Youth cannot know how age thinks and feels. But old men are guilty if they forget what it was to be young.
আগের পর্বের লিংক
----------------------------------------------------------------------------------
৩০শে জুন, ১৯৩৪।
শনিবার।
মিউনিখে নিজের জন্যে নির্ধারিত হোটেল কক্ষে টেলিফোন সেট হাতে নিয়ে একা বসে আছেন অ্যাডলফ হিটলার। ৩০ ঘন্টা পেড়িয়ে গেছে, কিন্তু তিনি তার চোখের পাতা এখনো এক করতে পারেননি। ঘড়িতে সময় তখন সকাল ১০টা।
অথচ এরই মাঝে কত কিছু ঘটে গেছে! সকাল সাড়ে ছয়টায় তিনি মিউনিখে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। আর সকাল সাতটার মধ্যেই, তিনি তার তথাকথিত শত্রুদের হোটেলে উপস্থিত হন এবং সরাসরি তাদের রুমে হানা দেন। ৭ জন S.A নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদেরকে সরাসরি স্টাডেলহেইম নামক একটি কারাগারে পাঠানো হয়। হিটলার এরপর সকাল আটটার মধ্যে পুনরায় মিউনিখে হোটেলে চলে আসেন। সেই থেকে তিনি চিন্তা করছিলেন বার্লিনে ফোন করবেন কি করবেন না।
এই চৌদ্দটা বছর ধরে S.A বাহিনী হিটলারকে মরণপণ সাহায্য করে এসেছে। আর তিনি কিনা তাদেরকে ধ্বংস করে দিবেন! কিন্তু তিনি নিরুপায়। S.A এর বিদ্রোহের সম্ভাবনার খবর তার কানেও এসেছে। নাৎসি পার্টিকে বাঁচাতে হলে, তার সপ্নগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে S.Aকে ধ্বংস করা ছাড়া আর যে কোনো গতি নেই!
S.A এর ভাগ্য নির্ভর করছে একটি টেলিফোন কলের উপর। টানা দুই ঘন্টা ধরে হিটলার ইতস্তত করছিলেন।
অবশেষে সকাল দশটায় তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, তিনি বার্লিনে ফোন করবেন।
****
হিটলার বার্লিনে ফোন করে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করলেন। KOLIBRI (hummingbird)। আর তাতেই দক্ষযজ্ঞ বেধে গেল। কেননা এটি ছিল অপারেশন কলিব্রি বা অপারেশন হামিংবার্ড আরম্ভ করার কোড।
হিটলার অপারেশনটি আরম্ভ করার মাধ্যমে S.A এর ধ্বংস নিশ্চিত করলেন। এরপর তিনি একটি বিবৃতি প্রদান করেন।
"আমরা সকল S.A কমান্ডারগণকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছি। আমি(হিটলার) তার(রোহ্ম) দুর্বলতা সম্পর্কে আগে থেকেই সম্যক অবগত ছিলাম এবং পরিস্থিতিকে সঠিক পথে আনায়নের জন্যে আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। অবশ্য এই মুহূর্তে আমি বলব যে সব শেষ হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে আমার সেই সব কমরেডদের সাথে বিচ্ছেদ ঘটাতে যাদের ছাড়া আমার এই সংগ্রাম কখনোই সফল হতে পারত না। এছাড়া আর উপায় ছিল না। এদের কারণে S.A কলুষিত হয়েছে। যার কারণে, বৃহৎ স্বার্থের কথা চিন্তা করে আমি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
"
তিনি আরও বলেন, "আমি একটি পরিষ্কার নিয়ম তৈরি করতে যাচ্ছি যে সেনাবাহিনীই হবে দেশের একমাত্র সামরিক শক্তি। কোনো মানুষ, সে S.A হোক বা না হোক, ভবিষ্যতে সেনাবাহিনীর অধীনে কাজ করবে। সেনাবাহিনী এবং রাইখের ওয়ার মিনিস্টারের উপর আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। বর্তমানে পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরতে আমি সক্ষম হয়েছি। আমি এবার আপনাদেরকে নিশ্চিত করব যে, অতি শীঘ্রই দেশে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
"
****
বিকাল ৫টার দিকে, হিটলার ৭ জনের একটি তালিকা S.S এর দ্বিতীয় প্রধান সেপ ডাইট্রিচকে(S.S এর প্রধান ছিলেন হাইনরিচ হিমলার। সেপ ডাইট্রিচের কথা আগে আমি আমার কোনো লেখাতেই উল্লেখ করিনি। কিন্তু পরবর্তীতে যুদ্ধের বর্ণনার সময় তার কথা আমার লেখায় অনেকবার উঠে আসবে ইনশাআল্লাহ) প্রদান করেন। তালিকাটিতে ঐ ৭ জন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সেপ দেখেন যে তালিকাতে রোহ্মের নাম নেই।
তিনি ততখানৎ এর প্রতিবাদ করেন।
হিটলার সত্যই রোহ্মকে হত্যার ব্যাপারে দোটানায় ভুগছিলেন। এই কারণে তার নাম তিনি তালিকাতে দেননি। পরবর্তীতে, একই দিনে তিনি তার মত পাল্টান।
সেপ ডাইট্রিচ।
****
রাত আটটার দিকে হিটলার আকাশ পথে বার্লিনে চলে আসেন। বিমান বন্দরে তার সাথে হের্মান গোয়েরিং(হিটলারের বন্ধু, যিনি তৎকালীন সময়ে একাধারে নাৎসি বিমানমন্ত্রী এবং প্রুশিয়া অঞ্চলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ) এর দেখা হয়। কুশল বিনিময়ের পর হিটলারের কাছে গোয়েরিং তার একটি নিজস্ব তালিকা প্রদান করেন। তালিকাটি দেখে হিটলার অবাক হয়ে যান।
সেখানে তার দেওয়া ৭ জনের নামসহ আরও প্রায় ৮২জনের নাম অন্তর্ভূক্ত আছে। হিটলার কিছু বুঝে উঠার আগেই গোয়েরিং তাকে বলেন যে, সকালবেলা অপারেশন হামিংবার্ড(কলিব্রি) অনুমোদন করার সাথে সাথেই এদেরকে হত্যা প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে তালিকার অনেক ব্যক্তিকে পৃথিবী থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে।
****
৩০ শে জুন। ১৯৩৪ সাল।
সকাল ১০টা ১৫ মিনিট।
বিমানমন্ত্রী হেরমান গোয়েরিং এবং S.S চীফ হাইনরিখ হিমলারের কাছে এই মাত্র খবর এসেছে যে হের হিটলার কিছু সময় আগে অপারেশন হামিংবার্ড অনুমোদন করেছেন। খবরটি শোনা মাত্র তারা তাদের অধীনস্থ বাহিনীকে সতর্ক করে দেন। গোয়েরিং এর অধীনে প্রাশিয়ান পুলিশ বাহিনী এবং হিমলারের নেতৃত্বে S.S বাহিনী এবং গেস্টাপো শোডাউনের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়। হিটলারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো তালিকা আসেনি।
কিন্তু তাই বলে তো আর বসে থাকা যায় না। গোয়েরিং এবং হিমলার দ্রুত তাদের কাজে নেমে পড়েন। আগে থেকে তাদের তালিকা তৈরি ছিল। হিটলার অনুমতি প্রদান করা মাত্রই তারা শত্রু নিধনের দক্ষযজ্ঞ শুরু করে দেন।
সেদিন S.S, গেস্টাপো এবং প্রাশিয়ার পুলিশ বাহিনীর তান্ডবে হিটলারের অনেক পুরোনো এবং নতুন শত্রু নিহত হয়।
শুধু তাই নয়, নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার জন্যে গোয়েরিং এবং হিমলার নিজেদের অনেক শত্রুকেও এই অপারেশনের আওতায় হত্যা করেন। অপারেশন হামিংবার্ডের কারণে সেদিন যারা নিহত বা আহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের কথা না বললেই নয়।
সেদিন গোয়েরিং এবং হিমলারের লিস্টে ছিলেন...
গ্রেগর স্ট্রাসারঃ নাৎসিদের এককালীন সেকন্ড ইন কমান্ড। তিনি এককালে হিটলারের প্রিয় পাত্র ছিলেন। কিন্তু স্ট্রাসার ছিলেন কমিউনিস্ট ঘরানার।
যার কারণে হিটলারের সাথে তার মতবিরোধ লেগেই থাকতো। গুনের বিচারে স্ট্রাসার হিটলারের সমকক্ষ ছিলেন। অনেকে হিটলারের পরিবর্তে তাকে নাৎসিদের নেতা হিসেবে দেখতে চাইতেন। মতের মিল না হওয়াতে, ১৯৩২ সালে, হিটলার স্ট্রাসারকে বহিস্কার করেন। অপারেশনের দিন স্ট্রাসারকে গেস্টাপোরা ধরে নিয়ে যায়।
তার পিঠে গুলি করা হয়। এতে তিনি মারা না গেলেও মারাত্মক আহত হন। তার রাজনৈতিক জীবনের সেখানেই ইতি ঘটে।
কার্ট ভন স্লাইশারঃ হিটলারের আগে জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন তিনি। চ্যান্সেলর কাম একনায়ক হিসেবে শাসন করার তীব্র ইচ্ছা থাকলেও হিটলার তাকে বৈধভাবে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন।
একারণে তিনি আজীবন হিটলার এবং নাৎসিদেরকে ঘৃণা করতেন। তার মাশুল তিনি দিয়েছিলেন অপারেশনের দিন S.S দের হাতে। S.S সৈন্যরা তার বাড়িতে তাকে হত্যা করে। তার স্ত্রীকে প্রথমে রেহাই দেওয়া হলেও তিনি বেশী বাড়াবাড়ি করছিলেন। যার কারণে তাকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
গুস্তাভ ভন কাহ্রঃ তার সাথে নাৎসিদের পুরোনো শত্রুতা ছিল। ১৯২৩ সালের বীয়ার হল বিদ্রোহের সময় তিনি একক প্রচেষ্টায় হিটলারের সামরিক কায়দায় ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা ধ্বংস করে দেন। গোয়েরিং তার কথা ভুলে যাননি। অপারেশনের দিন ঠিকই শোধ নেওয়া হয়।
কার্ল এর্ন্স্টঃ বার্লিনের S.A এর প্রধান।
অপারেশনের দিন তিনি বার্লিনে ছিলেন না। সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় ছিলেন। তাকে হত্যা করা হয়।
ফ্রাঞ্জ ভন পাপেনঃ S.S এর মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে ছিলেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন জার্মান ভাইস চ্যান্সেলর।
কিন্তু তিনি অন্য দলের ছিলেন বিধায়(নাৎসিরা জোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে) তাকেও হত্যার জন্যে তালিকাকৃত করা হয়। অবশ্য অপারেশনের ভয়াবহতার কথা আঁচ করতে পেরে এর আগের দিনই তিনি জার্মানি ছেড়ে পালিয়ে যান।
****
৩০শে জুন রাত আটটার মধ্যে অধিকাংশ হত্যকান্ড শেষ হয়ে যায়। যার কারণে, হিটলারকে যখন প্রথমবারের মত ৮২ জনের তালিকা বিমানবন্দরে প্রদান করা হয়, তখন তিনি প্রতিবাদ করার কোনো সুযোগই পাননি। তিনি হাসবেন নাকি কাঁদবেন তা বুঝতে পারছিলেন না।
কেননা ৮২ জনের তালিকার অনেকেই তার শত্রু ছিল। অন্যদিকে গোয়েরিং তাকে আশ্বস্ত করছিলেন এই বলে যে, "মাই ফুয়েরার, সব ঝামেলা খতম। আগামী ১০০ বছরের জন্যে সব যন্ত্রণা থেকে অবশেষে মুক্তি। আমি জানি আপনি আমাদের এই কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাবেন। "
****
এখানে একটা কথা না বললেই নয় যে, ৮২ জন মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তি ছাড়াও সেদিন সেপ ডাইট্রিচের নেতৃত্বে আরও অনেক S.A নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল।
মূলত এটি করা হয়েছিল S.A কে ধ্বংস করার জন্যে। S.S বাহিনী দোষীদের হত্যা করার আগে বলত, "ফুয়েরারের আদেশক্রমে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভীযোগে আপনাকে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হল। ফুয়েরারের আদেশক্রমে, এইম, ফায়ার!!!"
(অপারেশন হামিংবার্ডের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় ২রা জুলাই। ততদিনে ২০০জন নিহত ব্যক্তির নাম রেকর্ড করা হয়। হিটলার নিজে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে তা স্বীকার করে নেন।
তবে সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল যে, অপারেশন হামিংবার্ডের আওতায় যতগুলো লোককে হত্যা করা হয়েছে, সকলের পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে পেনশন এবং যাবতীয় আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৪৫ সালে নাৎসি জার্মানির পরাজয়ের আগ পর্যন্ত এই নিয়ম পালনে কোনো ছেদ পড়েনি। )
****
অবশ্য অপারেশন আওতায় কিছু অপ্রত্যাশিত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। একটি ক্ষেত্রে, উইলি স্মীড নামক একজন স্বনামধন্য সংগীত সমালোচককে হত্যা করা হয়। মূলত S.S বাহিনী, স্মীড উপাধিধারি একজন S.A নেতাকে হত্যা করতে গিয়ে ভুল করে তাকে হত্যা করে ফেলে।
****
৩০শে জুন, ১৯৩৪।
স্টাডেলহাইম কারাগার।
একজন S.S সৈন্য এর্ন্স্ট রোহ্মের কক্ষে এসে চুপচাপ টেবিলে একটি পিস্তল রাখলেন। তিনি রোহ্মের দিকে না তাকিয়ে বললেন, "ফুয়েরারের আদেশ। পিস্তলে একটি মাত্র গুলি আছে।
আপনাকে দশ মিনিট সময় দেওয়া হল। "
সৈন্যটি চলে যাওয়ার পর রোহ্ম চুপচাপ চেয়ারে গিয়ে বসলেন। অতঃপর তিনি জোরে চিৎকার করে বললেন, "আমাকে হত্যা করতে চাইলে, অ্যাডলফকে বলো গিয়ে, সে যেন নিজে এসে গুলি চালায় আমার উপর। আমি আত্মহত্যা করব না। "
****
পনের মিনিট পর।
থিওডর আইখ নামক একজন S.S অফিসার রোহ্মের কক্ষে প্রবেশ করলেন। তিনি টেবিলে থাকা পিস্তলটি তুলে নিলেন এবং রোহ্মের মাথা বরাবর তাক করলেন।
তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন রোহ্ম কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলছেন, "মাই ফুয়েরার, মাই ফুয়েরার। "
ইস্পাত কঠিন স্নায়ুর জন্যে সুখ্যাতি অর্জনকারী থিওডর বললেন, "তোমার তা আগে ভাবার উচিত ছিল। এখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে।
বিদায়। "
এই বলে তিনি ট্রিগার টিপে দিলেন।
----------------------------------------------------------------------------------
এই সিরিজের অন্য পর্বগুলো
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(৩য় পর্ব) the night of the long knives
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(২য় পর্ব) Hitler becomes Dictator
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(১ম পর্ব) রাইখস্টাগ অগ্নিকান্ড(The Reichstag on fire)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমার আগের সব লেখার লিংক। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।