন্তু লারমা নতজানু নীতি অবলম্বন করছেন। এতে করে সেখানকার পাহাড়িরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
১৯৯৭ সালে চুক্তি সই হওয়ার পর এর বিরোধিতা করে গড়ে ওঠা সংগঠন ইউপিডিএফ বলছে, তারা স্বায়ত্তশাসন চায়। নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ইউপিডিএফ প্রধান প্রসীত বিকাশ খীসা এক বার্তায় বলেছেন, পাহাড়িদের মুক্তির আন্দোলন বেগবান করতে হবে।
সন্তু লারমা যে চুক্তি করেছেন এটি পাহাড়িদের অধিকার সংরক্ষণ করে না।
অন্য দিকে নিজেদের অধিকারবঞ্চিত বলে উল্লেখ করে এ চুক্তি বাতিলের দাবি করে আসছে বাঙালিদের বিভিন্ন সংগঠন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম-অধিকার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী মনিরুজ্জামান নয়া দিগন্তকে বলেন, এ চুক্তি দেশের স্বার্থ ও বাঙালিদের জীবন এবং জীবিকার জন্য হুমকি। তাই এ চুক্তির বাস্তবায়ন যেকোনো মূল্যে রুখতে হবে। সরকারের প্রতি তাদের দাবি চুক্তিটি বাতিল করে দেয়ার।
সে জন্য একাধিক বাঙালি সংগঠন আন্দোলনও করে আসছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও পার্বত্য চট্টগ্রাম গবেষক আমেনা মহসীন নয়া দিগন্তকে বলেন, পাহাড়ে বাঙালিদের রেখেই সমস্যার সমাধানে নজর দিতে হবে।
পাহাড়ে বর্তমানে ৫২ শতাংশ পাহাড়ি ও ৪৮ শতাংশ বাঙালি রয়েছেন। পাহাড়িদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি চাকমারা। মূলত সেখানকার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সহিংসতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তারা।
চাকমারা চারটি আলাদা গোষ্ঠীতে বিভক্ত। তারা হলো- রয়, খীসা, চাকমা ও তালুকদার। তঙ্চইঙ্গা নামে ুদ্র জাতিসত্তার যে অংশটি রয়েছে তারাও চাকমা সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠী। তারা পাহাড়ের চূড়ায় বসতি স্থাপন করেন বলে তাদের তঙচইঙ্গা বলা হয়ে থাকে।
অধ্যাপক আমেনা মহসীন বলেন, সরকারের উচিত হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন করা।
সেখানে পাহাড়ি-বাঙালি সঙ্ঘাত বন্ধের জন্য এটি একটি অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। কারণ চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে এটা নিয়ে সেখানে রাজনীতি হচ্ছে। এই সুযোগ সরকারকে দেয়া কোনোভাবেই উচিত হবে না।
চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে পাহাড়িদের মধ্যে হতাশা রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি। চুক্তি মতে, অস্থায়ী সেনাক্যাম্পগুলো তুলে নিলে বাঙালিরা নিরাপত্তা সঙ্কটে পড়বে কি না এমন জিজ্ঞাসার জবাবে অধ্যাপক আমেনা বলেন, বাঙালিরা মনে করেন সেনা তুলে নিলে তারা সেখানে থাকতে পারবেন না।
এটা মনে করার একটা কারণ দীর্ঘ দিন ধরে পাহাড়ি-বাঙালি সঙ্ঘাত। তা ছাড়া ভূমি সমস্যা রয়ে গেছে। চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে ভূমি সমস্যারও সমাধান করতে হবে। ভূমি সমস্যা কেটে গেলে এবং দুই পক্ষের মধ্যে আস্থা বাড়ানো গেলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি সই করে দীর্ঘ দিনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের নেতা সন্তু লারমার নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতি।
এরপর সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বেশ কিছু অস্থায়ী সেনাক্যাম্প তুলে নিতে শুরু করলে সেখানে পাহাড়িদের হাতে বাঙালিরা আক্রান্ত হতে থাকেন। তবুও বেশ কিছু ক্যাম্প সরকার তুলে নেয়।
সর্বশেষ মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর অন্তত ৩৫টি ক্যাম্প গুটিয়ে নেয়া হয়। এতে করে বাঙালিরা নিরাপত্তা সঙ্কটে পড়েন। গত বছরের এপ্রিল মাসে খাগড়াছড়ির বড় পিলাকে বাঙালিদের ওপর পাহাড়িরা হামলা করে।
এতে চারজন নিহত হন। তারা সবাই বাঙালি।
এ রকম পরিস্থিতিতে সেখানে সেনাক্যাম্প রাখার পক্ষে মত রয়েছে অনেকের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফেরদৌস হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, নিরাপত্তা নিয়ে সেখানে সরকারের খারাপ অভিজ্ঞতা রয়েছে। নাগরিক নিরাপত্তা ছাড়াও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি রয়েছে।
পাহাড়ের বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকায় বর্ডার গার্র্ডের কোনো ক্যাম্প নেই। তাই সেখান থেকে সেনা তুলে আনা কোনো দূরদর্শী সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
পাহাড়ে বাঙালিদের উপস্থিতি বহুকাল আগের। পাহাড়িদের দাবি বাঙালি উপস্থিতি ছিল সীমিত আকারে। পাহাড়ি নেতা সুধা সিন্ধু খীসার মতে, বাঙালিরা ছিলেন, সেটি খুবই কমসংখ্যক।
তারা অভিযোগ করে থাকেন সেখানে সরকারিভাবে বাঙালিদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং পুনর্বাসন করেছে। পাহাড়ি ও তাদের অনুগত সমর্থকেরা পাহাড়ে বাঙালিদের ‘স্যাটেলার’ বলতে পছন্দ করেন। ুদ্র জাতিসত্তার মানুষকে তারা বলে থাকেন ‘আদিবাসী’। আদতে সেখানে ‘আদিবাসী’ না থাকলেও এ বিষয়টি সামনে এনে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহায়তা এবং বিদেশীদের মদদে বাঙালি বিতাড়নের একটা প্রক্রিয়া দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে বলে বাঙালিদের সমঅধিকার আন্দোলনের নেতা মনিরুজ্জামান অভিযোগ করছেন। তবে অধ্যাপক আমেনা বলছেন, এসব সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক পদক্ষেপই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হবে।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা স্বাধীনতা-উত্তরকালে জনসংহতি সমিতি গড়ে তোলেন। ১৯৭৫ সালে তারা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেন। এর আগে তারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করছিলেন। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর মানবেন্দ্র লারমা সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। এর পরই এর দায়িত্ব নেন সন্তু লারমা।
তার নেতৃত্বে চলতে থাকে সশস্ত্র আন্দোলন। জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র শাখার নাম ছিল শান্তি বাহিনী। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারের সাথে চুক্তি হওয়ার পর তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন বলে জানান সন্তু লারমা। দলটির প্রধান সন্তু লারমা। তিনি একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৭ সালে। শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে প্রসীত খীসা বিদ্রোহ করেন। তিনি সে সময় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা ছিলেন। পরে তার নেতৃত্বে দলটি গড়ে ওঠে। এখন সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আন্দোলন করছেন।
তবে তাদের সশস্ত্র সংগ্রাম রয়েছে এটি তারা স্বীকার করেন না। পার্বত্য তিন জেলায় ইউপিডিএফের হাজার দুয়েক সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে বলে জানা গেছে।
কর্মসূচি : পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে জনসংহতি সমিতি ঢাকা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে সমাবেশ করবে। ইউপিডিএফ দিনটি উপলক্ষে পাহাড়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলনও ঢাকা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে সমাবেশ করবে।
পার্বত্য নাগরিক পরিষদ আলোচনা সভা করবে। গতকাল তারা ঢাকায় মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।