আমি যা বিশ্বাস করি না... তা বলতেও পারি না!
পূর্বকথা
এই লেখাটা যখন লিখতে শুরু করেছিলাম তখন আমি ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বি.এস.সি করছি। প্রায় ২/৩ ভাগ ক্রেডিট কমপ্লিট, আর ১/৩ এর মত বাকি। যদিও আমার ব্যাকগ্রাউন্ড ইলেক্ট্রিক্যাল না। আমি ডিপ্লোমা করেছি অটোমোবাইলে। বাংলাদেশে অটোমোবাইলে বি.এস.সি নেই তাই ইলেক্ট্রিক্যালে পড়া।
তবে ছোটবেলা থেকে আমার আগ্রহ কিন্তু ছিল ইলেক্ট্রিক্যালেই! সেই গল্প পরে বলব... আগে এই লেখাটা শুরু করার তাগিদ অনুভব করলাম যেদিন সেদিনের গল্পটা বলে নিই।
ভার্সিটিতে ক্লাস করছি। সাবজেক্টঃ ইলেক্ট্রিক্যাল মেসিন-১।
কোর্স টিচার অসুস্থ হয়ে ছুটিতে থাকায় বদলি টিচার হিসেবে ক্লাস নিচ্ছেন ইশতিয়াক রহমান স্যার। সেমিস্টার প্রায় শেষ অথচ কোর্স বাকি পড়ে আছে অনেক! স্যার তাই পড়াচ্ছিলেন খুব দ্রুত আর অল্প সময়ে অনেকগুলো টপিক আলোচনা করতে হচ্ছিল তাকে... আলোচ্য বিষয় ছিল "ইন্ডাকশন মোটর"।
স্বভাবতঃই ইভিনিং শিফটের স্টুডেন্টরা একটু অলস ও অমনোযোগী গোছের হয়। অবশ্য তাদের দোষ দেয়া যায় না। সপ্তাহের ৬দিন টানা ডিউটি করে সারাদিন পর আবার সন্ধ্যায় ভার্সিটির পড়ালেখা করা সত্যিই যথেষ্ট কষ্টসাধ্য! বেশির ভাগ স্টুডেন্টই ইভেনিং-এ পড়তে আসে শুধুই একটা সার্টিফিকেট নিয়ে অফিসে একটা প্রমোশন পাওয়ার জন্য। কাজেই তাদের কোন মতে পাশ করতে পারলেই হয়। ব্যাপারটা ইভেনিং শিফটের টিচারেরাও জানেন।
এজন্য তারাও কোর্সটা পড়ান অনেক সহজ করে এবং একেবারেই যতটুকু না পড়ালেই নয় ঠিক ততটুকুই!
তবুও সেদিন যখন ইশতিয়াক স্যার ইন্ডাকশন মোটরের থিওরি শেষ করে ইকুয়েশন দেখাতে শুরু করলেন তখন পেছনের দিকের অনেকেই উশখুশ করতে লাগলো। স্যার সবার উদ্দেশ্যে একটু কড়া ভাবেই বললেন- দেখুন; আপনাদের যাদের ক্লাস ভাল লাগছে না- এটেন্ডেন্স দিয়ে চলে যান। আমি কারো মার্কস্ বা হাজিরাই কাটবো না। লেকচার শীট দিয়ে দিচ্ছি, ফটোকপি করে পড়ে এসে পরীক্ষা দেবেন। খাতায় কিছু থাকলেই পাশ করিয়ে দেব- কথা দিলাম।
কিন্তু প্লীজ, ক্লাসে কেউ ডিস্টার্ব করবেন না। আমি এখন এমন কিছু বিষয় আলোচনা করব যা কেবল তাদেরই দরকার যারা সত্যিই কিছু শিখতে চায়। শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাশ করা দরকার যাদের, তাদের এই আলোচনা না শুনলেও চলবে।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম- স্যারের কথা শুনে সত্যি সত্যি কয়েকজন বের হয়ে গেল! নিচের কমন স্পেসে তখন ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ওয়ানডে ম্যাচ চলছে... বাকি যারা অভদ্রতা হয়ে যাবে ভেবে রয়ে গেল তারাও খাতা কলম রেখে বিরস মুখে বসে রইল! কেবল মাত্র আমি সহ হাতে গোনা ২/৩জন স্যারের লেকচারে মনোযোগ দিতে পারলাম এবং টুকটাক প্রশ্ন করে অসাধারণ কিছু তথ্য জেনে গেলাম যা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার এই এতো বছরেও কোনদিন জানতে পারিনি!
সেই ক্লাসটা করার পর আমি নিজের ভেতর থেকে আরেকবার দৃঢ়ভাবে অনুভব করলাম- আমি শুধুই একটা সার্টিফিকেট আর বড় মুখ করে বলার মত ভাল বেতনের একটা চাকরির জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আসিনি... ইঞ্জিনিয়ারিং ইজ মাই প্যাশন...!
[বিঃদ্রঃ আমার এই লেখা পড়ে যদি কারো মনে এই ধারণা হয় যে- "আমি নিজের ঢোল পেটাচ্ছি" তাহলে বলবঃ আপনি এক্কেবারে ঠিক ধরেছেন! জ্বি- আমি নিজের ঢোল পেটাচ্ছি। কারণ, নিজের ঢোল নিজেরই পেটাতে হয়।
আমি অন্যের ঢোল পেটালে আমার ঢোল আবার কে পিটিয়ে দেবে? তাছাড়া নিজের ঢোল অন্যের কাছে দিলে ঢোল ফাটিয়ে ফেলার সম্ভাবনা... তবে এই লেখা যদি একজন ব্যক্তিকেও তার নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে দৃঢ় মনোবল গড়ে তোলার পেছনে একটুখানি ভুমিকাও রাখতে পারে তবে সেটা হবে আমার জন্য অনেক বড় একটা বাড়তি পাওয়া...!
- সফিক এহসান ]
এক.
আমাদের দেশের প্রায় সব বাবা মায়ের মধ্যেই একটা কমন ব্যাপার লক্ষণীয়। গড়পড়তা প্রতিটি বাবা-মা-ই চায় তাদের সন্তান ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হোক! খুব অবাক লাগে এটা ভেবে যে- দুনিয়ার এতো পেশা থাকতে বেছে বেছে এই দুইটা পেশার প্রতিই এতো আগ্রহ কেন সবার? সব বাবা-মা তার সন্তানকে একজন সফল ও বড় মানের মানুষ বানানোর স্বপ্ন দেখবে সেটাই স্বভাবিক। কিন্তু তাই বলে কেবল ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার! সফল মানে কি আর কিছু নয়?
বর্তমানে এই অবস্থা হয়তো (আমির খানের 'তারে জামিন পার' বা 'থ্রি ইডিয়টস' এর মত সামাজিক চেতনা গড়ে ওঠার কল্যাণে) একটু বদলেছে। কিন্তু আমি যখন প্রাইমারীতে পড়ি তখনকার সময়ের বাস্তবতাটা এমনই ছিল। এর কারণটা যে ঠিক কী তা জানি না।
তবে খুব সম্ভবতঃ ক্লাস সিক্স থেকেই অধিকাংশ স্কুলে ইংরেজি ২য় পত্রের টেক্সট বুক ছিল (এখনও আছে নাকি?) "চৌধুরী এন্ড হোসাইন" এর বই। আর ঐ বইয়ের "এইম ইন লাইফ" প্যারাগ্রাফ বা রচনা দুইটাতেই একজন গ্রাম্য ডাক্তার হবার কথা বলা আছে। এমনকি বাংলা ২য় পত্রেও একই চিত্র! হয়তোবা ক্লাস সিক্স থেকে টেন –এই ৫ বছর বার বার পরীক্ষার খাতায় ডাক্তার হব, ডাক্তার হব লিখতে লিখতে স্টুডেন্টরা এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে যায় যে ক্লাস নাইন-টেনের আর্টস-কমার্সের স্টুডেন্টরাও পরীক্ষার খাতায় চোখ বন্ধ করে লিখে দেয়- "ডাক্তার হব"! আর ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্নটা খুব সম্ভবতঃ ওখান থেকেই শুরু...।
অবশ্য আমার মত কেউ কেউ অতি চালাক স্টুডেন্ট অবশ্য পরীক্ষায় লিখতো- শিক্ষক হব!
কারণ এতে পরীক্ষক স্যারকে ইচ্ছা মত পাম দেয়া যায়। আর স্যারও খুশি হয়ে মার্ক দেয় বেশি!
তবে আমার ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন কিন্তু এভাবে তৈরী হয়নি! "এইম ইন লাইফ" প্যারাগ্রাফ লিখতে শেখারও অনেক আগে- যখন আমি ক্লাস ১/২তে পড়ি, তখন থেকেই আমার ইঞ্জিনিয়ার হবার খুব শখ! যদিও পরীক্ষার খাতায় মুকস্ত লিখে রেখে এসেছি অন্য কথা।
ওরকম তো ছোট বেলায় অনেক কিছুই বলেছি। 'হবার স্বপ্ন' তালিকাতে দোকানদার, ট্যাক্সি/ট্রাক ড্রাইভার, প্লেনের পাইলট, আর্মি, পুলিশ, উকিল, সুপারম্যান, সিনেমার নায়ক... বাদ যায়নি কোনটাই! যাক সেসব কথা। খুব ছোট বেলাতেই ইঞ্জিনিয়ার হবার ইচ্ছেটা কেন হয়েছিল সেটা বলি...
আমরা দুই ভাই। বাবা আমার জন্মের আগে থেকেই প্রবাসী। ২ বছর পরপর দেশে আসেন, একমাস থাকেন, চলে যান।
মা আমাদের দুই ভাইকে আদরে-শাসনে মানুষ করেন। আমার যখন দুই বছর বয়স তখন আমরা পাকাপাকি ভাবে ঢাকা চলে আসলাম। দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে নিয়ে আমার আম্মু একজন মহিলা মানুষ একা একা থাকবে? সাথে একজন পুরুষ মানুষ থাকা দরকার তাই ছোট মামা আমাদের সাথেই থাকতেন। আমরা দুই ভাই আবার তাকে বাঘের মত ভয় পেতাম! কারণ, পান থেকে চুন খসলেই ছোট মামার শক্ত পিটুনি একটাও মাটিতে পরতো না। আমরা দুই ভাই সমস্ত জীবনে এতো পিটুনি (আম্মু এবং স্কুলের সব শিক্ষক মিলিয়েও!) আর কারো হাতে খাইনি! "মামা ভাগ্নে যেখানে, বিপদ নাই সেখানে" প্রবাদটির সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ ছিল আমাদের কাছে।
যা হোক- সারাদিন শাসন-শোষণ করা আর সন্ধ্যায় পড়াতে বসিয়ে অবধারিত ভাবে কাঠের রোলারের শক্ত পিটুনি দেয়া ছাড়াও ছোট মামার আরেকটা বিশেষ গুণ ছিল। সেটা হচ্ছে- তিনি যে কোন ধরনের ইলেক্ট্রিক জিনিস মেরামত করতে পারতেন। মামার একটা ৪০ ওয়াটের সোল্ডারিং আয়রন (তাঁতাল!) ছিল। কোন কাজে সেটা বের করে টেবিলে বসলেই আমরা দুইভাই আমাদের যাবতীয় অচল হয়ে যাওয়া ইলেক্ট্রিক খেলনা (বলা বাহুল্য- আব্বু বিদেশে থাকার কল্যাণে আমাদের দুই ভাইয়ের অনেকগুলো ইলেক্ট্রিক খেলনা ছিল!) নিয়ে মামার কাছে হাজির হতাম। মন মেজাজ ভালো থাকলে মামা সেগুলো "ঠিক করে" দিতো।
আমার তখন বিষ্ময়ের সীমা থাকতো না এই ভেবে যে- মামা কিভাবে এটা করে?
কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই মামার মেজাজ থাকতো চড়া আর সেসময় "ফালতু খেলনা-ফেলনা" নিয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর করে মামার "মহাগুরুত্বপূর্ণ" কাজে ব্যাঘাত করার অপরাধে ব্যাপক ধমক এমনকি কড়া ধোলাই পর্যন্ত খেতে হতো!
সেসময় তিব্র অভিমান নিয়ে ভাবতাম- ঈশ! আমিও যদি মামার মত "খেলনা ঠিক" করতে পারতাম! তাহলে কি আর এমন বদরাগী-পঁচা লোকটার পিছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে মার খেতে হতো...? আমার ইঞ্জিনিয়ার (ঠিক ইঞ্জিনিয়ার না, আসলে মেকানিক!) হবার তিব্র ইচ্ছাটা খুব সম্ভবতঃ তখনই দৃঢ়ভাবে মনের মধ্যে গেঁথে যায়।
তবে আমার এই ইচ্ছাটা কেন জানি না প্রথম দিকে খুব একটা পাত্তা পেল না। আম্মুসহ পরিবারের দু'একজন বড় মানুষদের কথা ছিল- ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। বলে রাখা দরকার- বি.এস.সি বলতে তারা কেবল "সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং"কেই বোঝাতো! কেন যেন তাদের একটা ধারণা ছিল- যারা "সয়েল টেস্ট" করে বিল্ডিং তৈরী করার পারমিট দেয় কেবল তারাই বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার! এবং তারা মোটা অঙ্কের বেতন পায়! (এর কিছুদিন আগে আমাদের বাড়ির সামনে একটা পাঁচতলা বিল্ডিং-এর ফাউন্ডেশন দেবার জন্য সয়েল টেস্ট করা হয়েছিল। সেসময় পরিবারের বড় মানুষগুলোর সাথে একজন বি.এস.সি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার-এর পরিচয় হয়েছিল বলে তাদের এরূপ ধারণা হয়ে থাকতে পারে...!) আর যারা "রেডিও, টিভি, খেলনা" সারাই করার কাজ শেখে তারা শুধুই মেকানিক! এই লাইনে বেশি পড়াশোনা নেই আর এদের ইনকামও খুব কম!
আমার পরিবারের বড়দের অনেকদিন (প্রায় ৪/৫ বছর) লেগেছিল এটা বুঝতে যে "ইলেক্ট্রিক্যাল" সাবজেক্টেও অনেকদূর পড়াশোনা করা যায় আর ভাল ইনকামও করা যায়।
তার আগ পর্যন্ত আমি মুখ কালো করে থাকতাম কারণ- বি.এস.সি ইঞ্জিনিয়ার মানেই সয়েল টেস্ট! কাজেই ইঞ্জিনিয়ার হবো বললেই ছোট মামা আমাকে জোর করে ধরে "বি.এস.সি" করিয়ে দেবে। আর আমার চোখে ভাসতো "বি.এস.সি" করে আমি এক হাটু কাদায় দাঁড়িয়ে কাঁচের টেস্ট টিউবে কাদামাটি ভরে মুখ কালো করে তাকিয়ে আছি!
ছোট মামাকে যে ছোটবেলায় কী পরিমান ভয় পেতাম তা এখন ভাবলেও অবাক লাগে! আমার স্পষ্ট মনে আছে জীবনে একবার মামার ভয়ে আমি আক্ষরিক অর্থেই হাফপ্যান্টে প্রস্রাব করে দিয়েছিলাম! আহ্ কী দিন ছিল সেগুলো! কোন মামাকে পৃথিবীর কোন ভাগ্নে এতো ভয় কোনদিন পেয়েছে কিনা আমার জানা নেই। অথচ এই ছোট মামাই কিনা আমার জীবনের লক্ষ্য গঠনে প্রথম আইডল! আজ আমি যে "ইঞ্জিনিয়ার" হয়েছি, এখনও পড়ছি আরো অনেক বড় হবার স্বপ্ন দেখি বলে... এই স্বপ্নের বীজ বপন হয়েছিল এই মামাকে দেখেই।
আমার এই মামার নাম আব্দুল আলীম চৌধুরী (স্বপন)।
মামা কি জানেন- আমি তাকে কত ভালোবাসি?
(চলবে...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।